উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হাসান আজিজুল হক
প্রয়াত হাসান আজিজুল হক ছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার! তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলায়! সেখান থেকে খুলনা হয়ে তিনি রাজশাহী নিবাসী হয়েছিলেন! বিগত অর্ধ শতক ধরে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন মূলত গল্পকার হিসেবে! তাঁর গল্পে উদ্বাস্তু সমস্যা, মধ্যবিত্তের নানামাত্রিক ধ্বস ও জীবন সংগ্রাম, মানুষের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা, দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্ট মৃত্যুর বিভীষিকা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৃশংসতা, যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মন্দা, কালোবাজারির রমরমা ব্যবসা ইত্যাদির ছবি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় গ্রামীণ মানুষের জীবন ও প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যময় ছবি!
১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে হাসান আজিজুল হক জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর নানা পুরনো কালের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ফরাসী ও বাংলায় তাঁর লেখা বেশ কয়টি পাণ্ডুলিপিও ছিল। আর তিনি ছিলেন দারুণ এক কথক। হাসান আজিজুল হকের বাবা-চাচাদের পরিবার ছিল বিশাল একান্নবর্তী একটি পরিবার। ছেলেবেলায় যবগ্রামের অবাধ প্রকৃতির লীলা-বৈচিত্র দেখে দেখে তিনি বড় হয়েছেন। তিনি তাঁর জন্মভূমি যবগ্রামের প্রকৃতির বর্ণনা ও তাঁর ছেলেবেলার কথায় লিখেছেন:
‘বোশেখ মাসের কোনো কোনো দিন বেলা থাকতেই ঈশেন কোণে একটুখানি কালো মেঘ সর সর করে এগোতে এগোতে আর দ্যাখ্ দ্যাখ্ করে বড় হতে হতে নিমিষে সারা আকাশে ভরে ফেলে। একেবারে দিনে দিনেই রাত নেমে আসে আর থমকে থেমে যায় সবকিছু। প্রকৃতি আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে না, আটকে রেখেছে নিজের ভেতরে। তার পরেই একেবারে প্রলয়-ঝড়। বড় বড় গাছগুলো উপড়ে, খড়ের চাল, টিনের চাল উড়িয়ে পুকুরে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলে সব লন্ডভন্ড ছিঁড়ে খুঁড়ে একাকার! কতক্ষণই বা চলে কালবৈশাখী, দশ-পনেরো মিনিট? থামলেই মনে হয়, যাক, এবারের মতো প্রাণে প্রাণে বেঁচে গেল দুনিয়া। তারপরে ঝিরঝির করে ময়দা-চালা মোলায়েম বৃষ্টি, মেঘের তালায় সূয্যি, বেলা এখনো খানিকটা আছে। লাল আলো ছড়িয়ে হাসতে হাসতে ডুবছে সূয্যি।’
হাসান আজিজুল হকের বাবা এমনিতে তাঁদের দিকে চেয়েও দেখতেন না। তাঁরা বড় হচ্ছেন যেন বাড়ির কোণে ফেলে দেওয়া আঁটি থেকে জন্মানো আমের চারার মতো। আলো হাওয়া রোদ বৃষ্টি পাচ্ছেন এই যথেষ্ট। হতে পারে তাঁর বাবা বোধহয় ভাবতেন, মাটিই যথেষ্ট, বড় হতে যা যা লাগে সব সেখানে আছে। তিনি তাঁদের দেখেন না, দেখেন না, হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল কড়া গালায় বললেন, চুল হয়েছে তো বাউরিদের মতো। যা, খেলা নাপিতকে ডেকে নিয়ে আয়, বলবি, বাবা ডাকছে, ক্ষুর কাঁচি নিয়ে চলে আসুক।
পাগলা নাপিত একদিন বেলা এগারোটার দিকে এসে খামারবাড়ির এক কোণে পাশের কোঠাবাড়ির ছায়ায় বসিয়ে তাঁর চুল কাটতে লেগে গেল। খড়ের চালের খুব ঘন ছায়া হয়। এদিকে বাইরের দিকে তাকানো যায় না, ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুর। জনপ্রাণী নেই আশপাশে। তাঁরা খড়ের চালের ঠাণ্ডা ছায়ায় বসে আছেন। মাঝে মাঝে হুশ করে ধুলোভরা বাতাস আসছে, দূরে পাকুড় গাছ থেকে সেই বাতাসের ঝম ঝম শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
কিন্তু পাগলা নাপিত কঠিন রাগ রাগ মুখ করে দাঁত চেপে বারে বারে তাঁর মাথাটা তার ময়লা ধুতি পরা দুই উরুর মাঝখানে গুঁজে দিচ্ছে। তাঁর খুব উমুড়ি-গুমুড়ি লাগছে, হাঁপু-চুপু করছেন-ওই মাথায় সাবান মাখিয়ে দিলে যেমন হয়-তিনি মাথা সরিয়ে আনতে চান আর পাগলদা আঃ বলে ফের ঠেসে ধরে দুই উরুর মাঝখানে। একটা লোহার চেয়ারে বসে তাঁর বাবা দেখছেন। তাঁর বাবার আবার সায় পাগল নাপিতের দিকেই। তিনি বলেন চুলবুল করছিস কেন, বোস্ না একটু স্থির হয়ে।
চুল কাটা চলছে। প্রথমে খানিকক্ষণ খ্যাঁচ খ্যাঁচ কাঁচি চালিয়ে চুলের জঙ্গল সাফ করে দেওয়া হলো। তারপর শুরু হলো কিট কিট কিট কিটি, ক্লাপ ক্লাপ ক্লাপ, ঠক ঠক। তিনি ভাবছেন কতক্ষণ চলবে এসব, কত কাল! এদিক-ওদিক তাকানো যাচ্ছে না। আর তাঁর বাবা মাঝে মাঝে উহুহু-কানের কাছে এক থোপা চুল রয়ে গেল-এই যে এইখানে! কিট কিট থামিয়ে ক্ষুর বের করতে গেলে, না না, ছেঁচে দিস না। এদিকে এমন করে তাঁর ঘাড় বাঁকানো যে কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি, শুধু চোখের কোণে দহলিজে টাঙানো একটা বাংলা ক্যালেন্ডারে দেখতে পাচ্ছেন ১৩৫৩! ঘুরেফিরে খালি ১৩৫৩, ১৩৫৩ আর একটা বুড়ো গাছতলায় বসে দুটো ছাগল চরাচ্ছে। মাঠে খুব ঘাস! ক্যালেন্ডারের মাঠে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ১৯৫৪ সালে রাঢ়বঙ্গ পরিত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন!প্রথমে খুলনা তারপর রাজশাহীতে স্থায়ী হন! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে পরে টানা ৩১ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন! শৈশব ও কৈশোরে দেখা গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিকে তিনি ভুলতে পারেননি! গ্রামীণ মানুষের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক উত্তরকালে স্মৃতির আশ্রয়ে লেখকের জীবনে স্বর্ণ খন্ডের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে ক্রিয়াশীল থেকেছে! এ কারণেই তাঁর একাধিক গল্পে গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির শিল্পসম্মত লক্ষ করা যায়!প্রথম প্রকৃত উপন্যাস লিখেছেন ষাটোর্ধ্ব বয়সে।
ছোটগল্পের আঙ্গিকেই তাঁর লেখকসত্তার বিকাশ ঘটেছে। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় একই কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। সেটি কিন্তু কোনো গল্প ছিল না। রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য নিয়েই প্রথম লেখাটি লিখেছিলেন তিনি। ‘চারপাতা’র ছোট্ট এক কলামে ছাপা হয়েছিল হাসান আজিজুল হকের সেই রম্যরচনাটি। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির উৎসমুখ খুলে যায় খুলনায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’-কে কেন্দ্র করে।
হাসান আজিজুল হকের জীবনযাপনের ভূগোল বিচিত্র। তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতার ভান্ডার অতিমাত্রায় সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে, যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবনে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা ও পরিণত বয়স থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীতে আছেন। একটি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং উত্তরকালের চার দশকের বাংলাদেশের উত্থান-পতন ইত্যাদি ইতিহাসের বিস্তৃত পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখতে বসেন।
হাসান আজিজুল হকের লেখা গল্প গ্রন্থ গুলি হলো-‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪), ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ ’(১৯৬৭), ‘জীবন ঘষে আগুন’ (১৯৭৩), ‘নামহীন গোত্রহীন’ (১৯৭৫), ‘পাতালে হাসপাতালে’ (১৯৮১), ‘নির্বাচিত গল্প’ (১৯৮৭), ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ (১৯৮৯), ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প’ (১৯৯১), ‘রোদে যাবো (১৯৯৫), ‘হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প’ (১৯৯৫), ‘মা–মেয়ের সংসার’ (১৯৯৭), ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৭)। তিনি বিশ্বাস করতেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা খাঁটি লেখক হওয়ার জন্যে অনুকূল নয়। সমাজ ও রাজনীতিসচেতন লেখক হাসান আজিজুল হক নিজের সমস্ত ক্রোধ ও অসন্তোষ একসঙ্গে নিয়ে লিখতে বসেন।
লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থান সুনির্দিষ্ট, তাঁর সমস্ত ক্রোধ, অসন্তোষ, দাবি শোষিত মানুষের পক্ষে। তিনি তাঁর ক্রোধকে সামান্যও আড়াল করেননি। হাসান আজিজুল হকের মতে মানুষের প্রকৃত জীবনযাপন হারিয়ে গেছে। নিজের বেঁচে থাকা নিজের ইচ্ছার ওপরে নেই, একটা ছকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষকে চিন্তাবর্জিত শরীরসর্বস্ব এক বিশেষ প্রাণীতে রূপান্তর করে ফেলছে। কোনো কিছু ভাবার সুযোগ দিচ্ছে না। যা যা ভেবে বের করার কথা, তার সবই ভেবে রেখেছে, করে দিচ্ছে। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে জ্ঞান-বিজ্ঞান-বিনোদনের সমস্ত দুনিয়ার দরজা খুলে যায়। জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি, চিন্তনজগৎ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে ভোগ ও প্রযুক্তির ওপরে অতিমাত্রায় নির্ভরশীল মানুষ।মানুষের অস্তিত্ব এখন উপহাসতুল্য।
মানিক বন্দোপাধ্যায় (১৯০৮–১৯৫৬) তাঁর কথাসাহিত্যে সমাজ ও জীবনের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হিসেবে মানুষের কামতাড়িত জীবনাচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। হাসান আজিজুল হকের গল্পে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রভাব সুস্পষ্ট।তাঁর প্রথম গ্রল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ ও দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’–এর অধিকাংশ গল্পে যৌন সর্বস্বতাবাদে ধারাটিকে অল্প–বিস্তর অব্যাহত রাখলেও তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জীবন ঘষে আগুন’–এর পর থেকে সমাজবাদী ধারার গল্প লেখা শুরু করেন।
প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ও ‘কেউ আসেনি’।
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ এর প্রথম গল্প ‘শকুন’ এ তিনি সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন! শকুন গল্পটি যৌনতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে ও সমাজের অবক্ষয়ের মূল কারণ অর্থ রাজনৈতিক জীবনের নানা অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে লেখক তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন! সুদখোর শোষকেরা আমাদের সমাজে অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে পরিচিত!
শকুন যেমন মৃত প্রাণীর মাংস জীবন ধারণ করে থাকে, আমাদের সমাজেও তেমনি নিষ্ঠুর ধনিক শ্রেণী মৃতপ্রায় অসহায় দুস্থ মানুষের উপর তাদের নগ্ন থাবা প্রসারিত করে থাকে! গ্রামের কয়েকটি ছেলে দিনের আলোয় ফিরতে না পারা একটি শকুনকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে! তাদের মত্ততার কবলে পড়ে শকুন তার শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়! মৃত্যুর পূর্বে ছেলেরা খেলার ছলে তার গা থেকে একটি একটি করে সমস্ত পালক খসিয়ে নিয়ে তাকে অসুন্দরের প্রতিমূর্তি বানিয়ে ফেলেছিল!গল্পে শকুনটিকে অত্যাচারী বা নিপীড়নকারী প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে!
