পর্ব – চব্বিশ: কঠিন শিলাতলে আধা তরল মেটল স্তর
নিজেকে নতুন পরিবেশে আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে গেল অর্ণব। সাগরতলের অথই জলধারা জুড়ে তরল মাটির স্তর পেরিয়ে এ স্তরে কীভাবে এসে পৌঁছুল ও? বোঝার জন্য উপরের দিকে তাকিয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করল ও। এ কি !
চারপাশে রয়েছে শিলাখণ্ড নির্মিত ঘের। শিলাস্তর ফুঁড়ে বেরুতে পারছে না নিজের আলোক তরঙ্গমালার ঢেউ। সংযোগ পাচ্ছে না, এমনকি অনুভবও করতে পারছে না উর্বশীকে। তার স্মৃতিকণা মস্তিষ্কে তুলছে বেপরোয়া ঘূর্ণি। ঘূর্ণির দাপটে অস্বস্তি লাগছে, অস্থিরতা বাড়ছে- আবেগ-সলতেয় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আগুন তাপে গলে যেতে লাগল শিলাস্তরে আবদ্ধ আধা তরল মেট্ল স্তর। কিছুক্ষণ পরই অনুভব করল এ কঠিন পাষাণতলেও রয়েছে বিপুল জলধারা-আরেকটি মহাসাগরের পানির চেয়ে বেশি পানির অস্তিত্ব এখানে আবিষ্কার করার কারণে উল্লাস জেগে উঠল মনে। বুঝল কঠিন শিলার বুকেও থাকে তরল পানির ধারা। দেশের রাজনৈতিক কঠিন সংঘাতময় শিলাতল থেকেও নিশ্চয়ই কোমল আর ফল্গুধারা বেরুবে- নিশ্চয়ই সংঘাত কেটে যাবে- শিলাস্তর ঠেলে বুদবুদ আকারে এমন ভাবনা ছুটে সাগরমুখী জলস্রোতে মিশে যেতে লাগল। ভেবেছিল দ্রুতই সংযোগ পেয়ে যাবে উর্বশীর সঙ্গে। এখনও সংযোগ স্থাপিত হয়নি। বরং বিস্ময় নিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখল সাত বস্তা বুদবুদ শঙ্কার ঢেউ ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
অর্ণবের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর পর বস্তা বুদবুদের প্রধান বলল, ‘তোমার কাছে আবার ফিরে এলাম আমরা!’
‘ওঃ! তাহলে সেই সাত জন তোমরা? নারায়ণগঞ্জের গুমকাহিনির আড়ালের খুন হয়ে যাওয়া সাত লাশ!’
‘খুন করে পানিতে বস্তা বেঁধে ফেলে দিলেই কি বিলীন হয়ে যায় সবকিছু? লাশ বানানো যায় কি ইতিহাস?’
কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করল অর্ণব। চোখ খুলেছে। কিন্তু চোখের কর্নিয়াতে আসন নেওয়া মাইক্রোচিপ সচল হলো না। প্রধান বুদবুদবস্তার কথার পিঠে কথা বলা যায় কিনা ভাবতে লাগল। এমন সময় দ্বিতীয় বস্তার মুখ খুলে গেল আপনাআপনি। বুদবুদ ছড়িয়ে যেতে লাগল। সেই বুদবুদ থেকে বেরুতে লাগল ভিন্নরকম আলোর কণা। এই বুদবুদ বস্তা জানান দিল, ‘দেহে পচন ধরেছে, বুদবুদে পরিণত হয়েছি আমরা। এ বুদবুদ হচ্ছে আলোর কণার উদ্ভাস। এই আলোর কণা মিশে গেছে গ্যালাক্সির সীমাহীন পরিধিতে। তুমিও যেমন দেহত্যাগী আত্মা, আলোর কণারূপে চষে বেড়াচ্ছ সাগরতল, সৌরজগৎ আর এই কঠিন পাষাণ শিলাতল, আমরাও তেমনি এখন ঘুরে বেড়াতে পারি সর্বত্র। পার্থক্য এই- তোমার মধ্যে আবেগ আছে। ভালোবাসা আছে। তাই তোমার আলোর দেহ আশ্রয় পেয়েছে সাগরতলে। সর্বত্র চষে বেড়াতে পারছো। তবে কঠিন শিলায় বাধা পেয়ে হাঁসফাঁস করছো। কিন্তু আমাদের বুদবুদ দেহে আবেগ নেই বলেই পাষাণতল আমাদের কাঁপিয়ে দিতে পারেনি। বরং বিপদগ্রস্ত তোমার পাশে ছুটে এসেছি উদ্ধার করতে।’
‘কীভাবে বুঝলে যে আমি বিপদগ্রস্ত? কেনইবা এলে উদ্ধার করতে?’
