হাওয়া

নবনীতা বসুহক
নবনীতা বসুহক
9 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সাময়িকী

এইখানটা খুব ঠান্ডা হাওয়া। একটু উপরে তো!
উপর মানেই ঠান্ডা, তার উপর হাওয়ার কারসাজিত! সবাই জানে!
ওরকম নয় শঙ্খ। এই বাড়িটায় এরকম।
উপরতলাতে যে থাকবে সেই এই ঠান্ডা পাবে! কাকুকে বল, এই বাড়িটার উপরতলাতে একটা ঘর নিতে।
কাকুকে জিজ্ঞাসা করিস, দাম কত?
ফোনে বলিস বাবাকে। বলে রাখবো আমিও।
এমনিতে আমাদের ফ্ল্যাট আছে, এ সি আছে, তাও বাবাকে বলব।
এই যা। ভাগ। আমার পার্টির বন্ধুদের আসার সময় হল। ও কি করছিস, এই দামি ক্যামেরাটায় হাত দিচ্ছিস? খুব দামি।
কাঁচুমাচু শঙ্খ বলল, তোর কোন এমন বন্ধুরা আসবে যে আমি থাকলে অসুবিধা হবে?
এরা সব উপরতলার বাসিন্দা। এই বাড়িতে প্রতি তলার লোক, সেই তলার লোকেদের বাড়ি যাবে, আড্ডা মারবে, গান গাইবে, নাচ করবে, ফুটানি মারবে, হট সিনেমা দেখবে, হাই লেভেলের পি এন পি সি করবে, সাধারণ জনগণের প্রবেশ থাকা খুব একটা কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই তোকে যেতে বলছি।
ও। আমি সাধারণ জনগণের মধ্যে!
হ্যাঁ। এই যে তুই এলি, আমি টিকিট করে রেখেছিলাম। কাকুকে বলিস, বাড়ি কিনলে তবেই আমরা মেলামেশার সুযোগ পাব রে।এখন ফোট।
নিচের দিকে নামছে শঙ্খ। সদ্য কলেজ শেষ হয়েছে। বাড়িতে একভাবে ভালো লাগে না, তাই সীমান্তর কাছে এসেছিল। এদিকে সীমান্তরা বহুদিন পুরনো বাড়ি বেচে দিয়েছিল। ফোনে যোগাযোগ হলেও আসতে বললেও আসা হয়নি। অনেক কষ্টে শেষমেশ ওর বাড়ি পৌঁছেছিল।
ফোর লেন ধরে, উড়ন্ত ট্যাক্সি ধরে তবে ওদের বাড়ির ছাদ। ছাদ তো নয়, যেন চাঁদপরি আর রূপকথার দেশ। হালকা মায়াবি আলোয় বরফের কুঁচি পড়ছে, একটা আবার মোটা জ্যাকেট কিনতে হল! ভাগ্যিস এ টি এম চলল এখানে!
সীমান্ত’র বাড়িতে কোন এসি নেই, বেশি টাকা দিয়ে ঠান্ডা কিনেছে ওরা।

