পূর্ব দিগন্তে সূর্যটা তখন পশ্চিম দিগন্তে নুয়ে আসছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটোরটাকে গ্রাস করবে অন্ধকার। একজন জীবন সংগ্রামীর বাড়ি ফেরার পালা। প্রতিটা ধাপে ধাপে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে আপনালয়ে ফেরার তাগিদ। মুখে উজ্জ্বল হাসি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ।
কোমলমতি শিশুদের আকৃষ্ট করতে দুই হাতে রয়েছে বেলুন। দাম হাতের নাগালেই ১০ টাকা এবং ২০ টাকা। এমনকি বাহারি রঙের বেলুন দেখে বড়রাও হন আকৃষ্ট। আর এই বেলুন বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে পাঁচ সদস্যের পরিবার।
বলছিলাম নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর ইউনিয়নের খুবজিপুর গ্রামের আবু প্রামাণিকের কথা। তার সাথে দেখা হয় নাটোরের জিরো পয়েন্ট স্বাধীনতা চত্বর (মাদ্রাসার মোড়ে)। কথা হয় এই বেলুন বিক্রেতা আবু প্রামাণিকের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে জানা যায় তিন সন্তানের জনক তিনি।
সহায় সম্বল বলতে শুধুমাত্র রয়েছে মাথাগোঁজার ঠাই। প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে শহর কিম্বা গ্রামের মেলায়, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আশেপাশে পায়ে হেঁটে এই বেলুন বিক্রি করেন তিনি। পাইকারিভাবে প্লাস্টিক পাইপ এবং বেলুন কিনে পাম্পার মেশিনে হাওয়া দিয়ে, নিজ হাতে ডিজাইন করে তিনি বেলুন বিক্রি করেন।
বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার থেকে পাঁচশত টাকা রোজগার হয় তার। এই আয় থেকেই পাঁচ সদস্যের আহার বস্ত্র এবং তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচের জোগান হয়। আবু প্রামাণিক জানালেন, তিনি অনেক সুখি মানুষ। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। গ্রামের পরিবেশে তাকে লালন পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে স্থানীয় স্কুলমাস্টার তাকে বকাবকি করে। ‘এত কম বয়সে মেয়েকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা যাবেনা। তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।’ এমন নির্দেশনায় তিনি যেমন আনন্দিত অপর দিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
তার চোখে মুখে অনেক স্বপ্ন মেয়েটি তার লেখাপড়া শিখে মানুষের মতন মানুষ হবে। বড় কোনো চাকরি করবে। সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ অনেক ভিন্ন। এখানে চাইলেই সবকিছু করা যায়না। সহায়তা নিতে গেলে হয়তো উচ্ছেদ হতে হবে গ্রাম থেকে।
বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে কারবা মন চায় ? মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে হয়তো দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচও নেহায়েত কম না..
কথাগুলো বলতে বলতেই হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে পা দুটো সামনের দিকে এগোতে থাকলেন।
মুখমন্ডলে ভেসে উঠলো তিন সন্তানের প্রতিচ্ছবি, আত্মিক টানের হাতছানি। নাটোরের প্রায় ২২ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে হাজারো আবু প্রামানিক আছে দুচোখ ভরা স্বপ্ন হাতে নিয়ে ঘুরছে নাটোরের পথে প্রান্তরে, লোকালয় থেকে তেপান্তরে।