প্রধান বুদবুদবস্তা আবার জবাব দিল, ‘তোমার বুকের কান্না বুদবুদ তুলেছে। তোমার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বুদবুদ আমাদের বোধের জগতে সংকেত পাঠিয়েছে। এ বিপদে তোমার পাশে দাঁড়ানো বড় কাজ মনে করেছি। তাই ছুটে এসেছি আমরা।’
‘বিপদ তো কেটে যাচ্ছিল আপনাআপনি। সাগরের স্রোতের সঙ্গে আবার সংযোগ ঘটে যাচ্ছে আমার।’
‘এত সোজা মনে কোরো না, সব সমস্যার এত সহজে মীমাংসা হবে না। তোমার সাগরতলের পানির অণুতে রয়েছে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণুর মিলন প্রবাহ। আর কঠিন শিলাতলের ভেতর জমা পানির অণুতে আছে একটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণুর মিশ্রণ। দুই পানির ধার কি একরকম? না। এক এক মিলে দুই হলে উভয়ের মধ্যে সংঘাত ঘটলে, মীমাংসা হওয়া কঠিন। তখন ভোট হলে দুজনই জিতবে। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। পরমাণুর সংখ্যা বেজোড় হলে একপক্ষের জেতার সম্ভাবনা থাকবে, গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। গণতন্ত্র রক্ষা না পেলে তোমার ভালোবাসার মানুষ, যে ঢাকা শহরে বাস করছে, তার সংকট কাটবে না। উদ্বেগে থাকবে সে। সেই উদ্বেগ সঞ্চারিত হবে তোমার বুকেও। কীভাবে তুমি সুখী হবে, বলো?’
প্রধান বুদবুদবস্তার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল অর্ণব। মনে মনে ভাবল ওরা দেখছি আমার চেয়েও বেশি শক্তির অধিকারী। সব বলে দিতে পারছে।
তৃতীয় বুদবুদবস্তা বলল, মেরে গায়েব করে দিয়েছে খুনিরা আমাদের। আমাদের আত্মা দেহত্যাগ করে মিশে গেছে আলোর কণারূপে। এখন সর্বত্র বিচরণ করতে পারি। দেখো, কান্নার ধ্বনি শুনছি এখন আমি। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ সে কান্নার আওয়াজ?
‘না। পাচ্ছি না। আমার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে বাস্তব জগতের সঙ্গে!’
‘তাহলে শ্বাস হিসেবে টেনে নাও আমাদের হৃদয়ের ধ্বনিত হওয়া সেই আওয়াজ।’
সেই আওয়াজ টেনে নিল অর্ণব। তখন শুনল এক শিশুর করুণ কান্নাধ্বনি।
‘কে? কে কাঁদছে?’ প্রশ্ন করল অর্ণব।
‘আড়াই বছরের শিশু সাফিরের কান্না শুনছো তুমি। সেই কান্না থামানোর চেষ্টা করছে সবাই, মানছে না সে। নারায়ণগঞ্জে বাসে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে দিয়েছে ঘাতকরা। পুড়ছে সাফির। কাঁদছে সে।’
‘কীভাবে থামবে এ কান্না?’
