নাটোরের সিংড়া উপজেলার চলনবিলে নিষিদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছ বানিজ্যিক ভাবে চাষ করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের ফসলের আইল, পুকুর পাড়, বাড়ির পার্শ্বে, মাঠে নিষিদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর হিড়িক বহু বছর ধরে। ফলে জীব-বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
সচেতন বৃক্ষ প্রেমিকরা বলছেন, অতিমাত্রায় পানি শোষণ ও অক্সিজেন গ্রহণকারী এই গাছ কার্বনডাই অক্সাইট নিঃসরণ করে ফসল, জীব-বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছে পরিবেশবিদরা।
চলনবিলের কৃষকরা বলছেন, গাছটিতে বেশি যত্ন লাগে না, ছাগলেও খায় না। একবার রোপন করলে পাঁচ বছর পরে বিক্রি করলে, শিকড় থেকেই আবারো গাছ বের হয়। কিন্তু এর ভয়ংকর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কৃষকদের কেউ সঠিকভাবে অবহিত করে না।
পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায় ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু নাটোরের সিংড়ায় কৃষকরা না জেনে ইউক্যালিপটাসের চারা বপন করছেন। এতে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে চলনবিলের পরিবেশ।
সিংড়া উপজেলার ১২ নম্বর রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের সোয়াইর গ্রামের কৃষক ইয়াসিন আলী সাময়িকীকে জানান, ‘১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে একশত ইউক্যালিপটাস’এর চারা তিনশত টাকায় কিনে জমির পাশ দিয়ে রোপণ করেছিলাম। ৫ বছর পড়ে ১০টি গাছ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।
তারপরে দুই থেকে তিন বছর পরপর বেশ ভালোই রোজগার হয়। নতুন করে চারা রোপন করতে হয় না। গাছ কাটার পরে সামান্য পরিমাণে ইউরিয়া, টিএসপি এবং পটাশ মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দেওয়া হয়। ফলে শিকড় থেকে আবারও নতুন গাছ তৈরি হয়।’
সিংড়া উপজেলার ১০ নম্বর চৌগ্রাম ইউনিয়নের গোয়াল বাড়িয়া গ্রামের কৃষক ইয়াকুব প্রামানিক সাময়িকীকে জানান, গাছটি আমরা চিনতাম না, সরকারের লোকজনই চিনিয়েছে। এই গাছ দ্রুত কাঠ হিসেবে বিক্রি করা যায় এবং বিক্রয়মূল্য ভালো।
কাঠের মানও ভালো ফলে আয় হয় ভালো। জমির পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে ফসলের জমিতে পানি বেশি লাগে এ কথা সত্য। তবে একবারে গাছ বিক্রির মোটা অংকের টাকা পরিবারের অনেক কাজে লাগে।’
বৃক্ষপ্রেমিক বেণুবর্ণা অধিকারী সাময়িকীকে জানান, ‘ইউক্যালিপটাসের পাতার মধ্যে যে কেমিক্যালটি পাওয়া যায় তা এক ধরনের আন্টিসেপটিক সে কারণে এই পাতা বেশিরভাগ পোকা-মাকড়ের জন্য ক্ষতিকারণ। এই গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না, এমনকি এই গাছে কোনো পাখি বসে না বাসাও বাঁধে না। এর কাঠ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না।
তিনি আরো বলেন, সরকারিভাবে এবং পরিবেশ বান্ধব সংগঠনের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। ইউক্যালিপটাসের বিকল্প নিম গাছ। ইউক্যালিপটাসের মতনই নিম গাছ দ্রুত বর্ধনশীল ও পরিবেশবান্ধব। তাই বেশি করে নিম গাছ রোপণে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। নইলে চলনবিল তার অস্তিত্ব হারাবে সেই দিন বেশি দূরে না।’
নাটোর সদর হসপিটালের অবঃ মেডিকেল অফিসার ডাঃ আবুল কালাম আজাদ সাময়িকীকে জানান, ‘ইউক্যালিপটাস গাছের ফলের রেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে অ্যাজমা হয়। যে বসতবাড়িতে অধিক পরিমাণে ইউক্যালিপটাস গাছ আছে সেসব বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই পাতা পড়ানো ধোয়া দিয়ে মশা-মাছি ও পোকা তাড়ানো হয় অনেক সময়।’
নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারি কলেজের বোটানিক বিভাগের প্রভাষক মো. শরিফুল ইসলাম সাময়িকীকে জানান, ‘প্রতিদিন একটি পানিখেকো ইউক্যালিপটাস গাছ ৪০ থেকে ৫০ লিটার পানি শোষণ করে মাটিকে নিরস ও শুষ্ক করে ফেলে। এছাড়া মাটির নিচের গোড়ায় ২০ থেকে ৩০ ফুট জায়গা নিয়ে চারদিকে থেকে গাছটি পানি শোষণ করে, ফলে অন্যান্য ফলদ গাছের ফলন, ফসল ভালো হয় না।
