আজ থেকে ২২ বছর আগে নাটোর তখন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীর অভয় অরণ্য ছিল। সন্ত্রাস চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের ২২ বছর অতিবাহিত করে ২৩ বছরে পদার্পণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- সংগঠনটির প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি বরং বেড়েছে। সন্ত্রাসের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ এবং সামাজিক আন্দোলনে প্রয়োজন লাঠি-বাঁশি। ১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর জন্ম হয় কেন্দ্রীয় সন্ত্রাস চাঁদাবাজ প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিষদ।
টেরাক বা ‘লাঠি-বাঁশি’।প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা আব্দুস সালাম হন এর সভাপতি।এরপর ব্যবসায়ীরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকেন। ২০০০ সালের ৬ মে মাসে সন্ত্রাসীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে লাঠি-বাঁশি কমিটির স্টেশন বাজার কার্যালয়ে হামলা করে।
সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া গুলিতে কিশোর শ্রমিক মোহন ঘটনাস্থলে নিহত হন। এছাড়া শতাধিক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হন। মোহনের মৃত্যুতে নাটোরবাসী ফুঁসে ওঠে। ব্যবসায়ীরা পিছু না হটে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।
এরপর অবিরাম ধর্মঘট, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সভা-সেমিনার হয়। সন্ত্রাসীরা নিজ গুহায় প্রবেশ করে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লাঠি-বাঁশি এই সফলতার খবর ছড়িয়ে পড়ে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় লাঠি-বাঁশি কমিটি গঠিত হতে থাকে। ৩৫ টি ইউনিটে গঠিত হয় লাঠি-বাঁশি কমিটি।
লাঠি-বাঁশির কার্যক্রম নিয়ে রচিত হয় গণসংগীত। নির্মিত হয় টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্র। ব্যবসায়ীসহ সাধারণ নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।বিশ্বের প্রায় ২৬টি দেশ থেকে স্বীকৃতি পায় লাঠি-বাঁশি।
কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। ব্যবসায়ীদের সংগঠন ছাড়াও পাড়ায়-পাড়ায় গঠন করা হয় মহল্লা কমিটি। সন্ত্রাস দমনে সফল হওয়ার পর লাঠি-বাঁশি কমিটির বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ড শুরু করে।
টেরাক‘এর পক্ষ থেকে নাটোর জেলার প্রায় দেড় লাখ প্রতিবন্ধীর জন্য ‘প্রতিবন্ধীদের প্রটেক্টিভ হেলপ’ হিসেবে ছাগলের বাচ্চা বিতরণ করা হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধের সৃষ্টির জন্য গঠিত হয় টেরাক ইমাম মোয়াজ্জিন পরিষদ।
সংগ্রামের সঙ্গে মহিলাদের সম্পৃক্ত করতে টেরাক মহিলা পরিষদ গঠন করা হয়। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত হয় টেরাক সংস্কৃতি পরিষদ। ফ্রী প্রাইভেট ক্লিনিক‘এর মাধ্যমে গরিব অসহায় মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা পায়। এছাড়া তৈরি হয় একটি হাসপাতাল।
লাঠি-বাঁশির কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে বিবিসি লন্ডনের গণমাধ্যমকর্মী এসেছিলেন, প্রতিষ্ঠার সভাপতি আব্দুস সালাম‘এর সাক্ষাৎকার নিতে।অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গের পদধূলি পড়েছিল নাটোরে।
যাদেরকে আমন্ত্রণ করে আনা খুব সহজ বিষয় ছিল না। এই অসাধ্যকে সাধন করেছিলেন আব্দুস সালাম। তার কারণে নাটোরবাসী স্বচক্ষে তাদেরকে দেখেছিলেন এবং নাটোরবাসী স্মৃতিতে আজও তা অমলিন।
এত সফলতার পর রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে লাঠি-বাঁশির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আব্দুস সালাম। বিএনপি সরকারের আমলে আব্দুস সালামকে বাদ দিয়ে এর পকেট কমিটি গঠন করা হয়।
বিএনপির নেতা এবং তাদের আত্মীয় এর নেতা হয়ে ওঠে।ধীরে ধীরে কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। সেসময় নাটোরের পাশেই বাগমারায় উত্থান হয় বাংলা ভাইয়ের। সরকার বদলের পর কিছুটা পরিবর্তন হয়। ফের শুরু হয়েছে লাঠি-বাঁশির কার্যক্রম
এ ব্যাপারে সাংগঠনিক সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, ‘বাধা প্রতিনিয়ত আছে। বাধা আসবেই তবুও সমাজের জন্য, মানুষের নিরাপত্তার জন্য, আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। লাঠি-বাঁশির কার্যক্রম চালানোর জন্য আহাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিলাম।
উনি বলেছিলেন আপনারা যদি করতে চান করেন। তখন পুলিশ সুপার ছিলেন কাইয়ুমুজ্জামান। এসপিকে বলে দেওয়া হল যে করেই হোক সালাম ভাই কে থামাতে হবে। এভাবে আমাদের আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে।মানুষ জাগলে রাজনৈতিক দলের লাভ দেশের লাভ।’
লাঠি-বাঁশি অভিনব কৌশলের মাধ্যমে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নাটোর থেকে কমে যাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন প্রমাণিত হয়েছে সম্মিলিত ঐক্যের কাছে কোন অশুভ শক্তি টিকতে পারেনা। লাঠি-বাঁশির কার্যক্রম পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।