দুই

হম। বুঝতে পারলাম। তো ঔদ্ধত্য হয়েছে!
ভালো লাগছিল না। তাই গেলাম। কী করে জানবো ও এত বদলে যাবে!
ভালো লাগছিল না, তাই গেলাম। শোন রবিবার মা তোকে বাড়িতে আসতে বলেছে!
কী খবর গুরু! আইবুড়োভাত খাচ্ছিস নাকি!
‘আইবুড়োভাত ভাত খাচ্ছিস নাকি’ – টেনে মারবো এক থাবড়া! ওই দিনটা কি করে ভুলে যাস!
ওহ্। তোর জন্মদিন! না! এখনো এসব করিস!
নাহ্। মা একটু পায়েস করে। আর টুকিটাকি ক’জন আসবে!
তাহলে আমি নেই। পরে যাব।
কেন?
আবার তুইও যদি বলিস, এখন ফোট, আমার বন্ধুরা আসবে!
আমি কী সীমান্ত নাকি! বন্ধুরা আসবে না। পিসি, মাসি সব আসবে। বিকেলেই চলে যাবে। তুই সন্ধ্যাতেই আয়।
কী জানি সময় মানুষকে বদলে দেয়। তোকেও যদি দেয়! আচ্ছা যাবখন টুনাই। দেরি হলে ভাবিস না।
তুই অমন নয়। জানি। আসবি।
নিশ্চয়।
সবাই এল। সীমান্ত ছাড়া। বললাম তাও!
মা বলল,একবার সীমান্তকে দেখে আসিস। কি হল! প্রতিবছর তো আসে!
খুব ক্ষিদে পেয়েছে। মা ঠিক সময়ে খাবার দিল। সরু চালের ভাত। মুগের ডাল, তিনটে ভাজা। চারটে সবজি।
হঠাত শঙ্খ বলল, তোরা সবজি বলিস কেন?
সবুজ থেকে সবজি।
যেগুলো সবুজ নয়!
ওগুলো তরকারি।
পাশের বাড়ির রুমনা
আর ওর দাদা রোমান এসেছে। একদম পাশের ফ্ল্যাটেই মাস ছয়েক এসেছে। কথা হয় জানলা দিয়ে। মা বলল, ওদেরও বলি রাতে।
চারজন। শঙ্খ খুব বকবক করছে রুমনার সঙ্গে। রুমনা আর শঙ্খের কথা শুনছি, খাবার পর বাইরের সোফাতে বসে।
শঙ্খ বলছে, কেমন ছিল আগে যেখানে থাকতে!
ইগলু গেছো? ওখানকার মতোই ঠাণ্ডা।
মাঝেমধ্যে শঙ্খ বলছে, টুনাই ওরা আরো ঠাণ্ডাতে থাকতো!
জানি।
রোমান আর একটু বড়। বলল,খুব ঠান্ডা। বাবা তো তাই এখানে চলে এল বদলি হয়ে।
রোমান গিটার বাজাচ্ছে। এখানে বারোমাস বসন্ত কাল। কৃষ্ণচূড়া দেখতে দেখতে গান গাইছে রোমান,
এই বসন্ত লাল, এই মন কেমন বিকেল—
বললাম, নোটটা নতুন নাকি রে রোমান!
ইয়েস ডিয়ার।
বিকেলে মিষ্টি খাইয়ে তবেই মা ছাড়ল। একটা বাতাস মোটর এঁকে দিলাম,সেটাতে চড়ে বাড়ি গেল শঙ্খ।

