নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
8 মিনিটে পড়ুন

নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি

নাটোরে জেলায় প্রায় সব জায়গাতে, কম বেশি পলাশ গাছ অতিতে দেখা গেলেও, এখন খুব কম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এক সময়ের সকলের চিরচেনা পলাশ গাছ ও পলাশ ফুল এখন আর আগের মত চোখে পড়েনা। শুধু নাটোর শহরে নয় জেলার কোথাও এখন পলাশ গাছ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু এক সময়ে নাটোরের বন জঙ্গলের দিকে তাকালেই দেখা মিলত চির অতিপরিচিত পলাশ ফুলের গাছ। তাই পলাশকে বলা হত বনের অগ্নিশিখা। এই অগ্নিশিখা হারিয়ে য়াওয়ার কারণ ইট ভাটায় এর কাঠ ব্যবহার। নতুন করে গাছ লাগানোর উদ্যোগ না নেওয়া, পুরনো গাছ সংরক্ষণ ও পরিচর্যা না করায় এ গাছ এখন হারানোর পথে।

নাটোরের রণীভবানীর রাজবাড়ি, উত্তরা গণভবন, চৈকিরপাড়, বঙ্গোজ্জলের বাগানবাড়ি সহ বেশকিছু স্থানে দেখা গেল কয়েটি পলাশ গাছ অযত্ন আর অবহেলায়, কালের সক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

জানা যায়, পলাশ বসন্তের প্রতীক। রঙভরা বসন্তে পলাশের বিশাল দখলদারিত্ব। পলাশ ফুটলেই বোঝা যায় ফাগুনে বনে আগুন লেগেছে। টিয়া পাখির ঠোঁটের সঙ্গে পলাশ ফুলের দারুণ মিল। সে জন্যই বুঝি পলাশ গাছে টিয়ার মেলা। আর একই কারণে পলাশের প্রচলিত ইংরেজি নাম ‘প্যারোট ট্রি’।

- বিজ্ঞাপন -

আবার পলাশ দেখতে অনেকটা বক ফুলের মতো। সবকিছু মিলিয়ে পলাশ ফুল অসাধারণ। কিন্তু ফুলে নেই গন্ধ! বাংলা সাহিত্যে পলাশ ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে নানাভাবে। বিশ্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পলাশকে দেখে লিখেছিলেন, “রাঙ্গা হাসি রাশি-রাশি অশোকে পলাশে, রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল।”

নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি
নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি 40

কবি নজরুল ইসলাম তাঁর একটি গানে লিখেছেন হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে এনে দে নইলে, বাঁধব না, বাঁধব না চুল.. এছাড়াও আমাদের দেশের জনপ্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গানে এর উল্লেখ পাওয়া যায়- ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটি পলাশ ফুলের মালা…’

আরো শুনতে পাই “পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে; এসেছে ফাগুন মাস…”। পলাশ ফুলের নাম জানেনা এমন লোক খুবই আছে, ফুল ফোটে বসন্তে। সারাগাছ ফুলেফুলে ভরে ওঠে।লম্বা মঞ্জুরীতে ঘনবদ্ধ থাকে। বীজ থেকে সহজেই চারা জন্মায়। বাড়েও দ্রুত।

নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি
নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি 41

মূলত বসন্তের শেষে গাছগুলি যখন তাদের পাতা হারিয়ে দৃষ্টিকটুতায় আক্রান্ত হয়, তখনই প্রকৃতি তার আপন লীলায় মত্ত হয়ে, দৃষ্টিকটু গাছে উজ্জ্বল টকটকে লাল বা গাড় কমলা ছাড়াও হলুদ ও লালচে কমলা রঙের পলাশ ফুল ফুটিয়ে পলাশ গাছের আদর বাড়িয়ে দেয়। পাতাহীন গাছের প্রায় লেংটো ডালের যত্রতত্র ফুটতে দেখা যায় পলাশকে।

ফুল ৭.৫-১০ সে. মি. শিম ফুলের মত, লম্বা মঞ্জুরীতে ঘনবদ্ধ থাকে। বৃক্ষটি Fabaceae পরিবারের সদস্য। তবে পলাশ গাছ তার ফুলের জন্যই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। পলাশ গাছ সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। শীতে গাছের পাতা ঝরে যায়। এর বাকল ধূসর। শাখা-প্রশাখা ও কাণ্ড আঁকাবাঁকা।

- বিজ্ঞাপন -

নতুন পাতা রেশমের মতো সূক্ষ্ম। গাঢ় সবুজ পাতা ত্রিপত্রী, দেখতে অনেকটা মান্দার গাছের পাতার মতো হলেও আকারে বড়। পলাশের ফল দেখতে অনেকটা শিমের মত। পলাশ মাঝারি আকারের পর্ণমোচী বৃক্ষ। পলাশের আরেক নাম “কিংশুক”। ইংরেজী নাম Flame of the Forest, বৈজ্ঞানিক নামঃ Butea monosperma বুটিয়া মনোস্পার্মা।

নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি
নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি 42

পলাশের আরো কিছু প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়, যেমন Butea frondosa, Erythrina monosperma, Plaso monosperma এরকমই আরেক প্রকার পলাশ যার বাংলা নাম “রুদ্রপলাশ”। এটা আমাদের পরিচিত পলাশ ফুল থেকে একটু ভিন্ন।

নাটোরের কেন্দ্রেয় মন্দিরের পুরহিত নিদু চক্রবত্তী সাময়িকীকে জানান, ‘পলাশের গাঁড় সবুজ ত্রিপত্রী দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক। পূজনীয় এই পলাশ ফুল দিয়ে, বিদ্যার দেবী স্বরসতী দেবীর পূজা করা হয় । বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ মনে করেন পলাশ গাছের নিচে ভগবান গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। সংস্কৃতিতে পলাশ হচ্ছে কিংশুক।

- বিজ্ঞাপন -

বাংলা ও হিন্দি নাম পলাশ হলেও মণিপুরি ভাষায় পলাশ হচ্ছে পাঙ গোঙ। নাটোরে আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে পলাশ ফুলের গাছ। দিনের পর দিন এই ভাবে পলাশ ফুলের গাছ একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনিভাবে সরকারি উদ্দ্যোগ নেওয়ার দরকার’ বলে তিনি মনে করেন।

চমৎকার এই ফুলটি সম্পর্কে সচেতন বৃক্ষ প্রেমিক ও গনমাধ্যম কর্মী দেবাশীষ কুমার সরকার সাময়িকীকে জানান, ‘পলাশের বিচি থেকে দেশীয় ভেজ্যষ ঔষধ তৈরি করা হয়। একসময় পলাশ গাছের শিকড় দিয়ে মজবুত দড়ি তৈরি করা হতো। সেই সাথে পলাশের পাতা দিয়ে তৈরি হতো থালা।

আজও কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে পলাশ পাতার ছোট্ট বাটিতে ফুচকা বা পানিপুরি বিক্রি করা হয়। আমরা বর্তমান নাটোরের মানুষেরা অনেকটা প্রকৃতি সচেতন না। সৌন্দর্য্যপ্রিয় না, নাটোরের যারা সৌন্দর্য্যপ্রিয় ছিল তাদের মধ্যে অনেক ব্যবসা বা চকুরির জন্য নাটোর জেলার বাহিরে থাকে।

নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি
নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি 43

আবার অনেকে ইহলোক ত্যাগ করেছে। বর্তমান নাটোরে বহিরাগতদের পরিমান বেড়েছে। তারা বেশির ভাগই সৌখিন ও সৌন্দর্য্যপ্রিয় না। প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, প্রকৃতির সাথে যারা সম্পৃক্ত, তাদের প্রকৃতি নিয়ে ভাবারই হয়তো সময় হয়ে উঠছে না বলে তার মনে হচ্ছে।

যে গাছ গুলো কমে যাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে সেই গাছ গুলো হর্টিকালচার সেন্টারে উদ্যোগে ব্যাপক পরিমানে চারা উৎপাদন ও রোপন করার নিয়ম আছে বলে তার মনে হয়। সরকারিভাবে হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

পৌর এলাকার রাস্তার ধারে পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে পলাশ ফুলের গাছ রোপন করতে পারে তাতে করে শহরের সৌন্দর্য্য যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনিভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বিরল ভূমিকা রাখবে’ বলে তার মনে হয়।

নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সাদি ইসমাইল হোসেন সাময়িকীকে জানান, ‘বর্তমানে নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ বিরল প্রজাতি হিসেবে পরিণত হয়েছে। পলাশ ফুলের সাথে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সম্পৃক্ততা রয়েছে।

ফেব্রুয়ারী মাসে সাধারনত এই ফুল ফোটে। রক্ত পলাশের সাথে আমাদের ভাষা সৈনিকদের রক্তের মিল খুজে পায় কবি, সাহিত্যিক ও প্রকৃতি প্রেমিকেরা। নাটোরে পলাশ ফুলের গাছ ভৌগলিক আবহাওয়াগত ব্যাপারে কমে যেতে পারে, আর গাছগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষন শুধু ,ফুল যখন ফোটে তখন-

বাঁকি সময়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ইট ভাটাতে বেশি ব্যবহার করা হয়। যেহেতু এটা ফলজ বৃক্ষ না তাই নির্দীধায় এই গাছ নিধন করা হয়। নতুন করে রোপন করা হয় না। মূলত এইগুলোর কারনে নাটোরে কমছে পলাশ ফুলের গাছ।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য গাছ রোপন করা হচ্ছে না , মানুষ বানিজ্যিক দিকে ঝুকে পড়েছে। সরকারি ভাবে যেগুলো করার উদ্যোগ নেয় সাধারনত বায়োলজিক্যাল দিক থাকে যেমন নিম গাছ বায়োলজিক্যাল একটা দিক আছে তাই সরকারিভাবে নিমগাছকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

তবে হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যোগে চারা উৎপাদন করা দরকার এবং প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পলাশ ফুলের গাছ থাকা উচিৎ। আমি একজন বোটানিষ্ট হিসেবে মনে করি পলাশ গাছ সম্পূর্ন রুপে হারিয়ে যাওয়ার আগে সংরক্ষন ও ব্যপকভাবে রোপন করা দরকার এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানিয়ে রাখা ভালো।’

হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর ফিরোজ সাময়িকীকে জানান, ‘প্রায় ৬৬ বিঘা জমির উপর নির্মিত নাটোরের হর্টিকালচার সেন্টার। এই এরিয়াতে কোন পলাশ ফুলের গাছ নেই, তবে শিগগিরই চারা উৎপাদন করে হর্টিকালচারের ভেতরে রোপন এবং বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ঔষধি গুন সমৃদ্ধ, সৌন্দর্যবর্ধন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন এবং পূজনীয় এই ফুলের গাছ, নাটোর থেকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাওয়ার আগেই নতুন করে পলাশ ফুলের গাছ লাগিয়ে এ গাছের প্রজাতি রক্ষা এবং বন জঙ্গলসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটে থাকা গাছ গুলি সংরক্ষণের দাবি নাটেরের পরিবেশবাদীদের।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!