প্রফেসর শাহীন এম কবীর: এক অসামান্য আলোকবর্তিকা
প্রফেসর শাহীন কবীরের সাথে আমার প্রথম দেখা ২০০০/২০০১ সালে। আমার সে সময়ের কর্মস্থল, English Language Teaching Improvement Project (ELTIP) থেকে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজির পাঠ্যপুস্তক ভ্যালিডেশনের কাজ চলছিল। প্রফেসর শাহীন এম কবীর এলেন এই কাজের বিশেষজ্ঞ হয়ে।
সম্ভবত দশম শ্রেণির বইতে household chores শব্দযুগল ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি নিয়ে যত বিপত্তি। অনেকের কাছেই এটি একটি অজানা শব্দ ছিলো। তাই শিক্ষার্থীর জন্যে এটি ব্যবহার করা ঠিক হবে না বলে বেশিরভাগ উপস্থিত সদস্য মতামত ব্যক্ত করেন। Chores শব্দটি সেদিনের আগ পর্যন্ত আমার নিজের কাছেও অজানা ছিল। তবুও জানা শব্দ নয় বলেই সেটি পাঠ্যপুস্তকে দেয়া যাবে না এই মন্তব্যের সাথে আমি ভিন্ন মত পোষণ করে বলি – ‘এই অজানা শব্দটি আজ যেমন আমার জানা হলো, কাল শিক্ষার্থীদের জানা হবে। এরকম আরো অনেক অজানা শব্দ বা বিষয় জানার জন্যেই শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসে ও বই পড়ে’। আমার কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত হন একজন নারী অংশগ্রহণকারী যাকে আমি চিনতাম না। তিনি আমাকে অকুন্ঠ সমর্থন করলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এক স্নিগ্ধ চেহারার বিড়ালাক্ষী মানুষ, আন্তরিক হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ, সাদা-কালো জামদানি শাড়ি, আলতো করে বাঁধা খোঁপা। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেন আমার নাম। আরেকবার প্রশংসা করলেন এবং মনে হলো সেটি আন্তরিক। খুব ভালো লাগল তাঁর সবকিছু – জাস্ট সবকিছু। পরে সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম উনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক, শাহীন মাহবুবা কবীর, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা। এরপর তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি বেশ ক’বছর।
২০০৫ সাল। আমি তখন সরকারি কবি নজরুল কলেজের প্রভাষক। এনসিটিবি থেকে ডাক পড়লো ইংরেজির স্যাম্পল কোয়েশ্চেন প্রণয়ন করার জন্যে। আমি ও শাহীন ম্যাডাম নবম-দশম শ্রেণির জন্য কাজ করব। প্রথমে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। ম্যাডাম কত অভিজ্ঞ, কত বড় মাপের মানুষ! আমি তার সাথে তাল মেলাতে পারবো কি না সেই ভয় ছিলো। কিন্তু দু’একটি সিটিং দেবার পরেই আমাদের মাঝের বিভেদ রেখাটি মুছে গেল নিমেষে। আমাকে জয় করে নিলেন আপা। আর চিরতরে ম্যাডাম থেকে হয়ে গেলেন আমার অত্যন্ত প্রিয়, অত্যন্ত শ্রদ্ধার, অত্যন্ত আপনজন – আমার শাহীন আপা, আমার অভিভাবক।
প্রথমেই তিনি কাজ ভাগ করে নিলেন একদম আধাআধি। আমার মনে আছে – সাতটি আইটেম উনি লিখবেন, আর সাতটি আমাকে লিখতে বললেন। সেই শুরু হলো আপার সাথে আমার একত্রে কাজ করা আর যখন তখন যোগাযোগ। এই কাজ নিয়ে কতবার যে আপা তাঁর বাসায় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কাজ দেখেছেন, ভালো হলে অকৃপণ চিত্তে প্রশংসা করেছেন যেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের মাঝেই আমি অনুপস্থিত দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে কলেজের শিক্ষকেরা খুবই অচ্ছুত টাইপ। কিন্তু এই ছুঁৎমার্গ শাহীন আপার মাঝে আমি দেখিনি। আমাকে কোথাও পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি কখনো তাচ্ছিল্য করেননি। বরং বলেছেন – ও গৌতম, আমরা এক সাথে ইংরেজির কাজ করি। ‘আমার ভায়ের মতো’ বা ‘আমার ছাত্রের মতো’ – এসব বাহ্য পরিচয়ে তিনি আমাকে পরিচিত না করিয়ে আমার নিজস্ব পরিচয়েই পরিচিত করেছেন সকল সময়।
বর্ণিত কাজের অংশ হিসেবেই আমার লেখা Use of Idioms আইটেমটি তাঁর পছন্দ হলো না। ঠিক কী করতে হবে সেটি বোঝাতে আমার মনে হয় উনি এক মিনিট সময় নিয়েছিলেন। আমাকে তাঁর চমৎকারভাবে সাজানো বেডরুমে তাঁরই রাইটিং টেবিলে বসে তাঁর ছেলের পাঠানো ফুজিতসু ল্যাপটপে ওটা ঠিক করতে বলেন। আমাকে তিনি বলতেই পারতেন বাসা থেকে ঠিক করে আমি যেনো তাঁকে পাঠিয়ে দেই। উনি সেটি বলেননি কারণ তাতে কাজটা দেরি হতো। আবার এটি থেকেও মুক্ত হতে পেরেছেন যে বাইরের কাউকে বা সদ্য পরিচিত কাউকে বেডরুমে ঢুকতে দেয়া যাবে না।
এভাবেই আস্তে আস্তে শাহীন আপার সাথে আমার সখ্য বাড়ে। আমার সূত্র ধরেই সহকর্মী দীপক (অধ্যাপক দীপক কুমার কর্মকার) ও রুমা (শামসুন আক্তার সিদ্দিকী, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি)’র সাথেও আপার আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়। আমরা চারজনে ছিলাম একটি পরিবারের মতো।
২০০৫/৬ এর একদিন আপা ফোন করলেন। আমি ও রুমা তখন নীলক্ষেতে গাউসুল আজম মার্কেটে কোথাও কোনো আবেদন করার জন্য একটি অনলাইন ক্যাফেতে কাজ করছিলাম। কোথায় আছি ও কী করছি জেনে উনি আমাদের দুজনকেই আসতে বললেন কাজ শেষ করে। আপার বাসায় গেলাম যখন বোধ হয় দুপুর এগারোটা সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। আপার মন খারাপ। সেই একদিন মাত্র দেখেছি আপাকে একটু এলোমেলো, একটু মলিন। খেজুরের রস খেতে দিলেন যত্ন করে। তারপর কত গল্প, কত কথা! প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত। তাঁর জীবনের বিভিন্ন সংগ্রাম, টানাপোড়েন, সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প। তার কিছুদিন আগেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো একটি ঘটনার কারণে বিমর্ষ ছিলেন উনি। সবকিছু শুনে আমাদের মন ভার হয়ে যায়। আপা বললেন – ‘মনটা খারাপ ছিল। ভাবছিলাম কারো সাথে শেয়ার করা দরকার। তাই তোমাদেরকে ডেকে পাঠালাম’। একটু পরেই বিষাদময় মুখটা আলো ঝলমলে করে অন্য আলোচনায় চলে গেলেন।
