বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ। বহুল আলোচিত এ চুরির ঘটনায় দেশি-বিদেশি অপরাধীদের শনাক্ত করা গেলেও এখনো অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
কারণ হিসেবে তদন্তকারী সংস্থাটি বলছে, একই অপরাধে মার্কিন আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এই মামলা শেষ হওয়ার আগে দেশের মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করলে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হতে পারে। আর এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে আরো অপেক্ষা করতে হচ্ছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলংকায়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের ঠাঁই হয় ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। পাওয়া যায়নি বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার।
ওই বছরের ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পেয়ে কাজ শুরু করে সিআইডি। পরবর্তী সময়ে আলামত ও ফরেনসিক পরীক্ষায় পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে চুরির সঙ্গে দুই ডজন বিদেশির সম্পৃক্ততা পায় সংস্থাটি। রিজার্ভের অর্থ চুরির সঙ্গে বিদেশি অপরাধীদের পাশাপাশি দেশি অপরাধীদেরও যোগসাজশের তথ্য উঠে আসে তদন্তে। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ১২০ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রাথমিক আলামত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা খুঁজে পান তদন্তসংশ্লিষ্টরা। ওই সব কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করে সংস্থাটি। তবে এ আট কর্মকর্তার মধ্যে একজন এরই মধ্যে অবসরে গেছেন। বাকি আরও কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায়।
অন্যদিকে সন্দেহভাজন বিদেশীদের স্থায়ী ঠিকানা চেয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ অপরাধীদের তথ্য সরবরাহ করলেও চীন, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার কাছ থেকে ওই তিন দেশের অপরাধীদের তথ্য পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি চুরির প্রক্রিয়ায় পাঁচ বিদেশি প্রতিষ্ঠানেরও সম্পৃক্ততা মিলেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যেকোনো মামলার অভিযোগপত্র দিতে হলে অভিযুক্তের যাচাইকৃত পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। সে নিয়ম মেনে কয়েকটি দেশের কাছে অপরাধীদের যাচাইকৃত পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা চাওয়া হয়। কিন্তু চীন, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকা এর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নিজ নিজ নাগরিকদের তথ্য সরবরাহ করেনি। আর বিদেশি অপরাধীদের যাচাইকৃত তথ্য ছাড়া পূর্ণাঙ্গ এবং মানসম্পন্ন অভিযোগপত্র দেয়া অসম্ভব।
রিজার্ভ থেকে চুরির অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য শুরুর দিকে ফিলিপাইন ব্যাপক সহায়তা করছিল। দেশটির বিভিন্ন সংস্থা তখন বাংলাদেশের পক্ষে ১২টি মামলা করে। তবে দেশটির সরকার পরিবর্তনের পর সেই তৎপরতায় ভাটা পড়ে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে তৃতীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করে নিয়োগকৃত ল ফার্ম কোজেন ও’কনর। তবে ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত জানিয়ে দেয়, মামলাটি তাদের আদালতের এখতিয়ারাধীন নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বাংলাদেশেও কারও বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। আর চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।’
দেশে চলমান মামলাটির তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবীরের বলেন, রিজার্ভ চুরির মামলাটিতে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও হংকং এই আট দেশের নাগরীকের সম্পৃক্ততা তথ্য তদন্তে উঠে এসেছে।