ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কেয়াবন ও প্রবাল থেকে শুরু করে সর্বত্রই যত্রতত্র বর্জ্যের কারণে দূষিত হচ্ছে দ্বীপ। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা।
প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে ভ্রমণে এ দ্বীপে আসেন হাজারো পর্যটক। পর্যটকদের কারণে দ্বীপের পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সৌন্দর্য রক্ষার্থে বিধি-নিষেধ আরোপ করে নানামুখী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য কাজ করছেন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।
কিন্তু, আইন আছে যেন প্রয়োগ নেই। পুরো দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকজাত খাবারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, বোতল, পানির বোতল, ডাবের খোসা, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য।
এ ছাড়াও ছোটবড় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সঙ্গে যোগ হয় গৃহস্থালির বর্জ্য। আর এসব ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে চারপাশে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দ্বীপ নিয়ে কাজ করা সংস্থার কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে স্থানীয়রা।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি।
দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ।
ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল। একারণে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ-তে ৯টি পয়েন্টের নিষিদ্ধ কার্যক্রম রোধকল্পে) আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, দ্বীপে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা, পর্যটক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করা, ছেঁড়া-দ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করা, দ্বীপে স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, দ্বীপে নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করা, পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যতীত হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি বন্ধ করা, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, জীব-বৈচিত্র্য ও দ্বীপ রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করাসহ নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রশীদ আহমদ বলেন, “দ্বীপকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ডের কথা আমরা শুনি। কিন্তু, বাস্তবে কিছু দেখা যায় না। পুরো সেন্টমার্টিন জুড়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলোর বর্জ্য যাচ্ছে সরাসরি সাগরে। এ গুলো দেখার জন্য সেন্টমার্টিনে কেউ নেই।”
একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, “প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসেন। এসব পর্যটকরা কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য সৃষ্টি করে। যে পরিমাণ বর্জ্য বের হয় তা ধারণের ডাস্টবিন এই দ্বীপে নেই। মাঝেমধ্যে কিছু প্লাস্টিকের বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হলেও বছরের বেশির ভাগ সময় বর্জ্য ডাস্টবিনে খোলা আকাশের নিচে থেকে যায়। এসব গিয়ে মেশে সমুদ্রে।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ বলেন, “দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন বিপুল-সংখ্যক পর্যটক আসেন। এই দ্বীপে অবস্থিত শতাধিক হোটেল-মোটেলকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয় যেন তাদের ময়লা-আবর্জনাগুলো ডাস্টবিনে ফেলে। কিন্তু, কেউ কারও কথা শুনে না। কেউ কেউ সেই নির্দেশনা মানলেও দেখা যায় অনেকে উদাসীন। দ্বীপের সমস্ত বর্জ্য সংগ্রহ করে বড় ডাস্টবিনে রেখে সপ্তাহ দুয়েক পরপর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু, আমি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর এসব আর হয় না। ফলে দ্বীপের চারপাশ এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু সাইনবোর্ডে লাগানো হয়েছে। তারা পর্যটক এবং স্থানীয়দের স্বার্থে কিছুই করেন না। দ্বীপ এবং সৈকত পাড়ে রয়েছে ছোট্ট অগণিত দোকান। এসব দোকানীরা ডাব, পানীয় এবং খাদ্য জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে পর্যটন মৌসুমে ভাল ব্যবসা করেন। কিন্তু, সৈকত পাড়ের দোকানীরা বীচের আশে পাশে ময়লা আবর্জনা রেখে দেন। ডাবের কোষাসহ ময়লা-আবর্জনায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।”
সেন্টমার্টিনে দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী আব্দুল হামিদ জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলতে প্রতিনিয়ত সচেতনতামুলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু, ভ্রমণে আসা পর্যটকরা কোন কথা পাত্তা দেয় না। এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর একা কোনোভাবে দ্বীপ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ দ্বীপে দায়িত্বরত প্রশাসন কোনো ধরণের সহযোগিতা করেন না।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা প্রকৌশলী পারভিন আক্তার জানান, দ্বীপের সৌন্দর্য রক্ষার্থে ময়লা-আবর্জনা প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র রক্ষায় এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তা নাহলে দিনদিন দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং দূষিত হতে পারে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, “দ্বীপ রক্ষায় একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। কিন্তু, কোনোভাবে কাজে আসছে না। দ্বীপের চারদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।”
সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিভিন্ন দূষণের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, “অতিরিক্ত পর্যটক ভ্রমণে দ্বীপের নানা রকম বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে দ্বীপ। এজন্য অন্তত পর্যটন এলাকা গুলোতে পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট ব্যবহার বন্ধে সুপারিশ করা হয়েছে। পরিবেশ-বিরোধী এসব ময়লা-আবর্জনায় হারিয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ। নষ্ট হতে পারে দ্বীপের প্রকৃতি। এমনকি দূষণের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়েও যেতে পারে একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি।”
প্রসঙ্গ, গত ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকত এলাকাসহ দেশের ৬টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়া স্বত্বেও পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণ কাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে গত দেড়যুগে দ্বীপের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মানা হচ্ছেনা কোনটিই। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আইন লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল।
এ বিষয়ে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে বৃহস্পতিবার চার রিসোর্টকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণের দায়ে আটলান্টিক রিসোর্ট ও ড্রিমস প্যারাডাইস রিসোর্টকে এক লাখ টাকা করে, ফ্রেন্ডস রিসোর্টকে ৫০ হাজার ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে প্রিন্স হ্যাভেন রিসোর্টকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানের সময় সঙ্গে ছিলেন পুলিশের সদস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।