চলনবিলে হাঁস পালনের সব থেকে বড় সুবিধা বিলে পানি থাকা অবধি প্রায় ছয় মাস হাঁসের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় শামুক, ঝিনুকসহ জলে বাস করা নানান প্রাণী। এতে হাঁস পালনে খরচ কমে। বাড়ে লাভের পরিমাণ।
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে চলনবিলে ছোট বড় প্রায় ৪৫১টি খামার রয়েছে। এর মধ্যে রাজহাঁসের খামার অর্ধেক। হাঁস পালনকারীরা পাতিহাঁস এবং রাজহাঁস উভয় প্রকারের হাঁস পালন করে মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ করেন।
এসব খামারে হাঁস আছে দেড় লাখেরও বেশি। আবার স্থানীয় পরিবারগুলোও হাঁস পালন করছেন প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ। এতে বেকারত্ব কমার পাশাপাশি বেড়েছে আয়। পূরণ হচ্ছে স্থানীয়দের আমিষের চাহিদা। সমৃদ্ধ হচ্ছে নাটোরের অর্থনীতি।
বিলে উচ্ছিষ্ট বোরো ধান ও শামুক হাঁসের প্রধান খাদ্য এবং অল্প টাকা বিনিয়োগে ব্যবসা সফল হওয়ায় বর্তমানে পুরুষরাই বিকল্প পেশা ও বেকারত্ব দূর করার জন্য অস্থায়ী খামার গড়ে হাঁস পালনের দিকে ঝুঁকছে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১০ নং চৌগ্রাম ইউনিয়নের গোয়াল বাড়িয়া গ্রামের জমশেদ আলী। হাঁস পালন করে সংসার চালিয়ে কিনেছেন ৮ বিঘা জমি। দুই সন্তানের জনক এই জমশেদ আলী, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।একমাত্র সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় করেছেন শিক্ষিত। প্রায় ২০ বছর যাবৎ তিনি এই হাঁস পালন করেন চলনবিলের পথে-প্রান্তরে।
জমশেদ আলী সাময়িকীকে জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে ১০ দিনের হাঁসের বাচ্চা কিনে এনে ৯০ দিন লালন পালন করে, বিক্রি করে দেন। প্রতি চালানে খরচ বাদে প্রায় ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা লাভ থাকে। খাদ্য বাবদ তেমন কোন খরচ হয় না বললেই চলে, তবে অসুখ হলে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে ওষুধ কিনে খাওয়াতে হয়।
খামারি আমজাদ হোসেন সাময়িকীকে জানান, তিনি ৩০০টি হাঁস পালন করেন। সকালে হাঁসগুলো বিলে চলে যায়। সারাদিন শামুক-ঝিনুক খায়। তিনি নিজেও কিছু খাবার দেন। পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি হাঁস বিক্রি করে আয় করছেন তিনি।
চলনবিলের আরেক খামারি শমশের উদ্দিন সাময়িকীকে জানান, সারা বছরই হাঁস পালন করেন তিনি। এখন তার খামারে ক্যাম্বেল জাতের ৬০০টি হাঁস রয়েছে।তিনি ৪ থেকে ৫ মাস বয়সী হাঁস কেনেন। সাড়ে ৫ মাস বয়স থেকে ডিম দেওয়া শুরু করে। এখন তার খামারের ৫০০টি হাঁস ডিম দিচ্ছে। বছরে খরচ বাদে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা লাভ থাকে তার।
তিনি আরও বলেন, একটি হাঁস গড়ে বছরে ৩০০টি ডিম দেয়। ৩ বছর পর ডিম দেওয়া কমতে থাকে। তখন মাংসের জন্য হাঁসগুলো বিক্রি করেন। বর্তমানে প্রতিটি ডিম ১১ থেকে ১২ টাকা ও প্রতিটি হাঁস গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
খামারি শ্রমিক মো. জামাল উদ্দিন সাময়িকীকে জানান, সকাল ৭টায় হাঁস ছাড়ি। তারপর ডিমগুলো তুলা হয়। ৩০০ থেকে ৩৫০টি ডিম হচ্ছে। এখন বিলের খাবার না পাওয়াতে আয়ের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। হাঁসের খাবার বেশি দিতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে গেছে।
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলছেন, জেলার প্রতিটি খামারেই অন্তত ৩ থেকে ৪ জন কাজ করছে। খামারগুলোতে প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার হাঁস পালন করা হচ্ছে। বিলে পানি বেশি থাকলে খরচ তেমন হয় না। পানি না থাকলে খরচ সামান্য বাড়ে। বছরে প্রতি খামারির কমপক্ষে লক্ষাধিক টাকা আয় হয়।
তিনি আরও বলেন, নাটোর জেলায় হাঁস পালন করছে আরও ৩০ থেকে ৪০ হাজার পরিবার। সেখানেও প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ হাঁস আছে। প্রতিটি পরিবার বছরে আয় করছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। এ খাতে আরও মানুষকে সংযুক্ত করার কাজ করে যাচ্ছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
নাটোরের চলন বিলের এই সমস্ত ক্ষুদ্র খামারিরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে, এ ধরনের আরো খামার গড়ে উঠলে, একদিকে যেমন এই অঞ্চলের আরো কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে নাটোরের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছেন নাটোরের সচেতন মহল।