তিন

একটা শাঁখ দুলছে। ওটা কার কল্পনা!বোধহয় মা’র। শঙ্খ এসেছিল তাই শাঁখের কথা মনে হয়েছে! এখানে কোন রিয়েল জিনিস তো থাকে না। যে যার কল্পনা মত সব করে নেয়। শাঁখটাতে ফুঁ দিলাম। অমনি হাজির সাত পুরুষ আর সাত পুরুষ ঠাকুমার দল। রাতভর তারা আর্শিবাদ করল, মা সেই ছায়াময় পূর্বপুরুষের কাছে আমার জন্য অনেক ভালো ভালো কথা শুনে নিল।
তিন পুরুষ আগের বাবার ঠাকুর্দার মা বলল, তাড়াতাড়ি কর। আবার উপরে যেতে হবে।
কেন!
ওমা। দু’পুরুষ আগে আরেক নাতির ঠাকুমা ছিলাম রে! সেখানে যাব।
এরকমই সবাই এক এক করে চলে গেল। বাবা বলল, তবু তো সবাই এসেছিল!
মা বলল, হম। এসেছিল। থাকলেন কোথায়?
বসলেন না! এরকম হলে শাঁখ নামাতাম নাকি!
যত্তসব।
শাঁখ নামাতে। কিন্তু ভুল করে মেয়ে বাজিয়ে ফেলেছিল, তাই ওরা এলেন। আগের থেকে নেমন্তন্ন তো করোনি!
বয়ে গেছে। কেউ কিছু দিল?
রাগ করে বাবা বলল, হুম।
বললাম,মা। চুপ করো তো!যাবার সময় সবাই আমাকে দিয়ে গেছেন।
কিরে? দেখা। দেখা।
হাওয়া বক্সে ভরে আছে।
দেখি। নামা বলছি।
আর উপহার কেমন দ্যাখো। সাত পুরুষ আগের ঠাকুমা টু দ্য সেভেন জাহাঙ্গীর আমলের কয়েন দিলেন, ঠাকুমা টু দ্য সিক্স একটি রুপোর ঘড়া, ফিফথ দিয়েছেন সেকেলে ঢাকাই, ফোর্থ দিলেন মূল্যবান পুঁথি, থার্ড গিনি, টু আর ওয়ান দিলেন দুটো চাকতি।
এই দ্যাখো, বলতাম না সব আছে। তুমি শুধু শুধু গ্রামের বাড়িতে যেতে না।
এসব তো ওকে দিয়ে গেলেন। জন্মদিন উপলক্ষে হাজির হলেন।
না না। ওরা ভেবেছিলেন বিয়ে। ওই শাঁখ তো আর এমনি বাজতো না! মঙ্গল শঙ্খ যে! ওটা ছিল বিয়ে উপলক্ষে বাজানোর।
ওদের আবার ডাকো। ওসব ফেরত দিই। আমার তো আর বিয়ে নয়।
ডাকি যদি তবে ওদের থেকে জেনে নোব কোথায় সব সম্পত্তি আছে?
মাকে বললাম, এসব ছাড়া আরো আছে ওদের। আমার চাই।
আমার কাছে এসব অর্থহীন।
মা শোনে! শাঁখ বাজালো জোরে।
ওঁরা আর এলেন না।
তখন মা বাবা আর আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিল!
বিরক্ত হয়ে আবার হাওয়ায় রাখলাম। কৃষ্ণচূড়া হাওয়া দিতেই সব মিলিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ বারান্দায় বসলাম।
অনেক রাত। মা ও বাবা ঝগড়া করে এখন নিস্তব্ধ। কৃষ্ণচূড়া ডাল বাড়িয়ে দিল মাথার ওপর।
মনে মনে বললাম, অকৃত্রিম থাকো কেবল।
হাওয়াতে হারিও না।
কৃষ্ণচূড়া হাসল।

চার

কাল একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে! আসবি একবার?
কেন বায়ুতরঙ্গের কথা তে বুঝি হচ্ছে না!
না। আয়।
চলে গেলাম শঙ্খের বাড়ি। ওর তো আবার গরমের দেশ। গায়ে চড়ালাম এসি জ্যাকেট। যেটা শীতে গরম, গরমে ঠান্ডা দেবে সুইচ কন্ট্রোল করে!
শঙ্খ খুব উত্তেজিত। বলল, একটা জিনিস দেখাই।
কীরে!
তোর মুন্ডু ঘুরে যাবে! আমার ঘরে চল।
গরমে ঘামে শঙ্খ জবজবে। তবু ওর বিস্ময় বিস্কুটের মত কুড়কুড়ে।
শঙ্খ একটার পর একটা জিনিস দেখাচ্ছে। পিতৃপুরুষরা কাল ওকেও উপহার দিয়ে গেছে!
কী করে এল?
আরে কাল একটা ঝুমঝুমি বাজাচ্ছিল বুবুন।
ঝুমঝুমি!
বুবুন মানে ভাই তো রাতদিন ওই বাজাচ্ছে! কাল বাজাচ্ছিল, অমনি সাতটা বুড়ো আর সাতটা বুড়ি এসব দিয়ে গেল।
কাকিমা জানে?
খেপেছিস! বলি, আর ভয় পাক।
তোদের ভয় করেনি!
আমার একটুও ভয় করেনি। তবে বুবুন খুব ভয় পেয়েছে। তারপর থেকে ঘুমোচ্ছে মাথামুড়ি দিয়ে।
কাকিমাকে বুবুন কিছু বলে নি!
নাহ্।
তোর অবাক লাগছে না!
নাহ্। তবে হাওয়া বক্সে ভরে রেখেছি। তোদের এখানে হাওয়া কন্ট্রোল করা যায় না। তাই দেখতে পাচ্ছিস।
তোর পাওনা উড়ে গেল।
যা বাবা, তাহলে আর কী লাভ?
থেকেই বা কী! একবার সীমান্তর বাড়ি যাব। যাবি তুই?
ওমুখো আর কে হবে!
বুবুন ঘুম ভেঙ্গে উঠে আমাকে দেখে বেশ অবাক। ভয়ে ভয়ে বলল, ওরা নেই টুনাইদিদি!
আশ্বাস দিয়ে বললাম, না।তবে থাকলেই বা কিরে!তুই তো মোবাইলে গেম খেলিস, সুইচ বন্ধ করলে চলে যায়। ওরাও তো তেমন।নয় তো কি!
ভয়ের নয় টুনাইদিদি!
না। ওরা আমাদের একলা ঘরের বন্ধু, মোবাইলের মিলিয়ে যাওয়া গেমের মতো! যদি কখনও আসে গল্প করিস, দেখবি ওরা কত্তকালের গল্প জানে। তোর মন ভালো লাগবে।
শঙ্খ বলল, যাচ্ছিস,
সীমান্তর বাড়ি তাহলে! আগে থেকে অ্যাপো করে নিস!
শঙ্খ’র বলার ধরনটা ভালো লাগল না আমার।
বললাম, ও যে কেন এল না জন্মদিনে? জানতে যাচ্ছি।

