পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য বালিশের ডাবল কাভারসহ এক লাখ বিছানার চাদর আনা হচ্ছে জার্মানি থেকে। স্থানীয় ঠিকাদারের সরবরাহ করতে যাওয়া এসব পণ্যের মান পরীক্ষা করতে জার্মানি যাওয়ার অনুমতি নিয়েছেন পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ।
অবশ্য এই ধরনের পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হয় এবং এখন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। জার্মানিতেও এসব পণ্যের বড় বাজার আছে।
জার্মানির যে প্রতিষ্ঠান থেকে এসব আনা হবে তার গ্রহণযোগ্যতা ও মান যাচাই করতে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের জার্মানি যাওয়ার কথা রয়েছে এই মাসেই। তার সঙ্গে আরও যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খালিফা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি ও আইজিপির স্টাফ অফিসার মোহাম্মদ মাসুদ আলম।
ওই চাদর ও বালিশের কাভার শিপমেন্টের আগেই তারা মান পরীক্ষা করবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবুল আলম মজুমদারের সই করা চিঠিতে এই তথ্য জানা গেছে।
তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তাদের যাওয়ার জন্য আমি আদিষ্ট হয়ে চিঠি দিয়েছি। সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। তারা ভিসা পেয়েছেন কী না, যাবেন কী না, সেই তথ্য আমার কাছে নাই৷”
জার্মানিতে মোট নয় দিন অবস্থান করার কথা রয়েছে তাদের। ফেব্রুয়ারি মসের মধ্যেই সুবিধাজনক সময়ে তারা যাবেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিবকে নোট ভারবাল (এক দেশকে আরেক দেশের আনুষ্ঠানিক পত্র) ইস্যু করার জন্য চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সরকারের আরও সাত প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে অবগতি ও সহায়তার জন্য। চিঠিতে বলা হয়েছে, পুলিশের প্রধানসহ তিন জনের জার্মানি সফরের খরচ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বহন করবে।
জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর এই বিছানার চাদর ও বালিশের ডাবল কাভার সরবরাহের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কম্বল, অ্যাপুলেট, হ্যান্ড গ্লোভস, ডাবল পিলো কাভারসহ বেডশিট, সিঙ্গেল পিলো কাভারসহ বেডশিট, বডি ব্যাগ, কটন ভেস্টসহ ২১ ধরনের আইটেম সরবরাহের জন্য এই দরপত্র আহ্বান করা হয়। তারমধ্যে বালিশের ডাবল কাভারসহ বিছানার চাদর একটি আইটেম।
৭ অক্টোবর সরকারে ই-প্রকিউর ওয়েবসাইটেও দরপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে এই দরপত্র আহ্বান ও মালামাল গ্রহণের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আতাউল কিবরিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর ২৮ এপ্রিলের মধ্যে বালিশের ডাবল কাভারসহ বিছানার চাদর সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আইজি বেনজীর আহমেদকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েও জবাব মেলেনি।
ফলে এই বিছানার চাদর সরবরাহের দায়িত্ব বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, জার্মানির কোন প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশ থেকে নেওয়া চাদর ও বালিশের কাভার আবার বাংলাদেশেই রপ্তানি করছে কী না এবং তিনজনকে জার্মানিতে নিয়ে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের যে টাকা খরচ হবে তারা তা কীভাবে মেটাবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তা জানা সম্ভব হয়নি। আমদানি করতে কত টাকা খরচ হচ্ছে তাও জানা যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া এন্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলি খান বলেন, “আমি এটার সঙ্গে কোনো ভাবেই সম্পৃক্ত নই৷ তাই কিছু বলতে পারব না।”
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আতাউল কিবরিয়াকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। তিনি এই দরপত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য কথা হয়েছে এই সফরের জন্য মনোনীত আইজিপিসহ তিনজনের একজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফার সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আমি জার্মানি যাওয়ার ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। সেখানে আমার কাজ কী সে সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা নেই। একটি চিঠি পেয়েছি এই পর্যন্ত। আমি এখনো ভিসার জন্য আবেদন করিনি। যাবো কী না তাও এখনো বলতে পারছি না।”
বিছানার চাদর এবং বালিশের কাভার জার্মানি থেকে আনতে হবে কেন? বাংলাদেশে কি এগুলো পাওয়া যায় না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত নই৷ আমি কীভাবে বলব?”