সুদখোর মহাজন সঙ্গে সাদৃশ্য অনুভব করেই তারা চরম প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে শকুন তার শরীর থেকে একটি একটি করে সমুদয় পালক খসিয়ে নিয়েছে!’ শোষক-বুদ্ধিজীবীদেরকে যে শকুনের মতো মনে হয় তা তারা তাদের ঘরে-বাইরের প্রতিবেশ থেকেই জেনেছে! তাই শোষণ লিপ্সু বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কইসো কোনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তাদের এত উল্লাস! গল্পে লেখক ‘শকুন শকুনের মাংস খায় না’-এই উক্তির মাধ্যমে তিনি সমাজের শ্রেণীবিভক্ত বাস্তবতাকে চিহ্নিত করেছেন!
‘তৃষ্ণা’ গল্পের প্রধান চরিত্রের জীবনে কোন স্বপ্ন নেই লক্ষ নেই শুধু যেন অক্ষয়ের স্রোতে সে ভাসমান! লক্ষ্যহীন জীবনে কখনো উদগ্র হয়ে ওঠে কামুকতা, কখনো নির্লজ্জ পেটুকতা! ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতীক হিসেবে অবধারিতভাবেই বাসেদকে জারজ সন্তান রূপেই অবতীর্ণ হতে হয়! প্রবল কামুকতা ও মাত্রাহীন পেটুকতার অতৃপ্ত জ্বালায় সর্বদায় তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে! অচরিতার্থ কামনা বাসনা তাকে বারংবার দিকভ্রষ্ট করেছে! সে পেটপুরে কোনদিন আহার করার সুযোগ লাভ করেনি! তাই সে স্বপ্ন দেখে তার চারপাশে সর্বদায় যেন ভুরিভোজনের আয়োজন চলছে!
বাসেদ শুধু পেটের খুদায় যন্ত্রণাকাতর হয়না, সে যৌনক্ষুদায় ও দারুণভাবে ছটফট করে! কিন্তু স্বাভাবিকভাবে সে ক্ষুধা মিটাতে হলে সমাজে বিয়ে করার যে রীতি প্রচলিত আছে তা তার পক্ষে সম্ভব নয়! কারণ সামাজিক জীবনে তার কোনো আর্থিক সংগতি ও মর্যাদা নেই! তাই অস্বাভাবিক পথ ধরেই বাসেদ তার যৌন ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য দুর্দমনীয় এক আবেগে ফেটে পড়ে!
গ্রামের মাতব্বরের ছেলে সোহরাব যখন মাত্র তিন আনার বিনিময়ে গ্রামের সখি নামের মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গমের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে, তখন বাসেদের সারা শরীরে কামাগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে! সে তখন মনে মনে চার আনায় সখিকে পাবার কল্পনা করে! কিন্তু সঙ্গমের পূর্বে বাসেদ এক পর্যায়ে শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকে!হাসান আজিজুল হকের গল্পের মধ্যবিত্ত মানুষেরা বিপর্যস্ত! জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে তারা হিমশিম খাচ্ছে অথবা আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে! ‘জীবনটা জীর্ণ ন্যাকড়ার মতো বাতাসে উড়ছে! সুকুমার হৃদয়বৃত্তি তাদের জীবনে প্রহসনের নামান্তর!’
‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ এর মধ্যেও ‘তৃষ্ণা’ গল্পের ন্যায় একই অসুস্থতা, একই বিকৃতি, একই বিবর্ণ ভবিষ্যৎ জীবনের পরিচয় ফুটে উঠেছে! মধ্যবিত্ত প্রায় প্রৌঢ় সতীনাথের অতৃপ্ত যৌন জীবন পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে পরস্ত্রী ভামিনীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কের নানা দিক এবং তার মানসিক বিকৃতি ও অস্থিরতার কাহিনী গল্পে উপস্থাপিত! প্রতিপত্তি ও প্রভুত ভুসম্পত্তির অধিকারী ব্যক্তির গ্রামীণ সমাজে অর্থের বিনিময়ে রক্ষিতা পুষতে পারে তার নিদর্শন সতীনাথ! ক্ষয়িষ্ণু সমাজের চারপাশের আবেষ্টনী এই গল্পের নায়ক সতীনাথ কে সুস্থ চিন্তার অধিকারী করেনি! কার বাবা মাও তাকে পরিশীলিত মানসিকতার অধিকারী করে গড়ে তোলার প্রয়াস নেই নি! চরিত্র হননের মধ্য দিয়ে তৃপ্তি লাভ কেই সে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে ধরে নিয়েছে!
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি আমাদের সমাজ জীবনের একটি পরিবারের অবর্ণনীয় বেদনা ও যন্ত্রণার কাহিনী। ইনাম, ফেকু ও সুহাস ক্ষয়িষ্ণু সমাজের তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে বৃদ্ধ কেশো–বুড়ো দুটো টাকার বিনিময়ে নিজের মেয়েকে তুলে দেয় সুহাস ও ফেকুদের কাছে।অর্থের বিনিময়ে নিজের যুবতী মেয়েকে যুবকদের হাতে সপে দেয়ার মধ্য দিয়ে বৃদ্ধের জীবনের চরম লজ্জা উন্মোচিত হয়েছে।
এরপর বুড়ো ইনামের সঙ্গে গল্প করতে বসে। এটা তার বাস্তব জীবনের গল্প।বুড়োটা গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর গল্প করতে, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে! আমি যখন এখানে এলাম, সে গল্প করেই যাচ্ছে, আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁপতে কাঁপতে বলছে–
‘সারারাত ধরে বলছে, আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম, আমি একটা করবী হাছ লাগাই বুঝলে? ফুলের জন্য নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ করবী ফুলের বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে’। আত্মজার যন্ত্রণাদগ্ধ অবস্থাকে ভুলে থাকার জন্য বুড়োরই বানানো গল্পের অবতারণা। সব মায়াই মিথ্যা হয়ে যায়, ভিতরে ভিতরে বিষ সঞ্চারিত হয়ে যায় বহুদূর। এক অনিবার্য মৃত্যুর ডাক শোনা যায় শুধু।
‘পরবাসী’ গল্পের পটভূমি নির্মিত হয়েছে দুই বাংলার হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের দাঙ্গার ইতিহাসকে আশ্রয় করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ খন্ডিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের স্নেহ ভালবাসায় চিড় ধরেছিল! সাধারণ মানুষকে একেক সময় তার নিজস্ব নীতিবোধ হারিয়ে ইতিহাসের সংকটের শিকার হতে হয়–সেটাও এক ধরনের অসহায়ত্ব।
শুধু অর্থনৈতিক চাপের সামনেই মানুষ যে অসহায় তা নয়, মূল্যবোধ নানাভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। বশির এরকমই প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হওয়া এক মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকট করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আকস্মিক আক্রমণের ভয়ঙ্কর ছোবলে তার ছাব্বিশ বছরের যুবতী স্ত্রী ও সাত বছরের ছেলেকে হারিয়েছে। হারিয়েছে তার চাচা ওয়াজদ্দিকে।গ্রামের কৃষিজীবী সাধারণ মানুষ ওয়াজদ্দি যখন তার বুদ্ধি ও বিবেচনার সাহায্য নিয়ে মন্তব্য করে ক তোর বাপ কটো? এ্যাঁ–কটো বাপ? মা কটো? একটো তো? দ্যাশ তেমনি একটো! বুইলি? এই অসাম্প্রদায়িক ও সুকুমার জীবনদর্শন নিয়েও ওয়াজদ্দিকে নির্মমভাবে নিহত হতে হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে!
