শারীরিক বিষয় নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের অনেকেই কম-বেশি কটূক্তির শিকার হয়ে থাকেন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে যেন তা একটু বেশিই দৃশ্যমান। ফলে বাংলাদশের নারীরা প্রায়শই নিজেদের শরীর নিয়ে হীনমন্যতা আর মানসিক বিপর্যয়ে ভুগে থাকেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকা কেউই এ তালিকার বাইরে নন।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা যায়, শারীরিক অবয়ব নিয়ে দেশের ৬৯.৯২% তরুণী নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হচ্ছেন। এর মধ্যে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে ৩৭.২৪%, বন্ধু-বান্ধবের কাছে ২২%, পরিবার থেকে ১৪.২৫%, রাস্তায় চলাচলকারী পথচারী থেকে ১১.৮৫% তরুণী শরীরের আকৃতি, গঠন এবং অবয়ব নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফলের বরাত দিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এ কথা জানায় দৈনিক সমকালের অনলাইন সংস্করণ।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক হাজার ১৪ তরুণীর ওপর জরিপটি পরিচালিত হয়। জরিপে অংশ নেওয়া তরূণীদের মধ্যে ৮৮.১৭% অবিবাহিত, ১০.৯৫% বিবাহিত এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।
শনিবার (৫ মার্চ) অনলাইনে আয়োজিত “তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ওজনের কারণে ৩৯.৪৯% এবং গায়ের রঙের কারণে ৩৬.৯৫% তরুণীকে কটূক্তির শিকার হতে হয়। সেই সঙ্গে উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ এবং কণ্ঠস্বর ইত্যাদি কারণেও তরুণীদের নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হন।
গবেষণায় দেখা যায়, অনলাইনেই বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন ৪৩.৮৯% তরুণী। এর মধ্যে অবান্তর ও কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে এবং নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে ৬১.১২% তরুণী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। ১০.৩৪% তরুণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার। তাছাড়া, ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে ৯.৮৯% এবং ৫.১৭% তরুণী অযাচিত আইডি স্টকিংয়ের শিকার হন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা যায়, ৬৫.৫৮% তরুণীকে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫.৪৯% বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হন। আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে ২৯.৬২% তরুণীকে। আর ২২.২৬% তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এছাড়া, শৈশবেই ৩৮.৮৬% তরুণীকে যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। তার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা ৩৫.২৮%,অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ভুক্তভোগী হন ২৮.১৭% এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ১৬.৫০% তরুণী হীন আচরণের শিকার হন।
শৈশবের এমন ঘটনা ২৮.৪৩% তরুণীর মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ২৮.১৭% তরুণীদের মধ্যে পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ১৫.৭৪% তরুণীই একা থাকতে ভয় পান। অনেকেই পরবর্তী সময়ে বিয়ে করতে বা শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে ভয় পান। শৈশবের যৌন নির্যাতনের কারণে সারাজীবন একজন নারীকে মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, ৪৫.২৭% তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে ৮৪.১০% তরুণী যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। এছাড়া, ট্রেনে বা রেলস্টেশনে ৪.৫৮% এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১.৫৩% তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন।
৬৪.৯২% তরুণীকে গণপরিবহনে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হতে হয়। ২০.০৪% তরুণী কুদৃষ্টির শিকার। একাকী চলার সময়ে ৭৫.৬০% তরুণীরা এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হন। তবে মা, বোন, বান্ধবী বা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থায় ২১.৫৭% এবং বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায় ২.৮৩% নারী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া, পরিবারে ২২.২৯% তরুণীর মতামতকে মূল্যায়ন করা হয় না। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয় ৪৬.২৫ % তরুণীকেই।
সমীক্ষায় দেখা যায়, পারিবারিক টানাপোড়েন ৩১.৮৫% তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি আর্থিক অসচ্ছলতায় ২৪.৪৬%, বেকারত্বে ১৪.৭৯%, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার মাধ্যমে ১৪.৪০% ও যৌন নিপীড়নের কারণে ২.৩৭% তরুণী মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।
বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া ২৭.৩২% তরূণীর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। পরিবার থেকে অযাচিত চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হয়েছেন ২৩.৯২% তরুণী। ২৩.৭৭% তরুণীকে নিজেদের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হতে হয়।