শুরু হলো আপার বাসায় আমাদের আরো বেশি যাওয়া-আসা। কখনো কাজে, কখনো স্রেফ আড্ডা দিতে। আপা নিজ হাতে কফি বানিয়ে খেতে দেন। খুব ভালো কফি শপের বাইরে আজ পর্যন্ত আমি এত ভালো কফি কাউকে বানাতে দেখিনি। আর সন্ধ্যা হলেই গার্ডকে ডেকে খাবার কিনতে পাঠাতেন – কোনদিন কাবাব-নান, কোনোদিন চৈনিক খাবার, কোনোদিন একদম দেশি। কোন রেস্টুরেন্টের খাবার কেমন এটি ছিল তাঁর নখদর্পনে। এই আড্ডা থেকেই জেনেছি কত মানুষের কত গুণ, কত তথাকথিত বিশাল মানুষের মূর্খতা ও ভণ্ডামি। কিছুদিন পরে দীপককে একটা বই অনুবাদের কাজ দিলেন আপা।
আপার সাথে কথা হলো – একদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় কবিতা সন্ধ্যা হবে। অংশগ্রহণকারী ও শ্রোতা আমরা সেই ফোর মাস্কেটিয়ার্স – আপা, দীপক, আমি ও রুমা। পাঞ্জাবি পরে ঝোলা কাঁধে নিয়ে চলে গেলাম আপার বাসায়। আমার জীবনে সেই এক নাগাড়ে কাউকে ১২/১৪ টি কবিতা শোনানো। সাথে চিজ-এর টুকরো, পেস্তা, কাজু বাদাম, চা বা কফি। আমি থামতেই দীপক শুরু করলো আধুনিক গান। আপা বললেন – অনেকদিন গান করি না কিন্তু আজ তোমাদের এই আয়োজনে আমার খুব গাইতে ইচ্ছে করছে। তিনি গেয়েও ফেললেন ৩/৪ টি রবীন্দ্র সংগীত। আমরা মুগ্ধ। সন্ধ্যা থেকে রাত বোধ হয় সাড়ে নয়টা-দশটা পর্যন্ত থেকে শেষ করি সেদিনের আয়োজন।
কোনটি রেখে কোনটি বলবো! একদিন আপার বাসায় এলাম আমি, দীপক, রুমা। আপা বললেন – চলো, নাটক দেখতে যাই। যেই বলা সেই কাজ। শিল্পকলা একাডেমিতে গেলাম নাটক দেখতে। নাটক শেষ হলে আপার ইচ্ছে হলো বাইরে কিছু খাবেন। আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রেসক্লাবের সামনে এসে ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে বসি। সেখান থেকে রাত দশটা/সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের আড্ডা থামিয়ে বাড়ি ফেরা। আপার সাথে ঢাকার বাইরে শুধুই বেড়াতে যাবার যে পরিকল্পনা আপা অনেকবার করেছেন – সেই ইচ্ছেটি অপূর্ণই রয়ে গেলো।
দিনে দিনে দীপক আর রুমার সাথে আপার যোগাযোগটা কমে যায়। দীপক বদলী হয়ে চলে যায় পটুয়াখালী আর রুমার বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর কিছুদিন পরে সেও প্রবাসী হয় উচ্চ শিক্ষার্থে। কিন্তু আমার সাথে আপার যোগাযোগটা রয়ে যায়। পেশাগত কাজ বারবার আমাদেরকে একসূত্রে গেঁথেছে। এরপর ২০১১ সালে আপার সাথে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি শিক্ষাক্রমের কাজ করেছি। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, রাগারাগীও হয়েছে মাঝে মধ্যে। কিন্তু সবকিছু ঐ টেবিলেই শেষ।
২০১২ সালে আপার সাথে কাজ করি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের। আমি তখন নবীন টেক্সটবুক লেখক। সাথে ছিলেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ এম এম হামিদুর রহমান, মোঃ জুলফিকার হায়দার (বর্তমানে প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, সরকারি মুমিনুন্নিসা মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ), আর সেই সময়ে আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ ও প্রিয় সহকর্মী, সুরজিৎ রায় মজুমদার। Environmental disaster এর উপর একটা লেসন লিখে আপাকে দেখালাম। এনসিটিবির দ্বিতীয় তলার কনফারেন্স রুমের বাইরে