সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারের ক্ষেত্রে নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে ধারা রয়েছে, সেই ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ধারাটি বাতিলের প্রস্তাবসহ আইনের সংশোধনী বিল আগামী জানুয়ারি মাসে সংসদের অধিবেশনে উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শুক্রবার বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এ কথা জানান।
ঢাকায় রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলায় আসামিরা খালাস পাওয়ার ঘটনায় নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বিতর্কিত ধারাটি বাতিলের দাবি আবার সামনে এনেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো আইনের বিতর্কিত ধারাটির কারণে কোনো নারী ধর্ষণের অভিযোগ তুললে, সেই নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তাকে দুশ্চরিত্র প্রমাণের সুযোগ রয়েছে।
ঢাকার বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুজন তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলায় চার বছর পর এখন এসে আদালতে আপন জুয়েলার্সে ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন আসামির সব ক’জনই খালাস পেয়েছেন গত বৃহস্পতিবার। তাদের খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ার কথা বলেছেন আদালত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা দায়ের করে মেডিকেল পরীক্ষা করানো হয় এবং তাতে অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। আদালত ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এই রায় এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ ক্ষুব্ধ করেছে নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের। এখন তাদের বিভিন্ন সংগঠন সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনের বিতর্কিত ধারা বাতিলের দাবিতে নতুন করে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তারা ধারাটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলেছেন, বিভিন্ন সময় সরকার এই আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
তবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, ‘এই ধারা বাতিলের পাশাপাশি আমরা সাক্ষ্য আইনে আরও কিছু বিষয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। সেজন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন হচ্ছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, সংশোধনী প্রস্তাবগুলো তৈরির জন্য নভেম্বরে সংসদের আসন্ন অধিবেশনে তারা তা উত্থাপন করতে পারছেন না। তারা সংশোধনী বিল জানুয়ারি মাসে সংসদের অধিবেশনে উত্থাপন করবেন।
সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে ধর্ষণের বিচারের ব্যাপারে বিধান যেমন রয়েছে, তেমনি হত্যাকাণ্ডসহ সবধরনের ফৌজদারি অপরাধের বিচারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধারা আছে।
ধর্ষণের বিচারের ধারা নিয়ে কেন আপত্তি
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন, যৌন নির্যাতনের বিচারের ব্যাপারে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে যে ধারা রয়েছে, সেখানে আইনগতভাবেই ধর্ষণের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্র্রে অভিযোগকারী নারীকেই দুশ্চরিত্র প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। তারা আইনের এই ধারা বাতিলের দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পদযাত্রাও করেছেন।
এই আন্দোলনকারীদের অন্যতম একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেছেন, এ ধরনের বিধানের কারণে যৌননিপীড়ককেই রেহাই পাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সেজন্য তারা এর বাতিলের দাবিতে আন্দোলন নেমেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আসলে একজন ভিকটিম ন্যায়বিচার পাচ্ছেন কি না তার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার চরিত্র। মানে রাষ্ট্র সেটা বলেই দিচ্ছে যে একজন নারী যদি দুশ্চিরত্রের হন, তাহলে তারসাথে এ ধরনের অন্যায় হতেই পারে। এখানে নিপীড়ককে আইনগতভাবেই আশ্রয় নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিনী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্র নারী।’
আদালতে অপমানজনক প্রশ্ন
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ধর্ষণের শিকার বা নির্যাতিত নারীদের আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকে। সংস্থাটির এই কর্মসূচির প্রধান নীনা গোস্বামী ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের আইনগত সহায়তা দেওয়ার তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে যেহেতু ধর্ষণের শিকার নারীকে দুশ্চরিত্র দেখানোর সুযোগ আছে, সেজন্য ধর্ষণের মামলায় তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার প্রক্রিয়া-প্রতিটি ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রত্যেকে এই সুযোগ নিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, আইনের সুযোগ নিয়ে আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে তার চরিত্র নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এমন সব প্রশ্ন করেন, যা অপমানজনক হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, ধর্ষণের ঘটনায় অন্য সাক্ষ্য প্রমাণের থেকে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর চরিত্রের বিষয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যই তারা এই ধারা নিয়ে আপত্তি করে আসছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা