নাটোরে গত আট বছরে উর্বর ফসলি জমি কমেছে প্রায় ৬৪ হাজার বিঘা। বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে বিল-ঝিল, ফসলি জমি। এমনকি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ঘরবাড়িও তলিয়ে যাচ্ছে আকস্মিক বন্যায়। ফলে শস্য ভাণ্ডারখ্যাত নাটোরের কৃষিজমি রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনেই এর প্রভাব পড়তে পারে মনে করছেন কৃষিবিদরা।
সড়ক-মহাসড়কের পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যক্তিগত সড়ক, ইন্ডাস্ট্রিজ, বৃহৎ গোডাউনসহ বসতবাড়ি। ফলে আবাদি জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বিঘ্ন ঘটছে আবাদি জমির। সময় মতন ফসল রোপন না করতে পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক।
অপরদিকে অপরিকল্পিতভাবে তিন থেকে চার ফসলি জমিতে খনন করা হয়েছে পুকুর। নির্মাণ করা হচ্ছে ইটভাটা, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিজ ও বসতবাড়ি। নাটোরের সচেতন মহল বলছেন ফসলি জমি রক্ষায় তেমনভাবে ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না প্রশাসনের।
প্রশাসন বলছেন- নাটোরের ফসলি জমি রক্ষায় সক্রিয় রয়েছেন তারা। অপ্রয়োজনে কেউ যদি ফসলি জমি বিনষ্ট করে অথবা পুকুর খনন করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর মিল, ইন্ডাস্ট্রিজ, বসতবাড়ির বিষয় বিবেচনা করা হবে।
নাটোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মাহমুদুল ফারুক সাময়িকীকে জানান, ‘নাটোর জেলায় ২০১২ খ্রিস্টাব্দে মোট আবাদি জমি ছিল এক লাখ ৫৪ হাজার ৯৬১ হেক্টর। ২০২০ খ্রিস্টাব্দে তা কমে এক লাখ ৪৬ হাজার ৫২৪ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এসব আবাদি জমির বেশির অধিকাংশেই পুকুর খনন করা হয়েছে।’
সাময়িক বেশি লাভের আশায় কৃষকরা ফসল উৎপাদন না করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কিন্তু যেসব জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে তা আর কখনোই আবাদি জমিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কেননা, মাটিগুলো পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে।
২০১৯ সালে ঢাকার ল’ ইয়ারস সোসাইটি ফর ল’ নামের মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে এর মহাসচিব মেজবাউল ইসলাম আতিক নাটোরের পাঁচ উপজেলা— নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, সিংড়া, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুরে আবাদি জমিতে জনস্বার্থে পুকুর খনন বন্ধে আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেছিলেন।
শুনানি শেষে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মাদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই বছরের ১২ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, নাটোরের জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট পাঁচটি উপজেলায় কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে তদারকি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। তবু বন্ধ হয়নি আবাদি জমিতে পুকুর খনন।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার কাকফো গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন সাময়িকীকে জানান, তিনি প্রায় ২০ বিঘা জমিতে নানা ফসল আবাদ করেন। ফসল উৎপাদন করে তার উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে তেমন লাভ হয় না। সে জন্য তিনি তার জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করতে চান।
আবাদি জমিতে পুকুর খননের বিধিনিষেধ থাকায় নিজে ব্যর্থ হয়ে এখন তিনি ভাটা মালিকদের দারস্থ হয়েছেন। ভাটা মালিকরা মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে এবং পুকুর খনন করে পাড় বেঁধে দিয়ে যাচ্ছে। মাটির কোনো দাম তারা দিচ্ছেন না। তবুও তিনি খুশি।
নাটোর সদর উপজেলার বড় হরিশপুর ইউনিয়নের গাজীর বিল এলাকার কৃষক মোঃ আব্দুর কাদের জানান, ‘গাজির বিলের বুক চিরে এই মহাসড়ক। আর এই মহাসড়কের দুই পাশেই রয়েছে সরকারি জলাশয়। এই জলাশয় দিয়েই সম্পূর্ণ বিলের পানি নিষ্কাশিত হত।
আর খরা মৌসুমে এই জলাশয়ের পানি দিয়েই কৃষি আবাদ করা হতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবৎ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই জলাশয় দখল করে ভরাট করে চলেছে। গড়ে তুলছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর সময় মত বিলের পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায, ফসল উৎপাদনে আমরা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি।’
রাজশাহীর বরেন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃষিবিদ সৈয়দা বদরুন নেসা সাময়িকীকে জানান, ‘নাটোর-রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমিতে বছরে তিন থেকে চারটি করে ফসল উৎপাদন করেন। এমন উর্বরা জমি দেশের খুব কম অঞ্চলে আছে।
যত্রতত্র অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে একদিকে যেমন আবাদি জমি ভয়ানক হারে কমে যাচ্ছে অন্যদিকে পুকুরগুলোতে খরা মৌসুমে পানি সংকট দেখা দেওয়ায় চাষিরা ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির ওপরও মারাত্মক চাপ পড়ছে এবং মাছ চাষের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা লোকসানে পড়ছেন।
যেসব আবাদি জমির মাটি ভাটায় ব্যবহার করে ইট তৈরি হচ্ছে তাতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এসব পুকুর আর কোনো দিন ফসলি জমিতে রূপান্তর সম্ভব নয়। জমিতে বাগান করলে তা পুনরায় ফসলি জমিতে ফেরানো যায়। পুকুর করলে তা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, নাটোর অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমিতে মুগ, ভুট্টা, ধান, রসুন, আখ, ড্রাগন, পেয়ারা থেকে শুরু করে সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদনে দেশের প্রথম সারির জেলা। এখানকার কৃষকরা চলনবিলেও তিনটি ফসল ফলায়। যদিও চলনবিলের জমিগুলো বছরের ছয় মাস পানির নিচে ডুবে থাকে।
চলনবিলে কৃষকরা রোপা আমন ধান কেটে সেই জমিতে বিনা চাষে রসুন উৎপাদন করে। রসুনের জমিতেই আবার তরমুজ, বাঙ্গি, ক্ষিরা রোপন করে। বছরের বাকি ছয় মাস কৃষকরা চলনবিলে মাছ শিকার করে অর্থ উপার্জন করেন।’
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম সাময়িকীকে জানান, ‘তিন-চার ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এক ফসলি বা অনাবাদি জমিতে পুকুর করে মাছ চাষের বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ এবং তিন-চার ফসলি জমিতে পুকুর খননে নিরুৎসাহিত করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়ে আসছে মৎস্য বিভাগ।
তিনি আরও বলেন, ‘মাছ যেমন দরকার একইভাবে ফসল উৎপাদনও দরকার। নাটোর জেলায় গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০-১১ মৌসুমে যেখানে জেলায় মোট মাছের উৎপাদন ছিল ৪০ হাজার মেট্রিক টন বর্তমানে ২০২০-২১ মৌসুমে তা বেড়ে ৬৪ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।’
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ সাময়িকীকে জানান, ‘নাটোরের ফসলি জমি রক্ষায় সক্রিয় রয়েছেন প্রশাসন। অপ্রয়োজনে কেউ যদি ফসলি জমি বিনষ্ট করে অথবা পুকুর খনন করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর মিল, ইন্ডাস্ট্রিজ, বসতবাড়ির বিষয় বিবেচনা করা হবে।’