কিশোরগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার জাকির কিশোরগঞ্জের একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে চাকরি করতেন। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তাকে হত্যার পর ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর একটি মসজিদে তাবলীগের চিল্লারত অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব মুখপাত্র জানান, ৩ অক্টোবর সকালে কিশোরগঞ্জ মডেল থানাধীন কাটবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে অচেতন অবস্থায় গুরুতর জখম অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এসময় নিহতের পাঞ্জাবির পকেটে থাকা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পুলিশ তার নাম জানতে পারে।
ঘটনার পর নিহতের ছেলে বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। ক্লুললেস এই হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা শুরু করে। পরবর্তীতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর একটি দল হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করে। পরবর্তীতে মঙ্গলবার রাতে তাকে একটি মসজিদে চিল্লারত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়।
কে এই নিহত রমিজ উদ্দিন:
রমিজ ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মালেয়েশিয়ায় প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন। পরবর্তী তিনি গরুর ব্যবসা ও খামার ব্যবসা শুরু করেন। এসময় তার সঙ্গে স্থানীয় মসজিদের ইমামের পরিচয় হয়। তখনই তাদের মধ্যে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান হতো। রমিজের কাছে নগদ অর্থ আছে, তা হাতিয়ে নিতেই ছক আঁকতে থাকে মুয়াজ্জিন জাকির। এরই একপর্যায়ে নেত্রকোণা থেকে কম দামে গরু কিনে দেবার কথা বলে নির্জন জায়গায় নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।
আত্মগোপন করতে তাবলীগের চিল্লায়:
ব্যবসায়ী রমিজকে হত্যার পর তার কাছে থাকা ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেন জাকির। এরপর বিভিন্ন জায়গায় তিনি আত্মগোপন যান। হাতিয়ে নেওয়া টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা তিনি (রমিজ) বিভিন্ন জায়গায় খরচ করেন।
র্যাব জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর অভিযানে মঙ্গলবার রাতে লক্ষীপুর জেলার একটি মসজিদে চিল্লারত অবস্থায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাকির পাঁচ বছর আগে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একটি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
নিহতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মুয়াজ্জিন তাকে বলেন- নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী গ্রামে কমমূল্যে গরু পাওয়া যায়। কমদামে ক্রয়-বিক্রয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ঘটনার ১০/১২ দিন আগে নিহত রমিজ উদ্দিনকে গরু ক্রয়-বিক্রয়ের জায়গায় নিয়ে যান। এতে রমিজ ব্যবসার বিষয়ে আশ্বস্ত হন।
পরবর্তীতে ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করেন। ২ অক্টোবর রাতে রমিজকে নিয়ে প্রথমে মনোহরদী থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী এবং পরবর্তীতে বড়পুল এলাকায় যান। সেখান থেকে রিকশায় কাটাবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদ এলাকার নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
গাড়িতে গরু আসবে এবং তারা সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করতে থাকে। রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে রমিজ উদ্দিনকে কৌশলে ডাউরিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে কলা বাগানে নিয়ে যায়। এসময় মোয়াজ্জিম জাকির হোসেন তার সঙ্গে থাকা হাতুড়ি দিয়ে পেছন থেকে আঘাত করে। হাতুড়ির আঘাতে রমিজ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার কপালে, মুখে, বাম চোখের উপর ও মাথার বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা হয়। এরপর রমিজকে মৃত ভেবে ওই জায়গা থেকে পালিয়ে যান।
র্যাব জানায়, হত্যার ঘটনার প্রায় দুমাস আগে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন জাকির। হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটনার দিন ছোট একটি ব্যাগে হাতুড়ি বহন করেছিলেন।
হত্যার পর নামাজ ও মক্তবে ছাত্র পড়ান জাকির:
হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্ত জাকির কিশোরগঞ্জ থেকে নরসিংদীর মনোহরদীতে চলে আসেন এবং নিজ বাসায় ঘুমিয়ে পড়েন। ফজরের আযানের সময় হলে মসজিদে গিয়ে আযান দেন ও নামাজে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি মক্তবে ২০ জন ছাত্রকে পড়ান।
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তার মুয়াজ্জিন ধারণা করেছিলেন- রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুর কথা কেউ জানতে পারবে না। তাই তিনি তার সাধারণ রুটিন অনুযায়ী চলাচল করতে থাকেন। কিন্তু ৩ অক্টোবর সকালে রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি এলাকাবাসী জানতে পারে। জাকির ভয়ে মসজিদ থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে নরসিংদীর মাধবদী, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে, ময়মনসিংহ সদরে, সিলেটের ফেঞ্জুগঞ্জ এবং সিলেট থেকে পুনরায় ময়মনসিংহ এসে আত্মগোপনে থাকেন। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার একটি মসজিদে আসেন এবং সেখান থেকে ৪০ দিনের চিল্লায় লক্ষীপুরের রামগতীতে যান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘শুধুমাত্র ছয় লাখ টাকার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। এই হত্যার পরে আত্মগোপনে থাকার জন্য জাকির ৪০ দিনের চিল্লায় যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাকিরের চলাফেরা ও পরিবার অসুস্থ থাকার কথা বলে ১৫ দিন ছুটি নিয়ে আর না ফেরায় র্যাবের সন্দেহ হয়। এ কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তিনি অকপটে সব স্বীকার করেছেন।