বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চটিতে আগুন লাগে রাত তিনটার দিকে। তখন লঞ্চটি ছিল ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এটি তীরে ভেড়ানো হয়। আর এই খবর জানানো হয় মালিক হামজালাল শেখকে। কিন্তু মালিকের পক্ষ থেকে বলা হয়, লঞ্চটি চালিয়ে যেতে। এ সময় ভয়াবহ আগুন লঞ্চের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নোঙর না করেই লঞ্চ থেকে নেমে পড়েন সেখানে কর্মরত মাস্টার, ড্রাইভারসহ ২৬ কর্মচারী। এতে জ্বলতে থাকা লঞ্চটি ঢেউ ও স্রোতের তোড়ে মাঝ নদী দিয়ে চলতে থাকে ঘণ্টাখানেক।
ফায়ার এলার্ম না থাকায় ঘুমন্ত অনেক যাত্রী আগুনের বিষয়টি জানতে পারেন দেরিতে। তাছাড়া যারা প্রাণ বাঁচাতে নদীতে লাফ দিয়েছিলেন তারা পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট বা নিরাপত্তা বয়া না থাকায় ডুবে যান। এতে দুর্ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক আকার ধারণ করে।
লঞ্চটির গ্রেপ্তার মালি হামজালালের বরাতে র্যাবের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সোমবার সকালে র্যাবের একটি দল কেরানীগঞ্জ থেকে লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে হামজালাল জানান, আগুন লাগার কিছু সময়ের মধ্যে সুপারভাইজার আনোয়ার তাকে ফোন করেন। এসময় তিনি আগুন লাগার খবর পেলেও তা চালিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু অবস্থা ভয়াবহ দেখে কর্মীরা লঞ্চটি তীরে রেখে নেমে পড়েন। তাদের সঙ্গে কিছু যাত্রীও নেমে পড়েন। এসময় লঞ্চটি নোঙর না করায় স্রোতের কারণে তা মাঝ নদীতে চলে যায়। এভাবে প্রায় ৫০ মিনিট চলতে থাকে। এসময় যাত্রীদের মধ্যে আগুনের বিষয়টি জানাজানি হলে অনেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন। অনেকে দগ্ধ অবস্থায় এবং ডুবে মারা যান। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ে।
র্যাব জানায়, লঞ্চটিতে শুধু কর্মচারীদের জন্য ২২টি লাইফ জ্যাকেট এবং যাত্রীদের জন্য ১২৭টি বয়া ছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের সময় চার শতাধিক যাত্রী ছিলেন লঞ্চটিতে। তাছাড়া আগুনের খবর পেলেও মালিক ফায়ার সার্ভিস বা স্থানীয় প্রশাসনের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করেননি।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, অতিরিক্ত যাত্রী চাহিদা তৈরি করতে লঞ্চটিতে গত নভেম্বরে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো। গ্রেপ্তার মালিকের তথ্য অনুযায়ী, ঘাট থেকে বিলম্বে লঞ্চ ছাড়লেও গন্তব্যে আগে পৌঁছানো গেলে লঞ্চে যাত্রী বেশি পাওয়া যায়। এজন্য লঞ্চে ৬৮০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন পরিবর্তন করে ৭২০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়নি।
র্যাব মুখপাত্র জানান, একজন সাধারণ মিস্ত্রি বা ফিটার দিয়ে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়েছিল। আগের ইঞ্জিনটি চায়না থেকে তৈরি ছিল। বর্তমানে জাপানি তৈরি রিকন্ডিশন ইঞ্জিন লাগানো হয়। জাহাজের ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়ে এবং ইঞ্জিন পরিবর্তন পরবর্তী যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে কারিগরি অনুমমোদন নেননি। এছাড়া রান ট্রায়ালও করেননি।
কমান্ডার মঈন জানান, লঞ্চে কর্মরত তিনজনের (মাস্টার ও ড্রাইভার) এই লঞ্চটি চালানোর জন্য সরকারি কোনো অনুমোদন ছিল না।
আগুনে বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চের বিদ্যুৎ
লঞ্চটিতে অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি, আগুন শনাক্তের যন্ত্র ও সতর্কীকরণ পদ্ধতিতে দুর্বলতা ছিল। তাছাড়া লঞ্চের ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র ঠিক ছিল না। আর ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকার কারণে চলার সময় বিকট শব্দ হচ্ছিল। চিমনি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ধোঁয়া বের হচ্ছিল না। এসময় অস্বাভাবিক গতিতে লঞ্চটি চলছিল। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন রুমে বিকট শব্দে ধোঁয়ার কুন্ডলি বের হয়। তখন পুরো লঞ্চের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরই ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
যেভাবে উত্থান লঞ্চ মালিকের
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চটির অর্ধশতাংশের মালিক হামজালাল শেখ। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি জাপানে ছিলেন। ২০০০ সালে দেশে এসে একটি লঞ্চ কেনেন। বর্তমানে তিনি তিনটি লঞ্চের মালিক। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি চারজনের মালিকানাধীন থাকলেও তিনিই মূল মালিক। পাশাপাশি সেটির সমস্ত ব্যবস্থাপনা তিনি নজরদারি করতেন।
দুর্ঘটনায় বিআইডাব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, ‘এগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। পাশাপাশি আমরাও অনেক সময় অভিযান করি, নৌ-যানের কাগজপত্র বা সেফটি ঠিক আছে কি না। তবে নৌ অথরিটির এসব ক্রুটির বিষয় নজরে এসেছে কি না বা তারা তদন্ত করে কিছু পেয়েছে কি না আমরা জানি না। আমরা যতটুকু জেনেছি এটাতে নতুন ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল, তবে সরকারিভাবে অনুমোদন ছিল না।’