টেবিলে বসে এটি পড়ার পর উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন – বলো, কতো মার্কস দেবো তোমাকে এই লেখার জন্যে। ভয় পেলাম। ভাবলাম নিশ্চয় পছন্দ হয়নি আপার। কিছুক্ষণ পরে আপা নিজেই আমার ম্যানুস্ক্রিপ্ট এর উপর কলম দিয়ে লিখে দেন ১০/১০। আমার চোখে জল আসার উপক্রম। সেদিন আরেকটি কথা বলেছিলেন তিনি – ‘এক সময় এসব কাজে ছিলাম আমরা ক’জন – প্রফেসর হামিদুর রহমান, প্রফেসর শামসুল হক, আমি’। এরপর এই ম্যাটেরিয়াল রাইটিং আর কারিকুলামের কাজে কেউ এগিয়ে আসেনি। মাঝখানে একটি দীর্ঘ বিরতি। এতো বছর পর এই তোমরা এগিয়ে আসছো – তুমি, জুলফিকার, সুরজিৎ। খুব ভালো লাগছে। লেগে থাকো। এই জায়গাটি একদম ফাঁকা। তোমাদের মতো মানুষ খুব দরকার’। সেই থেকে লেগেই আছি।
২০১২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীর ইংরেজির একটা বই লেখা হলো। বইটিতে অনেক অসঙ্গতি ছিল। যিনি এডিটর ছিলেন তাঁর নজরে সেগুলি আনার পরেও উনি তা অগ্রাহ্য করে বইটি অনুমোদনের জন্যে পাঠালে মন্ত্রণালয় বইটিকে আটকে দেয়।
তখন শিক্ষা সচিব ছিলেন – জনাব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। তিনি আপাকে দায়িত্ব দেন নতুন বই লিখতে। সময় ১৫ দিন। তার ভিতরে যেদিন আদেশ দেয়া হলো সেদিন বাদ। যেদিন বই জমা দিতে হবে সেদিনও বাদ। হাতে মাত্র ১৩ দিন সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিন সহ। আপা সচিব মহোদয়কে বলেন – তিনি দায়িত্ব নিতে পারেন যদি তাঁকে তিন জন মানুষ দেয়া হয় – জুলফিকার হায়দার, গৌতম রায়, আর সুরজিৎ রায় মজুমদার। কামাল স্যার রাজি হন। সচিব মহোদয়ের কক্ষ থেকে বেরিয়েই আপা ফোন দেন আমাকে – ‘ তৈরি হও, অনুমতি না নিয়েই তোমাদের তিনজনের নাম দিয়েছি। কাজটা করতে হবে, পারবে না? পারতেই হবে। জানি কষ্ট হবে। দেশের কথা মাথায় রেখে করে দাও কাজটা । আমি সাথে আছি তোমাদের’।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং বোধ করি বিশ্বের ইতিহাসে এটি একমাত্র পাঠ্যপুস্তক যা প্রণীত হয়েছিল মাত্র ১৩ দিনে। কখনো এনসিটিবিতে আমার ছোট্ট কেবিনের ভিতরে, কখনো আপার বাসায় ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা একত্রে কাজ করেছি। আপা প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন, পাল্টেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, নিজের লেখা পড়ে শুনিয়েছেন, মতামত নিয়ে সেগুলি নতুন করে লিখেছেন। তাঁর মাঝে কোনো ইগো দেখিনি এবং আমাদের অবাক করে দিয়ে বইয়ের ইনারে উনি লেখক ও সম্পাদক হিসেবে আমাদের সকলের নাম জুড়ে দেন এই যুক্তিতে যে আমরা সবাই সবার লেখা এডিট করেছি ঐ কাজে। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের অন্য কোনো বুদ্ধিজীবী এত অল্প সময়ে এরকম একটি কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস রাখতেন। এতটা উদার ও যৌক্তিক হতে পারতেন।
এই আমাদের শাহীন আপা। তাঁকে নিয়ে আরো অনেক কিছু বলা বাকি রয়ে গেলো যা বলবো আগামী পর্বে।
(চলবে)