নাটোরের পরিবেশ প্রেমিক ও গণমাধ্যমকর্মী দেবাশীষ সরকার সাময়িকীকে জানান, ‘পরিবেশের বন্ধু গাছ। মানুষেরও বন্ধু গাছ। মানুষ ও প্রকৃতি থাকে কাছাকাছি। গাছ মানুষকে বাঁচার অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়, ফল দেয়। গাছ নিজেকে বিলিয়ে দেয় মানুষের কল্যাণে। কিন্তু সেই গাছই যদি প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য আগ্রাসী-প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে তাহলে তা আতঙ্কের বিষয়।
এমনই এক প্রাণঘাতী পরদেশি গাছ ইউক্যালিপটাস। এই গাছের প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে চলনবিলের ভারসাম্য। খেয়ে ফেলছে মাটির উর্বরা শক্তি। নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে ভবিষ্যৎ মরু প্রক্রিয়া শুরুর আশঙ্কা রয়েছে চলনবিলে। আর এ মরু প্রক্রিয়া রুখতে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
গোল-ই-আফরোজ কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো.সাইফুল ইসলাম সাময়িকীকে জানান, ‘এক অঞ্চলের গাছ অন্য অঞ্চলে হলে জৈববৈচিত্র্যের জন্য তা ভালো হয় না। ইউক্যালিপটাস পানি ও খনিজ লবণ শোষণ ছাড়াও মাটির গভীর থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে ডালে জমা রাখে। ফলে যে স্থানে এই গাছ থাকে, সেই স্থান হয়ে পড়ে পানিশূন্য ও অনুর্বর। এতে ওই অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অন্য প্রজাতির গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
নাটোর জেলা বন কর্মকর্তা সত্যেন্দ্র নাথ সাহা সাময়িকীকে জানান, ‘মূলত আশির দশকে সরকারিভাবে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও পাইনের মতো বিদেশী গাছগুলো বাংলাদেশে আনা হয় এবং বিনামূল্যে বিতরণও করা হয় নানা প্রজেক্টের আওতায়। পরে ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
এরপর বনবিভাগ’এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। নাটোরে সামাজিক বনায়নে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপন করা বা পরামর্শ দেওয়া হয় না। যদি কেউ ইউক্যালিপটাস গাছ রোপন করতে চায় তাহলে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি রোপন করে সে বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা মন্ত্রণালয়ের নেই।’
রাজশাহী বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান সাময়িকীকে জানান, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর সবসময়ই ইউক্যালিপটাস গাছটির বিরোধিতা করছে। লোকাল ভ্যারাইটিকে ক্ষতির মুখে ফেলে এই গাছটি। তাই আমরা সবসময় এর বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছি।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নার্সারিতে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। এটি আমাদের ইকো সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর। তবে যেহেতু কোনো আইন নেই বা বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি তাই এর বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই।’
রাজশাহী সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো, আব্দুর রহমান সাময়িকীকে জানান, ‘যেখানে একসঙ্গে সব ধরণের ছোট-বড় গাছ, ফসল এবং জলাশয় রয়েছে সেই পরিবেশে ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয়।’
সুন্দর পৃথিবীকে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য রাখতে গাছের কোনো বিকল্প নেই। গাছ মানুষের বন্ধু ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপকরণ। কিন্তু সব গাছ মানুষের জন্য উপকারী কিংবা পরিবেশবান্ধব নয়। মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে রাক্ষুসি গাছ ইউক্যালিপটাস।
তাই সময় এসেছে আসুন আমরা সবাইমিলে ইউক্যালিপটাসের মত রাক্ষসী গাছ পরিহার করে দেশীয় প্রজাতির গাছ বেশি বেশি করে রোপন করি এবং চলনবিলের জীব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করি।