বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক যে দুই আসামির তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে তারা বাংলাদেশেই আছেন বলে ধারনা যুক্তরাষ্ট্রের। দেশের মধ্যেই তারা আত্মগোপনে আছেন বলে ধারণা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি তারা দেশে নেই। অন্য কোনো দেশে পালিয়ে গেছেন। তাহলে উগ্রবাদী নানা হামলার তদন্তে বারবার নাম আসা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও আকরাম হোসেন কোথায় আছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
অভিজিৎ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াকে গ্রেপ্তার করতে আট বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে কয়েকবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর সন্ধান পান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা এখনও সফল হয়নি। তবে জিয়া এখন দেশে নেই বলে জানিয়েছেন গতকাল জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, তারা (জিয়া ও আকরাম) দেশে নেই। তারা অন্য দেশে গাঢাকা দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের ধরে এনে রায় কার্যকর করা হবে। এ জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, জিয়াউল হক জিয়াসহ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা এখনো বাংলাদেশেই রয়েছে। এই দুজনের সন্ধান চেয়ে গত রবিবার ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণার সময় এ ধারণা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীন রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস (আরএফজে)।
সৈয়দ জিয়াউল হক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের মূল নেতা বলেও তথ্য প্রমাণ থাকার কথা পুলিশ বলে আসছে। এই জঙ্গি সংগঠনটির আল কায়দার সঙ্গে যোগসূত্র আছে বলে বলা হয়ে থাকে।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে গ্রেপ্তারের পর জিয়াউল হকের উগ্রপন্থায় সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকসহ অন্তত নয়জনকে টার্গেট করে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন এই চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা। আরও কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ওই সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুপ্তহত্যাসহ নানা পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন এই মেজর জিয়া। তিন বছরে তার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল তৈরি হয়। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছেন তিনি। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করেছে।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম এই মেজর জিয়া। সে সময় বেশ কয়েকজন ধরা পড়লেও পালিয়ে যান তিনি। তার পলাতক থেকেই দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছেন।
রাজধানী ও এর আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পরও জিয়ার নাম জানা যায়। এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পায় আইনশঙ্খলা বাহিনী।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশের সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগের প্রমাণ পায় গোয়েন্দারা। তাকে ধরতে ২০ লাখ টাকা পুরষ্কারও ঘোষণা করেছিলেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক। কিন্তু তাকে ধরতে সক্ষম হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মেজর জিয়ার তথ্য পাওয়ার জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মেজর জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে দুই ধরনের তথ্য পাওয়ায় জিয়ার আসলে কোথায় আছে সে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
কোনো অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বা তার অবস্থান জানতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া পরিচিত হওয়ায় তার অবস্থান সম্পর্কে জানা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে সৈয়দ জিয়াউল হকের ধারণা থাকায় বিভিন্ন সংস্থা চেষ্টা করে এখনও তাকে ধরতে সফল হতে পারেনি। তিনি বলেন, শুধু কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটই নয়, বিভিন্ন সংস্থা তাকে খুঁজছে।
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রযুক্তি অনেক উন্নত হলেও সৈয়দ জিয়াউল হক মোবাইল ফোনসহ কোন ডিভাইস ব্যবহার না করায় তাকে ধরা যাচ্ছে না।
অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেনকে পলাতক দেখিয়ে নিম্ন আদালতে ইতিমধ্যে বিচার হয়েছে। তাতে এই দুই জনসহ পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। মামলায় ছয়জন আসামির বাকি চারজন গ্রেপ্তার রয়েছে।
কে এই মেজর জিয়া?
জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। আত্মগোপনে যাওয়ার আগে মিরপুর সেনানিবাসে থাকতেন।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর সাবেক ও তৎকালীন কিছু সদস্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে মেজর জিয়া।
নয়টি হত্যার ‘মূল পরিকল্পনায়’ছিল জিয়া
২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দুই জনকে হত্যা করেছে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও ছিল তারা। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুই জনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দুই জনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।