আধুনিকতার স্পর্শে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই কালাবর্তনে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক বাহক অনেক ঐতিহ্যরই আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আবার ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই কালক্রমে হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে। তেমনি এক সময়ের কাঁসা ও পিতলের তৈরি অতি জনপ্রিয় থালা-বাসন, গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুনসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র হিসাবে বহুল ব্যবহৃত ‘কাঁসা পিতল শিল্প’ বর্তমানে পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে। আধুনিক যুগে কাঁচ, মেলামাইন, প্লাষ্টিক, এ্যালুমিনিয়াম সহ অন্যান্য ধাতব ও প্লাষ্টিক শিল্পের নাগপাশের প্রাষাণ প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে না পেরে ওই শিল্পটি বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়।
নব্বই দশকের পরবর্তী সময়ে স্বল্প মূল্যে মানসম্মত হালকা জিনিসপত্রের ব্যবহার প্রচলনের পর থেকেই ‘কাঁসা পিতল শিল্প’র তৈরিকৃত থালা-বাসন, মগ গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুনসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র এর ব্যবহার উঠে যেতে থাকে গাঁও গেরাম থেকে। এর স্থলে ক্রমেই প্রচলিত হতে থাকে কাঁচ, মেলামাইন, প্লাষ্টিক, এ্যালুমিনিয়ামসহ সহজলভ্য স্বল্পদামের ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের। ফলে অতীতে গাঁও গেরামে বহুল ব্যবহৃত ‘কাঁসা পিতলের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী’র ব্যবহার কালাবর্তনে বর্তমানে পুরোপুরি প্রায় উঠেই গেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। কালে ভাদ্রে বিভিন্ন বসতবাড়ির শো’কেজে ও ময়লা আবর্জনা রাখার ঘরে বছরের পর বছর পড়ে থাকা এক সময়ের জনপ্রিয় কাঁসা পিতলের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ধাতব সামগ্রী দেখা গেলেও কালের আবর্তে বর্তমানে তা পুরোপুরি বিলুপ্তি’র পথে।
জানা গেছে, প্রাচীনকালে রাজা বাদশা, ধনাঢ্য ব্যাক্তি থেকে শুরু করে সাধারন জনমানুষের ব্যবহার্য তৈজসপত্র হিসাবে কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি থালা বাসন, গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুনসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব সামগ্রী ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যাবহৃত হতো। নব্বই দশকের আগে কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি থালাবাসন, গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুন-এর ব্যাপক চাহিদা ও প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে কাঁসা পিতলের ওইসব সামগ্রীর চাহিদা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। প্রাচীনকালে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা ও পিতল দিয়ে তৈরিকৃত থালাবাসন, গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুনসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব সামগ্রীর ওপর নান্দনিক ও বাহারী কারুকাজ করা থাকতো। বিখ্যাত লোকের জন্য কাঁসা পিতলের ধাতব সামগ্রী তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন কারুশৈল্পীর মাধ্যমে। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। কবিগুরু শাহজাদপুরের জমিদারী দেখভালের জন্য শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে অবস্থানকালে কাঁসা পিতলের তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র, বাসনপত্র, সিলমোহর, কেরোসিনের কুঁপি বাতি ব্যবহার করতেন। এ সময় শুধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নয়, বিশ্বকবির দেখাদেখিতে এতদ্ অঞ্চলের (নাটোরের রানী ভবানীর রাজ্য এলাকার) প্রজাগণ কাঁসা পিতলের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ধাতব সামগ্রী ব্যবহার শুরু করেন । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে রবীন্দ্র স্মৃতি যাদুঘরে সংরক্ষিত কাঁসা পিতলের কিছু ধাতব সামগ্রী সু-প্রাচীনকালের কাঁসা পিতলের ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি আজ অবধি বহন করে চলেছে।
শাহজাদপুর পৌর এলাকার শেরখালী গ্রামের মোঃ সেরাজুল ইসলামের স্ত্রী সাবিনা ইসলাম বলেন, প্রায় এক যুগ আগে তাদের বিবাহের সময় তার পিতা ফরিদপাঙ্গাসী গ্রামের হাচেন আলী প্রামানিক প্রায় ৬০/৬৫ বছর আগের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ করা বেশ কিছু কাঁসা পিতলের সামগ্রী স্মৃতি হিসাবে উপহার দিয়েছিলেন। সাবিনা ইসলাম তার পিতা হাচেন প্রামানিকের কাছ থেকে পাওয়া কিছু কাঁসা পিতলের সামগ্রী ব্যবহার না করে শো’কেজে তুলে রেখেছেন। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ওইসব কাঁসা পিতলের সামগ্রী ব্যবহৃত না হওয়ায় ওইসব সামগ্রীর রং নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিছুকিছু স্থানে নীলাভ কার্বন জাতীয় আস্তরণ পড়ে গেছে। শাহজাদপুর পৌর এলাকার দ্বারিয়াপুর বাজার ও মণিরামপুর বাজারে প্রায় দুই যুগ আগেও বেশ কিছু কাঁসা পিতলের সামগ্রী বিক্রয়ের অনেকগুলো দোকান ছিল। কিন্তু, বর্তমানে ওই দুই বাজারে কাঁসা পিতলের সামগ্রীর কোন দোকান আর দেখা যায়না। শাহজাদপুরের বেশীরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনই কাঁসা পিতল ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীতে নানা আধুনিক শিল্পের আগ্রাসনে কাঁসা পিতলের চাহিদা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় ওইসব কাঁসা পিতল ব্যবসায়ীরা তাদের পেশা বদল করে অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে।
শাহজাদপুর পৌর এলাকার দেওয়ানবাড়ি সেতু সংলগ্ন এলাকার এক সময়ের কাঁসা পিতল সামগ্রীর বিক্রেতা বাসু দেব দত্ত জানান, ‘নব্বই দশকের সময়ে প্লাষ্টিক ও এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বাজারে আসতে শুরু করায় কাঁসা পিতলের তৈরি সামগ্রীর কেনা বেচা কমে যেতে থাকে। ওই সময় তিনি কাঁসা ও পিতল দিয়ে তৈরি থালাবাসন, গ্লাস, জগ, কলস, কুঁপিবাতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, পানের বাটা, চালুন এক’শ বিশ টাকা থেকে এক’শ পঞ্চাশ টাকায় সের হিসাবে ওজন করে বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে কাঁসা পিতলের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী কেজিপ্রতি এগারো থেকে বারো’শ টাকায় বিক্রি হওয়ায় এর চাহিদা ও কদরে ধ্বস নেমে এক পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।’
ফলশ্রুতিতে, আবহমান গ্রাম বাংলার এক সময়ের ঐহিত্যবাহী কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী হাটবাজারে বর্তমানে কালে ভাদ্রেও দেখা না যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ওই শিল্পটি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছে।#