মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা সংকট দূরীকরণে খননকৃত মাটি অপসারণ ও অতিরিক্ত মাটি ফেলতে নদীর পার্শ্ববর্তী জমি অধিগ্রহণই একমাত্র পথ, এমনটাই মত দিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সুন্দরবন সুরক্ষায় মোংলা বন্দর কেন্দ্রীক পশুর নদীর নাব্যতা রক্ষায় ও এ এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় চলমান সংরক্ষন ড্রেজিং অব্যাহত রাখতে না পারলে আবারো মুখ থুবড়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। মাটি ফেলার জায়গা সংকটের কারণে প্রায় ৫/৬ বছর ধরে বিআইডব্লিউটি এর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ড্রেজিং অব্যাহত রাখতে পারছেন না। খননকৃত মাটি অপসারণের জন্য পৌরসভার রাস্তা ব্যবহার করেতে গেলেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ফারাক্কা বাঁধসহ ভারতীয় নদী আগ্রাসন, নদী ও খালে আশির দশক থেকে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিয়ে বাগদা চিংড়ি চাষ এবং তীব্র পলি পতনের কারণে বাগেরহাটের সকল নদী-খালের নাব্যতা সংকট সৃষ্টি হয়।
মোংলা ঘোষিয়াখালী চ্যানেলটিতে তীব্র পলি জমে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভাবে ভরাট হয়ে যায়। তেলবাহী ট্যাংকারসহ ভারী নৌযান সুন্দরবনের ৮৪ কি. মি. শ্যালা নদী দিয়ে যাতায়াত শুরু করে। এতে সুন্দরবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই দেশী বিদেশি পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হন। এর মধ্যেই গত ০৯-০১-২০১৪ তারিখ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যায় এবং ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীকূলের ব্যপক ক্ষতি হয়। এরপর সরকারি ভাবে মোংলা ঘোষিয়াখালী চ্যানেলটি খননের সিদ্ধান্ত নিলে বিআইডব্লিউটি এ নাব্যতা ফেরাতে গত ০১-০৭-২০১৪ তারিখ খনন শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী গত ২৭-১০-২০১৬ তারিখ ২৬ কি.মি. চ্যানেলটি উম্মুক্ত ঘোষণা করেন। সেই থেকে প্রতিদিন জোয়ারের সুবিধা নিয়ে গড়ে ১০০ টি বিভিন্ন ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করছে। খননের পর অদ্যাবধি ১ লক্ষ ৯৭ হাজারের বেশি ভ্যাসেল মালামাল নিয়ে চলাচল করেছে।
চ্যানেলটি থেকে এ পর্যন্ত ড্রেজার দ্বারা ৩৩৮.৯৭ লক্ষ ঘনমিটার পলি উত্তোলন করা হয়েছে। যার মধ্যে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়নমূলক খনন হয়েছে ১১৯.৬৮ লক্ষ ঘন মিটার এবং ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংরক্ষণ খনন হয়েছে ২১৯.২৯ লক্ষ ঘন মিটার, যা চলমান রয়েছে। চ্যানেলের বর্তমান গভীরতা ভাটার সময় ১৬ ফুট ও প্রশস্ত আড়াইশত থেকে ৩ শত ফুট। বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটের ৪ টি ড্রেজার সার্বক্ষণিক খনন কাজে নিয়োজিত রয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
চ্যানেলটি চালু করা হলেও এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বিমুখী ও রাত্রি কালীন নৌযান চলাচলের অনুমতি দিতে পারেনি। এছাড়াও নদীর প্রশস্ততা ও বাড়াতে পারেনি। নদী রক্ষার আন্দোলনের নেতা ও মোংলা ঘোষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন শেখ বলেন, চ্যানেলে সার্বক্ষণিক নৌযান চলাচল ও প্রশস্ততা বাড়ানোর দাবী উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটিকে রক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে পতিত জমি অধিগ্রহণ করতে হবে বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। চ্যানেল সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও এর দুইপাশের বিলগুলি সম্পুর্ণভাবে উম্মুক্ত রাখতে হবে যাতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা সম্ভব হয়।
এ বিষয়ে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বন্দর ব্যবহারকারী বিশেষজ্ঞ লায়ন ডক্টর শেখ ফরিদুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, সুন্দরবন রক্ষা, মোংলা বন্দর সচল ও এ এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে, নদীর দখল-দুষন বন্ধ করতে হবে। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, উন্নয়নের নামে বন্দরের আশপাশের নদী ও চ্যানেলের চরভরাটি জায়গা কাঁটাতার ও সাইনবোর্ড দিয়ে দখল করতে দেখা যাচ্ছে। এতে করে নদী সংকুচিত হচ্ছে। যে কারণে নদীর গতি ব্যহত হচ্ছে। নদী রক্ষায় নীতিমালা ও মহামান্য হাইকোর্ট এর রায় থাকার পরও মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ জন্য বাগেরহাট জেলা কালেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালান করতে পারেন। নদী-খাল ও জলাভূমি রক্ষা করতে না পারলে আমাদের কোন উন্নয়নের সুফল মিলবে না।
কথা হয় বিআইডব্লিউটিএ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আ. মতিন এর সাথে। তিনি জানান, এই নৌরুট সচল রাখতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। চ্যানেলে মোংলা বন্দর পয়েন্টের জয় পর্যন্ত ৫ কি.মি. এলাকায় মাটি ফেলার জায়গা নেই। সংরক্ষণ ড্রেজিং মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মাটি অপসারণেও নানান জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। মোংলা পৌরসভার রাস্তা ব্যবহারের কারণে রাস্তা নষ্ট হওয়ায় তারা ক্ষতিপূরণ দাবী করেছে। করোনার করণে ডাকের মাটি অপসারণে কিছুটা ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে জায়গা পাওয়া গেলে মাটি ডাম্পিং করে রাখা সম্ভব হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
মোংলা ঘোষিয়াখালী এ নৌ চ্যানেলটি সচল রাখতে হলে সংরক্ষণ ড্রেজিং অব্যাহত ও খননকৃত মাটি অপসারণ করতেই হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও চ্যানেল সংলগ্ন প্রবাহমান নদী ও খালের জোয়ার ভাটা নির্বিঘ্ন রাখতে হবে যাতে করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা সম্ভব হয়। এজন্য খনন এবং নজরদারির পাশাপাশি তীরভূমি ও প্লাবনভূমি উম্মুক্ত করতে হবে বলেও মত প্রকাশ করেন মোংলা ঘোষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দসহ সচেতন মহল।