৭ ডিসেম্বর ২০২১। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকাস্থ সিরডাপে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ও এএলআরডি এর যৌথ উদ্যোগে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪ বছরপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা: ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার একথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গৌতম দেওয়ান, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি। সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবীর, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী কল্যাণ সমিতির নেতা সন্তোষিত চাকমা, উন্নয়ন কর্মী লেলুং খুমী প্রমুখ।
গৌতম দেওয়ান তার প্রবন্ধে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বরং প্রতিনিয়ত উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে পাহাড়ে ভূমি বিষয়ক নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ে পর্যটন ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাজার হাজার জুমভূমি বহিরাগতদের কাছে লীজ দেওয়া হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়নের দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামাল বলেন, যে শান্তির উদ্দেশ্য নিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকীকরণ, পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন, ভূমি কমিশনের কাজের ধীরগতিতা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের অন্তরায় হয়ে আছে। ১৯০০ সালের আইন বাতিলের চলমান যে প্রক্রিয়া চলছে তা আদিবাসীদের অস্তিত্বে আঘাত হানার সামিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা নিজভূমে পরবাসী হয়ে জীবনযাপন করছেন। তিনি সাংবাদিকদের প্রতিও এ আহ্বান জানান, তারা যেন মিডিয়ায় পাহাড়ের প্রকৃত সত্য প্রকাশ করেন যাতে এসব সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে।
খুশী কবীর বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ২৪ বছরেও পূরণ হয়নি। বিশেষ করে ভূমি সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। বর্তমানে পাহাড়ে পর্যটনের নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে যা পার্বত্য চুক্তিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উপেক্ষা করার সামিল।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করলেও বিগত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হল ভূমি সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমি কমিশনই বর্তমানে একটি অন্তরায় হয়ে আছে। কারণ এ কমিশনের অর্থ নাই, লোকবল নাই, এমনকি এর বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়নি। অনেক আইন বা বিধিমালা খুব অল্প সময়ে প্রণয়ন করা হলেও বিগত ৬ বছরে পার্বত্য ভূমি কমিশন বিধিমালা অনুমোদন হয়নি। তিনি আরও বলেন, সরকারের ভেতরেই এমন কোন মহল রয়েছে যারা চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পাহাড়ে আমরা প্রতিনিয়ত সামরিক শাসনের সম্মুখীন হচ্ছি। বাকস্বাধীনতা ও চলাফেরার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। যারা চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী তাদের সাথেই আদিবাসীদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়না বরং নিরাপত্তার অজুহাত, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাদির তকমা দিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীকে পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য প্রফেসর মংসানু চৌধুরী বলেন,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার করা হচ্ছে মূলত পাহাড়ে সামরিকায়নকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। যারা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে আজ তাদেরকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হচ্ছে। আমরা চাইনা পার্বত্য চট্টগ্রামে আর কোন রক্ত ঝরুক। পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুমাত্রিক সমস্যার আশু সমাধান হওয়া দরকার।
উন্নয়ন কর্মী লেলুং খুমী বলেন, পর্যটন সম্প্রসারণ, উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ অব্যাহত থাকায় প্রতিনিয়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ আতংকে দিন কাটাতে হচ্ছে। সবকিছু মিলে পাহাড়ে সবসময় একটা ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজমান রয়েছে। এসব সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া দরকার। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ খুবই প্রয়োজন।
ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী নেতা সন্তোষিত চাকমা ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণাথী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের বসতভিটা ও ভূমি ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানান।