পুনশ্চ: সমর্পণের জোছনাফুল
কোটি কোটি খনিজ আকরিক জ্বলছে সমুদ্রবিছানা, সি-বেডে। খনিজ নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে নিজেকে অর্ণব আবিষ্কার করল নিঃস্ব তারা রূপে। তারার আলো আছে এ-ই সান্ত¦না। নিঃসঙ্গতার গভীর থেকে আত্মতৃপ্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটে গেল সূর্যের আলো অধ্যুষিত পৃথিবীর সঙ্গে। আশার আলো ক্ষীণ থেকে প্রবলতর হতে লাগল। খনিজ পদার্থের অনুকণা থেকে ব্যাপক শক্তি বেরিয়ে ঢুকতে লাগল অত্যাধুনিক কমপিউটিং প্রযুক্তির সর্ববৃহৎ টানেলের মধ্যে। হিগস বোসন কণা আবিষ্কারে এ টানেল ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছে। এখনও এলএইচসি টানেলের ভেতর খনিজ শক্তির বিকিরণে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, কেটে যাচ্ছে দেশের সর্বগ্রাসী আঁধার। দুর্যোগ দুর্বল হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দেশের আকাশসীমা থেকে। বিপর্যয় কেটে যাচ্ছে দেখে উল্লসিত হয়ে চোখের মাইক্রোচিপের তরঙ্গও ঢেলে দিল নতুন টানেলের বিরাট সুরঙ্গের ভেতর। ঝলমল করে উঠল উর্বশীর অবস্থান।
হিকমত আবসারি ধরা খেয়েছে। মামলা জিতে গেছে উর্বশী আর চন্দনা। পত্রিকাগুলো তুলে ধরছে হিকমতের যত অপকর্মের চিত্র। উর্বশী আর চন্দনার ওপর লেপে দেওয়া কালিমা ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে আনন্দে আত্মহারা হলেও নিয়ন্ত্রণ হারাল না ওরা। অর্ণবও মনে মনে চাইল প্রকৃতির মতো, প্রকৃতির শুভ্রফুলের মতোই শুভ্র থাকুক উর্বশী। জগতের নিয়ম মেনেই আবার বিয়ে করুক সে। নতুন ভাবনার অণুকণা চক্ষুকোটরের কোণে আসন নেওয়া কান্নার উৎসস্থল ল্যাকরিমাল গ্ল্যান্ডে সংকেত পাঠিয়ে দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে একশ গুণ বেশি অশ্রুপাত ঘটতে লাগল হঠাৎ। নৈঃশব্দ্যের মাঝে শব্দময় কান্নার রোল ভেসে এলো।
কে? কে কাঁদছে? এখানে তো দ্বিতীয় আর কেউ নেই! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ধ্বনিটি ক্রমশ মিশে যেতে লাগল সমুদ্রের আওয়াজের সঙ্গে; কঠিন শিলাতল ভেঙেই কি বেরিয়ে আসছে নিজের অশ্রু? প্লাবিত করছে সাগরজল- বুঝল অর্ণব।
কান্নার আওয়াজ প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল উর্বশীর মস্তিষ্কেও। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মস্তিষ্ক থেকে ছুটে বেরুতে লাগল এ জন্ম আর পরজন্মে অর্ণবের হাতে নিজেকে সমর্পণের জোছনাফুল। চন্দন সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে চন্দন রোশনি। নক্ষত্রের সঙ্গে গ্রহের, গ্রহের সঙ্গ উপগ্রহের কক্ষপথে ঘূর্ণনের মতো ঘুরতে লাগল একে অপরের চারপাশে। নিজের কান্না বোঝার ক্ষমতা নেই অর্ণবের। তবে ওর এক মন উর্বশীর বিয়েতে রাজি হলেও রাজি হচ্ছে না অতল মনের আলোয় ডুবে থাকা অন্য মন!
উর্বশীর ঘরে ঢুকলেন তার বাবা-মা। ল্যাম্পপোস্টের আলোও ঢুকছে ঘরে। বেলকনির বাইরে নড়ছে নারকেল গাছের সবুজ পাতা। দোল খাওয়া পাতার মতো আচমকা নড়ে উঠল বুকের ঘরে বাড়তে থাকা রোপিত চারাগাছের শেকড়। শেকড়ের মূলে লুকিয়ে থাকা প্রণোদনাই নাড়িয়ে দিল বুকের ভিত।
মা বললেন, ‘তোমার বাবা বিশেষ একটি কথা বলতে চাচ্ছেন। আশা করি তাঁর কথা শুনবে এবং তোমার যৌক্তিক মতামত জানাবে! কী বলো?’
‘অবশ্যই শুনব। যৌক্তিক কথা অবশ্যই মানব।’ বলল উর্বশী।
বসে যাওয়া গলা ঝেড়ে উর্বশীর বাবা এবার বলতে লাগলেন, ‘একটা ভালো ছেলের প্রস্তাব পেয়েছি, তোমার বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে ওদের পরিবার। আশা করি ছেলেটার সঙ্গে কথা বলবে, বোঝার চেষ্টা করবে তাকে। তোমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই কিনা জানাবে আমাদের।’
আকাশের ওপর থেকে ঝরনার মতো ঝরে পড়ছিল জোছনা। মুগ্ধ হচ্ছিল সেই সুন্দরের পতন দেখে। বাবার কথা শোনার পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল আকস্মিক মিলিয়ে গেছে জোছনাপতনের নান্দনিক তরঙ্গমালা। ভরা জোছনা বুকে নিয়ে দূরাকাশে ফুটে থাকা কোমল চাঁদ কুয়াশায় ডুবে গেছে। চোখের মণি আঁধারে ঢেকে যেতে লাগল। আর তখনই চোখের মাইক্রোচিপে সংকেত ভেসে এলো, ‘প্রকৃতিকে মানতে হবে। চলমান সময় ফুরিয়ে গেলে আবেগের মূল্য থাকবে না। মেনে নাও বাবার প্রস্তাব, রাজি হয়ে যাও। একাত্ম হয়ে যাও সময়স্রোতের সঙ্গে। নইলে ফুরিয়ে যাবে দেহসম্পদ, ফুরিয়ে যাবে মনোসম্পদ। নিঃস্ব আর রিক্ত মানুষের পাশে কেউ দাঁড়াবে না, কেউ না। বিপদে কেউ এগিয়ে আসবে না তখন। সময় থাকতে তরীতে ওঠো। পাড়ি দাও নিষ্ঠুর সময়স্রোত, সময়সমুদ্র। শূন্য বৃত্তকে পূর্ণ করে তোল নতুন চাষাবাদের উর্বর শস্য বুনে।’
লোডশেডিং নেই! বিদ্যুৎ লাইন ঠিকই চলছিল। হঠাৎ শুরু হলো লোডশেডিং। ট্রান্সফর্মারও ঠিক আছে, জেনারেটরেও নেই কোনো ত্রুটি। তবু আলো নেই। উর্বশীর মন হাহাকার করে উঠল আলোর জন্য। আলোর তৃষ্ণায় শুকিয়ে যেতে লাগল গলা; ফেটে যাচ্ছিল চোখের মণি, কর্নিয়া গলে বেরিয়ে যাচ্ছিল চোখের ভেতর স্থান পাওয়া মাইক্রোচিপ।
অসহায় মুহূর্তে মর্মভেদী এক চিৎকার বেরিয়ে গেল উর্বশীর স্বরযন্ত্রে তীব্র কম্পন তুলে। সেই কম্পনে কেঁপে উঠল অর্ণব। অথচ সামনে বসা বাবা-মা শুনতে পেল না কোনো স্বর, মৃদু ধ্বনিও।
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পর আবার চোখ খুলল উর্বশী। সরাসরি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা কি আমাকে সুখী দেখতে চাও, না দুঃখী?’
‘সব বাবা-মায়ের মতোই আমরাও বাবা-মা। জেনেটিক কোড দ্বারা সংরক্ষিত রয়েছে আমাদের চাওয়া- সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কিছুই চাইতে পারে না কোনো বাবা-মা। আমরাও চাই আমাদের মেয়ের সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি।’
‘আমি তো সুখে আছি এখন। সামাজিক কালিমার অশ্লীল দূষণ থেকে মুক্তি পেয়েছি। তাছাড়া আমার সঙ্গে অর্ণব তো রয়েছেই বাবা! আর কী চাও?’
‘এটা তোমার অবাস্তব আবেগ। আবেগের শেকলে গিঁট খেয়ে আছো, তাই জীবনের প্রকৃত সত্য আঁধারে থেকে যাচ্ছে। সত্য উন্মোচিত করো। ছেলেটির সঙ্গে অন্তত একবার কথা বলো।’ বললেন উর্বশীর বাবা।
‘আচ্ছা বলব, যাও। তবে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ো না।’
খুশি মনে বেরিয়ে গেলেন বাবা-মা। আর উর্বশীর বুকের মাটিতে শেকড় গজানো চারাগাছটিতে অন্য রকম ঝড় বইতে শুরু করেছে। বাইরের দু’শ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ের মতো টের পাচ্ছে সে-ঝড়ের তাণ্ডব।
আশ্চর্য! প্রচণ্ড ঝড় উপেক্ষা করে শব্দ ভেসে আসছে। শব্দের তরঙ্গমালায় বর্ণগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে আবার জোড়া লেগে লেগে বলছে, ‘ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলো।’
‘কে? কে বলছো কথা? অর্ণব? তুমি, তুমি বলছো এমন কথা?’
উত্তর খুঁজে পেল না উর্বশী। কেবল বুঝল চন্দন সৌরভ ছড়িয়ে চন্দন রোশনি চারপাশ উজ্জ্বল করে শূন্য করে দিচ্ছে অর্ণবের আদিসত্তা। আলোর সত্তায়ও বয়ে যাচ্ছে আঁধারের প্রবল ঘূর্ণি। তবু অর্ণব ছড়াচ্ছে চন্দন রোশনি! সেই রোশনিস্রোত বুকে টেনে নিয়ে উর্বশী তাকিয়ে রইল গ্যালাক্সির আলোময় জগতের দিকে।
সমাপ্ত