সাধারণ মানুষ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে বলেই দেশ সম্পর্কে তাদের কোন সুস্পষ্ট ধারণা নেই। জন্মদাতা যেহেতু একাধিক হতে পারে না তেমনি দেশও একাধিক হতে পারে না। এই প্রগাঢ় বিশ্বাসে ওয়াজদ্দি বিশ্বাসী। জন্মভূমিকে তারা জন্মদাতার সমান বিবেচনা করেছে। দেশ সম্পর্কে এই বিশ্বাসের হলো অপমৃত্যু। মৃত্যুর বীভৎস্য তান্ডবলীলা দেখে বশিরের মন ভেঙে যায়। ‘বাড়িটা ততক্ষণে পুড়ে শেষ। ওরা চলে গেছে। বল্লম দিয়ে মাটির সাথে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ কালো একখণ্ড পোড়া কাঠের মতো পড়ে আছে ভাঙা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস–পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস বিষে ভারি।’
সব হারিয়ে বশির কোন মতে প্রাণ রক্ষার তাগিদে পাকিস্তানের পথে পা বাড়িয়েছে। চলার পথে এক সময় সে একটি শুকনো খালে আশ্রয় নিল। হঠাৎ খালের উঁচু পাড়ে ধূতি পরিহিত মানুষটিকে দেখার সাথে সাথে বশিরকে তাড়া করে আদিম প্রাগৈতিহাসিক নিষ্ঠুর হিংস্রতা। আগন্তুকটির বাঁক থেকে কুড়াল নিয়ে সে প্রচন্ড আঘাতে তাকে হত্যা করে।কিন্তু সীমান্তরক্ষীদের টর্চের আলোতে মৃত্যু যন্ত্রণাকাতর লোকটাকে দেখে বশিরের নিকট মনে হয় সে যাকে হত্যা করেছে সেই মুখ ঠিক যেমন ওয়াজদ্দির মুখ, রক্তাক্ত, বীভৎস তেমনই অবাক!গল্পে যে ট্র্যাজেডি, তা সাধারণ মানুষের ট্র্যাজেডি। ওয়াজদ্দি ও বসিরের আত্মোপলব্ধির নিকট বিবেকহীন ক্ষমতালিপ্সু মানুষের মূড়তা ধিক্কৃত হয়!
একজন যুবতী নারী তার অন্তরে প্রেমকে কতভাবে লালন করতে পারে দুরজ্ঞেয়, ছলনাময় ও রহস্যময় প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেই নারী তার প্রেমিককে কতভাবে খেলাতে পারে লেখক তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে হামিদা ও শাদু চরিত্রের মাধ্যমে ‘মন তার শঙ্খিনী’ গল্পে! হামিদা ও শাদু সমাজের নিম্ন শ্রেণির দুই যুবক যুবতী! দুজনের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে যায় হঠাৎ করে! হামিদা শাদুকে ভালোবাসে একথা নিজের মুখে বলার পর থেকে শাদু যেন বিশ্ব জয় করেছে এমন আনন্দে অধীর হয়ে পড়ে! সে হামিদাকে বিয়ে করার জন্য মনে মনে তৈরি হয়! কিন্তু এক্ষেত্রে শাদুর সংসারের অভাব বাদ সাধে! হামিদার দাদি সেই কারণেই হামিদার বিয়ে শাদুর সঙ্গে না দিয়ে ভিন গাঁয়ের ট্যারা নামের এক যুবকের সঙ্গে দেয়!
লোকটা দেখতে কুৎসিত হলেও তার জমি-জিরাত মোটামুটি ভালই ছিল! হামিদার বিয়েটা ট্যারার সঙ্গে হয়ে যাবার পর থেকে শাদুর জীবনে নেমে আসে অশান্তি আর অশান্তির জমাট অন্ধকার! শাদু হয়তো হামিদার বিয়েটাকে আস্তে আস্তে সহজভাবে মেনে নিতে পারত! কিন্তু হামিদা ট্যারার ঘর করতে যাবে না সে তার দাদির কাছেই থাকবে! এ কারণে শাদুর অশান্তি আরো বেড়ে যায়! হামিদা মাঝেমাঝে শাদুকে অধিক রাতে আহ্বান জানায়! তার প্রেমিক হিসেবে শাদু সে আহবানে সাড়া না দিয়ে পারে না! একদিকে হামিদার স্বামীর গৃহে যাবার ব্যাপারে অনীহা, অন্যদিকে রাতে শাদুকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এর কোনটাই শাদুর কাছে তেমন প্রীতিকর মনে হয় না! শাদু পরিষ্কারভাবে হামিদাকে জানিয়ে দেয়- ‘হয় স্বামীর ঘরে যা, নইলে তাকে তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে কর!’
