একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আর নেই। আজ সোমবার (১৫ নভেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে ৯টায় রাজশাহী মহানগরের চৌদ্দপাই বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের সাবেক চিকিৎসক ডা. মির্জা ওয়াজেদ হোসেন বেগ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। পরে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং পাকিস্তান সেনার হাতে নির্যাতিতও হতে হয় তাঁকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন।
তিনি ছিলেন এশিয়া মহাদেশের অন্যতম একজন ঔপন্যাসিক ও সেরা ছোটগল্পকার। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কথাসাহিত্যিক তার মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি। আগুনপাখি (২০০৬) তার রচিত প্রথম উপন্যাস।
১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’ গল্প প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি একজন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে পরিগণিত হতে থাকেন। অচিরেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সব পত্রিকায় তার ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে। ‘পূবালী’, ‘কালবেলা’, ‘গণসাহিত্য’, ‘ছোটগল্প’, ‘নাগরিক’, ‘পরিক্রম’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘পূর্বমেঘ’ প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন।
১৯৬৩ সালে সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় সন্দীপন গোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে হাসান আজিজুল হক যুক্ত হন। হাসান আজিজুল হক এই সময় সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সাথে যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন ‘সন্দীপন’ শীর্ষক একটি সাহিত্য পত্রিকা। ষাটের দশকের প্রথম দিকে নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশীদ প্রমুখ সংগ্রামী কয়েকজন তরুণের চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’।
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’-এর প্রথম গল্প ‘শকুন’-এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ও ‘কেউ আসেনি’।
১৯৬০ সালে বৃত্তায়ন নামের একটি উপন্যাস লিখলেও হাসান নিজেই এর বড় সমালোচক। এ রচনাকে তিনি নিজেই উপন্যাস হিসেবে অস্বীকার করে থাকেন। তবে ‘আগুনপাখি’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। এ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ’সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। ‘শিউলি’ নামে আরও একটি ছোট উপন্যাস তিনি লিখেছেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
চির বিশ্রামে থাকুন। চির শান্তিতে থাকুন।