স্প্যানিশ যোদ্ধা ফ্রান্সিসকো পিজারো ১৫৩২ সালে পেরুর কাজামার্কায় ইনকা সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন এবং ইনকার রাজা আতাহুয়াপাকে বন্দি করেন। বন্দি থাকাকালীনই ইনকা রাজা বুঝে গিয়েছিলেন, যেন তেন প্রকারেণ স্পেনীয় দস্যুরা তাঁকে হত্যা করবেই। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর যাই হোক না কেন, ওই লোভী দস্যুদের হাতে ইনকাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত পবিত্র সম্পদ তিনি কিছুতেই তুলে দেবেন না।
সিদ্ধান্ত তো নয়, সম্রাটের নির্দেশ বলে কথা। মুহুুর্তের মধ্যে লোকের মুখে মুখে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। ফলে লাখ লাখ রাজ্যবাসী তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। উত্তর কুইটো থেকে দক্ষিণ কাজকো পর্যন্ত, যেখানে যত সোনা, সোনার মন্দির ছিল, সব ভেঙে, উপড়ে নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন তাঁদের অগ্নিদেবতা এলসিঞ্জির উদ্দেশ্যে।
এলসিঞ্জি হল বিশাল এক আগ্নেয়গিরি। সেখানে পৌঁছে তাঁরা সব সোনাদানা ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন আগ্নেয়গিরির একদম সামনে একটি গভীর খাদে।
অলাম্বিয়া থেকে অলিভিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ইনকা সাম্রাজ্যের এক গুপ্ত বনপথ দিয়েই তাঁরা এই বিপুল সোনাদানা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্পেনীয় যোদ্ধা ফ্রান্সিসকো পিজারোর হাত থেকে তাঁদের দেশের যাবতীয় স্বর্ণ-সম্পদ রক্ষার জন্যই ইনকারা এমন একটি বিপজ্জনক বেপরোয়া কাজ করেছিলেন।
এই সব সোনার মধ্যে ছিল মূলত তড়িঘড়ি করে কোনও রকমে ভাঙা হাজার হাজার সোনার মন্দিরের টুকরো, ইট, মূর্তি এবং ইনকা রাজপরিবারের ব্যবহৃত হাজার হাজার সোনার থালাবাসন। এই সোনাগুলোর ওজন এতটাই হয়েছিল যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের পক্ষে বয়ে আনাটাও ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
তবু লুটেরাদের ভয়ে তাঁরা সেগুলো বয়ে এনে সবই ফেলে দিয়েছিলেন এলসিঞ্জির অগ্নিগহ্বরে। সময়ের স্রোতে আগ্নেয়গিরির লাখ লাখ টন ছাই আর শুকনো পাতার আস্তরণে এক সময় চাপা পড়ে গেল সেই মহামূল্যবান সম্পদ।
ইনকাদের বিশ্বাস ছিল, স্পেনীয় লুঠেরারা একদিন না একদিন ঠিক চলে যাবে। তখন ছাই আর আবর্জনার স্তূপ থেকে তাঁরা আবার তুলে নিয়ে আসবেন তাঁদের এই সোনা। আবার নতুন করে গড়ে তুলবেন তাঁদের ইনকা সাম্রাজ্য।
তার পরে কেটে গেছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনার প্রায় চারশো বছর পরে সেই লক্ষ লক্ষ টন সোনার খোঁজে এগিয়ে আসেন পেরুর এক পুরোতত্ত্ববিদ ড. কাটওয়ার রাইটার।
সেই আগ্নেয়গিরির কাছে পৌঁছনোর জন্য তাঁকে কী না করতে হয়েছে! দানবাকার কুমিরে ভরা একের পর এক নদী পেরোতে হয়েছে। ভয়ঙ্কর ঘন জঙ্গল পেরোনোর সময় শুধু হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের পাল্লাতেই নয়, তাঁকে পড়তে হয়েছে মানুষখেকো জংলি মানুষের খপ্পরেও।
মারাত্মক অনিশ্চিত এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক এই অভিযানে তিনি প্রতি পদে পদে মৃত্যুর একেবারে দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছিলেন। যখন ইনকাদের গুপ্তধনের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন, তখন তাঁকে সমস্ত আশা ত্যাগ করে একদম খালি হাতে ফিরে আসতে হল। কারণ, যেখানে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেটি ছিল ইনকাদের সেই অগ্নিদেবতা— এলসিঞ্জির জ্বালামুখ। আর যে গহ্বরে ইনকারা ওই সোনাগুলো ফেলে দিয়ে এসেছিলেন, তত দিনে সেই গহ্বরটাও ঢুকে গেছে ওই আগ্নেয়গিরি মধ্যে।