একই প্রশ্নের জবাবে চিঠিতে স্বাক্ষরকারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবুল আলম মজুমদার বলেন, “আমি তো আদিষ্ট হয়ে স্বাক্ষর করেছি। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তো আমি বলতে পারব না। সিদ্ধান্ত হয় অনেক উপরে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ওমেগা স্টাইল লিমিটেডের এমডি আমিরুল ইসলাম জানান, “বিছানার চাদর, বালিশের কাভার এগুলোকে বলে হোম টেক্সটাইল। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ অনেক এগোলেও বাংলাদেশে ভালো মানের হোম টেক্সটাইল তৈরি করে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান। কারণ এর খরচ পোশাক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি। এর ফেব্রিক ও রঙের বিশেষত্ব আছে।”
তিনি আরও বলেন, “ওয়ালমার্টসহ আরও বড় বড় ক্রেতারা এখান থেকে হোম টেক্সটাইল নেয়। জাবের এন্ড জুবায়ের, পলমল গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হোম টেক্সটাইলে সারা দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে দেশের চাহিদা মেটাতে বাইরে থেকেও আমদানি করা হয়।”
পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, “বাংলাদেশের বাজারে বিছানার চাদরের সমস্যা হচ্ছে রঙ ঠিকমত হয় না। পুলিশের চাদর এবং বালিশের কাভারে একটি বিশেষ রঙ আছে। এ কারণেই জার্মানি থেকে আনা হচ্ছে।”
জাবের এন্ড জুবায়ের-এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদ মোশাররফ জানান, “আমরা ১৩ বছর ধরে হোম টেক্সটাইল তৈরি করছি। আমরা বছরে এখন ২০০ মিলিয়ন ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করি অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ইউরোপের জার্মানিসহ সব দেশেই আমাদের হোম টেক্সটাইল যায়। আরও পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে যারা আমাদের মত শতভাগ রপ্তানি করে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের লাইসেন্স শতভাগ রপ্তানির জন্য। আবার দেশের বাজারে বিক্রির জন্যও লাইসেন্স নেওয়া হোম টেক্সটাইলের প্রতিষ্ঠান আছে। এরকম লোকাল প্রডাক্ট-এর জন্য চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা দেশের জন্য ভালো মানের হোম টেক্সটাইল উৎপাদন করে।”
তিনি বলেন, “আমাদেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসমাইল আঞ্জুমানারা টেক্সটাইল, ক্লাসিক্যাল হোম টেক্সট এরকম। আবার যারা রপ্তানির জন্য তৈরি করে তাদের আলাদা লোকাল প্রোডাক্ট-এর ইউনিটও আছে। তাই তারা স্থানীয় বাজারের জন্য চাহিদা অনুযায়ী কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে পারে। প্রতিবছর পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রচুর বিছানার চাদর, বালিশের কাভার লাগে। এগুলো তারাই সরবরাহ করে। কয়েক লাখ পিস তারা একসঙ্গে সরবরাহ করতে পারে। রঙ নিয়েও কোনো সমস্যা নেই।”
তিনি বলেন, “জার্মানি খুব সামান্যই হোম টেক্সটাইল উৎপাদন করে।” তাহলে পুলিশ কি এবার বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে রপ্তানি করা বিছানার চাদর, বালিশের কাভার আবার সেখান থেকেই কিনে বাংলাদেশে আনছে? এর জবাবে তিনি বলেন, “পুলিশ জার্মানি থেকে বিছানার চাদর বা বালিশের কাভার কিনে আনছে কী না আমার জানা নাই। তবে আগে দেশের ভিতর থেকেই কিনত। আর জার্মানির প্রডাক্ট হয়ে থাকলে তার দাম তো অনেক বেশি হবে।”