হামিদা ওই প্রস্তাবে রাজি হয় না! হামিদা শাদুকে প্রেম দেয় আর তাকে নিয়ে নানা ভাবে খেলতে থাকে, এতেই তার আনন্দ! স্বামীর ঘরে না গিয়ে শাদুর সঙ্গে মেলামেশা করতে হামিদার নীতিবোধে একটুও বাধে না! শঙ্খিনী শ্রেণীর মেয়েরা পুরুষকে নিয়ে নানারকম লীলা করতে ভালোবাসে এবং যাকে ভালবাসে তাকে বিয়ে না করেও তারা নিঃসংকোচে দেহ দান করে! গল্পের শেষে হামিদা শাদুকে বলে-‘আজ যেচি আমি সোয়ামির বাড়ি, তোর ছেলে রইল আমার প্যাটে! খানিকটো শোধ দেলোম। গ্রামাঞ্চলের অভাবগ্রস্ত নারী ও পুরুষের জীবনে কামনা-বাসনার একটি বাস্তব চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন হামিদা ও শাদুর মধ্য দিয়ে!
‘জীবন ঘষে আগুন’ গল্পটির পটভূমি গ্রাম সংলগ্ন একটি মেলা! একটি গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও গল্পাংশ কে লেখক মিলিয়ে দিয়েছেন সমকালীন জীবনের স্পন্দনের সঙ্গে! শোষিত বঞ্চিত মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উজ্জীবিত হওয়ার গল্প ‘জীবন ঘষে আগুন!’ বাংলার ভূমিহীন তেঁতুল বাগদীদের যন্ত্রণাকাতর জীবনের সঙ্গে প্রাচীন উপকথাবহুল সংস্কার এবং সেই জীবন-সংগ্রামের যে দুর্জয় শপথ-এই উভয়বিধ রূপকে ঠিকভাবে চিনে নিতে না পারলে এ গল্পের মর্মোদ্ধার করা কঠিন! যুগ যুগ ধরে এই সব ভূমিহীন মানুষের জীবনে ধর্মের কাহিনী সমূহ বাঁচার অধিকার আদায়ের চেতনাকে দুর্বল করে দেয়! কিন্তু তাদের মনের মধ্যে থাকে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধ! সেই কারণেই ঐসব ক্ষুধিত বাগদী ক্ষুধার তাড়নায় একসময় ভন্ড ধর্মপ্রচারকের বিরুদ্ধে গর্জন করে ওঠে!
‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পটি একটি মহৎ পটভূমিতে রচিত। ভাগচাষী কৃষক করমালির কৃষকজীবনের সংগ্রাম মূলর একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এ গল্পে। করমালি একজন নিম্ন–মধ্যবিত্ত ভাগচাষী কৃষক। তার নিজস্ব তেমন জমিজমা নেই। বাড়ির বিল ঘেষে সামান্য কিছু জমি আছে তাও পতিত জমি। তেমন ফলন পাওয়া যায় না। তাই গ্রামের বিত্তবান লোকদের কাছ থেকে তাকে জমি নিয়ে বর্গাচাষ করতে হয। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, পুত্র–এই তিনজন পোষ্য নিয়ে তার সংসার।
আত্মজ রহমালি তার সমস্ত কাজকর্মের একমাত্র সহযোগী। সারা বছরে যা ফসল পায় তা দিয়ে তাদের দিনগুলো কোন রকমে কেটে যায়। আমৃত্যু আজীবন শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেই এক অমূল্য সম্পদ। মৃত্তিকা সংলগ্ন শুদ্ধ মানুষের অন্তহীন জয় পরাজয় ফুটে উঠে মানব ভাগ্যেরই অসহায় সত্য পরিণাম। গল্পটি দীর্ঘ পটভূমিকায় রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
‘সারা দুপুর’ গল্পে সমাজের নারী–পুরুষের অবক্ষয় ও অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কাঁকন। সে অনেক ক্ষেত্রেই যেন অসহায়। পিতার আদর থেকে বঞ্চিত কাঁকনের মনোজগত এবং মায়ের প্রতি জেগে ওঠা প্রবল ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে এই গল্পে। নিঃসঙ্গ দুপুরে কাঁকনের বেদনার্ত অন্তর্জগৎ উন্মোচন করেছেন লেখক এভাবে-‘সেই মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা ফিরে আসে। আহারে যদি মরে যেতাম–কত ভালো হতো–হয়তো হাঁসগুলোর মতো উড়তে পারতাম। তার বদলে দাদুটা মরে যাচ্ছে। হয়তো এক্ষুনি দাদু মরছে।