- বিজ্ঞাপন -

পাঁচ

পথে দেখা হল রোমানের সঙ্গে। বলল, চললি কোথায়!
সীমান্তদের বাড়ি। তুই কোথায় যাচ্ছিস!
সমুদ্রের কাছে যাচ্ছিলাম।
খুব জরুরি সমুদ্র সৈকতে যাওয়া?
মা ফেলতে দিয়েছে কিছু জিনিস, ইগলুতে বরফ চাপা দিলেই ফসিল হয়ে যেত, এখানে সেগুলো হচ্ছে না।
এক কাজ কর, এই চামড়ার ক্যারি ব্যাগে রাখ। আমরা যদি সীমান্তদের এলাকায় ঢুকি ওখানে মিলিয়ে যেতেও পারে!ঠান্ডা তো!এখন আমার সঙ্গে চল দেখি। ওদের ওখানে নাকি ঢুকতে অনুমতি লাগে! তোরা ইগলুর উচ্চতায় থাকতিস। একটা পরিচিতি পত্র আছে। ওটা দেখালেই দুজন যাওয়া যাবে।
ওকে। বস।
সীমান্ত ইগলুতে ছিল বলে বোধহয় রোমানকে খাতির করল।
ঠান্ডার মাহাত্ম্য! উচ্চতার পদধূলি! শঙ্খর কথা তুললাম। সীমান্ত চুপ!
রোমান জিজ্ঞাসা করল, গিটার আছে তোদের বাড়ি?
হম।
দেনা!
নতুন নোটস?
উত্তর না দিয়ে রোমান গান ধরল,
ও, এই অর্থহীন বিভাগ…
কেন করি মিথ্যে অনুরাগ!
বাহ্! সীমান্ত একটু জ্বলজ্বলে চোখে বলল, আমি ভুল করেছি।
তাকালাম। ওর দিকে।
রোমান গান গাইছে।
জমিয়ে ঠান্ডা। বললাম, কী হল?
শঙ্খকে অপমান করে ঠিক করিনি। ওদের কম টাকা তাই গরমে থাকে… কাল সাত পিতৃপুরুষ এসেছিল। বলল ওরা, তুই-আমি-
শঙ্খ- সবার ঠাকুমা ঠাকুর্দা ছিল কোনো না কোনো সময় ওরা!
তাই! কি হল?
ওদের দেখা পাইনি। স্বপ্নে কীসব জিনিস দেখালো ট্যাখালো।
ঠান্ডার জন্য শরীরে আসেনি হয়তো!আমার আর শঙ্খ’র কাছেও গেছিলেন!
ঠান্ডার জন্য নয়। ওরা আসেনি শরীর প্রকাশিত হয়নি, আমার অহঙ্কারের জন্য…
গান গায়ছে রোমান,
রোদ সোনা কতকাল এখানে ওঠে না,
বাতাস কেন যে কিনেছি আমরা…।
সীমান্ত, তুই কি জিনিস গুলো পাসনি, তাই মিস করছিস?
নাহ্।
তবে বড় একা লাগে আজকাল। ফিল লোনলি। ওই পিতৃপুরুষ আর ঠাকুমারা যদি আমাদের বাড়ি থাকত, বারোমাস।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!