‘শিলাস্তর ভাঙতে হবে। কঠিন অবস্থান শিথিল করতে হবে উভয় দলকে। তাহলেই থামবে ঘরে ঘরে কান্নার রোল।’ বলল চতুর্থ বুদবুদবস্তা।
‘কীভাবে ভাঙবে শিলাস্তর? কীভাবে আরেকটি অণু যুক্ত হবে হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে? কীভাবে তরল হবে রাজনীতির ভূ-গর্ভে আটকে পড়া আধা তরল মেট্ল স্তর?’
‘সমঝোতা আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে কান্নার রোল ছড়িয়ে যাবে।’
‘এ ক্রন্দন দেখতে চাই না। ফেরত চাই আমি আমার স্বচ্ছ জলধারা, বিস্তীর্ণ জগতে ঘুরে বেড়াতে চাই অবাধে।’
‘অবাধে চলতে গেলে বাধা খেতে হবে, বাধা আছে জেনেই অগ্রসর হতে হবে।’ সমস্বরে বলতে বলতে সাতবস্তা বুদবুদ মিলিয়ে গেল কঠিন শিলাস্তরের ভেতর।
চিৎকার করে অর্ণব বলল, ‘আমি চাই মুছে যাক ছোট্ট শিশুর কান্না। লাঘব হোক তার যন্ত্রণা। মায়ের কোলে উঠার তার আবদার পূর্ণ হোক।’
জবাব পেল না অর্ণব। বুদবুদবস্তা সরে যাচ্ছে দূরে। তবে যাওয়ার সময় নিজেদের বুদবুদ কণায় প্রতিসরিত করে গেল পেট্রলবোমায় পোড়া সাফিরের বাস্তব দেহরূপ। মাথা, মুখ, দুই পা আর ডান হাত পোড়া প্রায় গোটা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া দেখে বুকের ভেতর থেকে বেরুতে লাগল গোপন বিলাপ। এ বিলাপ সংযুক্ত হয়ে গেল জাভার সাগর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ১১ মাস বয়সী শিশুর ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে। বাস্তবের বিলাপ আর সাগরতলের বিলাপের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখের ছবি সর্বত্র একই রকম। তবে কি জলে-স্থলে কোথাও থামবে না ধ্বংস আর কান্নার রোল?
দিশেহারা অর্ণবের বুক ফুঁড়ে এবার বেরুল নতুন এক জৈবরাসায়নিক উপাদান। উর্বশীর জন্য বুকের শিলাকূপে জমা করে রাখা গোপন ঐশ্বর্যের অন্তহীন কূপ থেকে বুদবুদ উঠল, হাইড্রোজেন পরমাণুর ঝাঁক ছড়িয়ে যেতে লাগল। এ হাইড্রোজেনের একক পরমাণু এই শিলা স্তরে যুক্ত হতে পারবে আরেক হাইড্রোজন পরমাণুর সঙ্গে। এইচটুও (ঐ২০) হিসেবে উপহার দেবে স্বাভাবিক পানির অণু! যুক্ত হওয়ার সময় প্রবল সংঘর্ষে নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে সেঁটে থাকা নিউট্রন আর প্রোটনের ভেতর থেকে এ সময় বেরিয়ে আসতে পারে গ্লুয়ান দিয়ে জোটবাঁধা কোয়ার্ক। এমন ভাবনায় উত্তাপ সংঘর্ষ ঘটিয়ে দিল দুটি পরমাণুর মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে শিলারতলের লুকানো বিশাল পানির উৎস আধা তরল মেট্ল স্তরে ঘটে গেল মহাপ্রলয়। চুরমার করে ভাঙতে লাগল জমাট শিলা- তরল পানির স্রোত ছুটে এসে মিশে যেতে লাগল রসায়নের মূল সূত্রপথে- তরঙ্গায়িত হতে লাগল এইচটুও-র নৃত্য। তখনই সংযোগ পেয়ে গেল অর্ণব। দেখল উর্বশীকে।
উর্বশীর চোখ বিষাদঘণ্টা রূপে পাঠাচ্ছে করুণ ধ্বনি। বিষাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে তার চারপাশে, আকাশে-বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে হতাশার সুর। অবরোধ প্রতিরোধের মুখে পুড়ছে দেশ, আর ধমক-পাল্টা ধমক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সত্যলোকে, জলজ জীবনেও- নাশকতাকারীদের দেখামাত্রই গুলি করার কথা ঘোষিত হচ্ছে, বিচার নয় পাড়ায়-মহল্লায় তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। নাশকতাকারীদের ধরিয়ে দিলেই পুরস্কার দেওয়ার অঙ্গীকার দেওয়া হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা এবং অবরোধের পাল্টা ঘোষণায় কমছে না উদ্বেগ, ধোঁয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে পুরো দেশ।
উর্বশীকে উদ্দেশ্য করে চন্দনার মা বললেন, ‘এ সময় কি পথে বেরুনো ঠিক হবে? মামলা-মোকদ্দমা চালাতে গিয়ে জীবন দিতে হবে রাস্তায়?’