একটা বালিহাঁস খেতে চেয়েছিল দাদু। দাদু মরে গেলে চেয়েচিন্তে একটা বালিহাঁস খেলেও খেতে পারবে। এই সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ল কাঁকনের আর ওর বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইল। মা–টাও মরে গেছে বলে মনে হয় যে আমার! আব্বার সঙ্গে বিকেলে কি আর দেখা হবে? সেই মেয়েলোকটা কি আসবে?কাঁকন নামের একটি কিশোরের চোখ দিয়ে দেখা তার চারপাশের জগৎ, তার কালিমালিপ্ত অন্ধকার, নৈরাশ্য, আনন্দ এবং কৌতূহলের জিজ্ঞাসায় ঘেরা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের কথা এই গল্পে স্থান পেয়েছে। একদিকে মৃত্যুপথযাত্রী দাদু অন্যদিকে স্বামী পরিত্যক্তা তার নিজের মা, যার শয্যায় একদিন দেখতে পেয়েছে ফর্সা রঙের একজন মানুষকে, যার প্রতি অক্ষম ক্রোধে গুমরে মরে কাঁকন।
হাসান আজিজুল হকের আখ্যানবিশ্ব সময়ের বিচিত্র ও বহুস্তরের রূপান্তর এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে একটি পরিণতিতে এসে পৌঁছেছে। তাই চলমান বাস্তবতার প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেনি শুধু, প্রায়শ নতুন বিষয় হয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে লেখার পূর্বতন আঙ্গিকের পরিবর্তন এসেছে। নতুন বিষয়কে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের কারণে হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের বিষয় ও নির্মাণ-কৌশল পুনরাবৃত্তি-মুক্ত।হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির উদ্দেশ্য মানুষের সমগ্র জীবনকে স্পর্শ করা, নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করা, যতটুকু সম্ভব সবকিছুর ওপরে মানুষকে স্থান দেওয়া।
নিজের সমৃদ্ধি, সুন্দরভাবে বাঁচা আর অন্যদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলাই তাঁর লেখালেখির একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, একটি ভালো লেখা জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। সাহিত্য মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন করে। জীবনকে, পৃথিবীকে দেখার বা বিচার করার একান্ত নিজস্ব একটি দৃষ্টিকোণ তৈরি করে দিতে পারে; ভালোবাসা-ঘৃণা, গ্রহণ-প্রত্যাখ্যান, শত্রু-মিত্রের পার্থক্য নির্ধারণ করে দিতে পারে; সমাজের ভেতর-বাইরের প্রকৃত ছবি দেখিয়ে পরিবর্তনকে অপরিহার্য করে তুলতে পারে; সর্বোপরি, জীবনের পক্ষে মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাতে পারে।
সম্পূর্ণ বিকৃত, নষ্ট, পচনশীল, ভোগ-উন্মত্ত একটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেখানে জান্তবভাবে বাঁচার উন্মাদনায় নেশাগ্রস্ত, সেই সমাজে একমাত্র লেখকই থাকেন নিষ্ঠাবান, স্বার্থহীন, আপসহীন, পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়ানো এক কঠিন ব্যক্তিত্ব।আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের ধারায় নিজের অবস্থান অত্যন্ত সুসংহত করেছেন হাসান আজিজুল হক। ছোটগল্পের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই তাঁর গল্পে বিদ্যমান। তাঁর গল্প বলার ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, কাহিনী বিন্যাস ও আঙ্গিক সহজ ও সাবলীল। বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ, তাদের জীবনাচরণ, প্রান্তিক জনগণ, মৃত্যু, অদৃশ্য শক্তি ইত্যাদি তাঁর গল্পের উপজীব্য বিষয়। যা লিখেছেন, তার মধ্যে বেশীর ভাগ গল্পই শক্তিশালী ও বাস্তবকে আশ্রয় করে রচিত। হাসান আজিজুল হক মানিক বন্দোপাধ্যায় ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লারই সার্থক উত্তরাধিকারী।