উর্বশী একবার বলতে যাচ্ছিল, মিথ্যা খবর রটানোর কারণে চন্দনা ও আমার তো সামাজিক মৃত্যুই ঘটেছে। মিথ্যার খোলস ছিঁড়ে ফেলতে হলে কি মামলায় জিততে হবে না? ঝুঁকি নিতে হবে না?
‘চাকরি প্রলোভনে তো একবার ঝুঁকি নিয়েছিল, ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসেছে চন্দনা, কিছুটা সুস্থ হয়েছে ঠিকই, ওর মনের ক্ষত কি সুস্থ হয়েছে? দুর্নামের পাহাড়সমান চাপ থেকে কি মুক্তি ঘটবে ওর, এ জীবনে?’ প্রশ্ন করলেন চন্দনার মা।
‘কেন মুক্তি ঘটবে না? অন্যায় করেছে অপরাধীচক্র; অন্যের অপরাধের বোঝা কেন সে বয়ে বেড়াবে, কেন ছুড়ে দেবে না নর্দমায়?’
উর্বশীর শেষের কথা ঢুকল চন্দনার কানে। মায়ের উদ্দেশে বলল, ‘ওরা আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, প্রতিরোধের মুখে মুখ চেপে ধরেছিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল খাদে, বেঁচে আছি। তবে পতিতা হিসেবে বদনাম রটিয়েছে। আমি কি ডিম না দুধ যে ওদের মিথ্যা রটনায় পচে যাব, নষ্ট হব?’
যেখানেই যাচ্ছিল, সেখানেই দুর্নামের গন্ধ শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। এই মুহূর্তে চন্দনার কথা শুনে জীবনের শুভ্রতা আর স্বচ্ছতা নিয়ে উর্বশী জড়িয়ে ধরল তাকে। আর তখনই অলৌকিক একক সিগনালে এইচটুও-র প্রবল জোয়ারে ভিজে যেতে লাগল, ভূ-গর্ভস্থ কঠিন শিলাস্তর ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে সংযোগ ঘটে গেল। নিউক্লিয়াসের গ্লুয়ান আঠার মতো জোট বেঁধে গেল পরমাণু কণার। শুভ্র জলে নতুন তরঙ্গ উঠল, নেচে-গেয়ে তরঙ্গকণা উড়ে যেতে লাগল ধনুক শিখায় ভর করে আকাশেÑ এলএইসির বৃত্তাকার টানেলে আছড়ে পড়ে সুপারসনিক উজ্জ্বল আলোর বিকিরণ ঘটাতে লাগল। সেই আলো সাহসের ভিতেও এঁটে দিল গ্লুয়ান আঠার বন্ধন। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উভয়ে ঘোষণা করল, ‘বিচার চাই। অপরাধীকে ছাড় দেওয়া যাবে না।’
তাদের দৃপ্তপ্রতিজ্ঞার আলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে।
চলবে…