সহশিক্ষা কার্যক্রম
নবম শ্রেণিতে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন বাবু নগেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তিনি খুব কনভেনশনাল টিচার ছিলেন। তাঁর পান্ডিত্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রেণিকক্ষে তিনি বেশ গম্ভীর থাকতেন, কখনো হেসেছেন বলে মনে পড়ে না, এবং বেশ বকা-ঝঁকাও করতেন। যারা ভাল শিক্ষার্থী ছিল, তাদেরকে পছন্দ করতেন বেশি আর দুর্বল শিক্ষার্থীদেরকে অপছন্দ করতেন তারা কম পারে বা পারে না একারণে। ধৈর্য্য নিয়ে শেখানোর কাজটা ক্লাসে খুব বেশি হয়েছে বলে মনে করতে পারি না। বিষয়টা এমন ছিল যে, শিক্ষকের দায়িত্ব পড়া দেয়া আর পড়ানোর কাজটা বাড়ির। শিক্ষকের আরেকটা কাজ হলো দূর্বল ছাত্রদের প্যাদানো, বকা দেয়া বা লজ্জা দেয়া। দু’একজন শিক্ষক যে এর ব্যতিক্রম ছিলেন না সেটা বলা সঙ্গত হবে না। তবে তাঁদের সংখ্যা এতো কম যে ধর্তব্যে আসে না।
সেই নগেন্দ্র নাথ স্যারের ক্লাসেই একদিন বাচ্চু ভাই (বর্তমানে মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও সজ্জন এ্যাডভোকেট শফিকুজ্জামান বাচ্চু) ও হাফিজ ভাই (বর্তমানে জার্মানীতে প্রবাসী) এলেন সম্ভবত পরেশ স্যার বা আকবর স্যারকে সাথে নিয়ে। উদ্দেশ্য মৌসুমী প্রতিযোগিতায় বিতর্ক ইভেন্টে একজনকে লাগবে, কেউ সেটিতে অংশগ্রহণের জন্যে রাজি আছে কিনা জানতে। কেউ যেতে রাজি না। খোঁজ করা হলো লিটু (প্রফেসর নিয়ামুল করিম, সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মাগুরা) আছে কিনা কারণ সে বেশ স্মার্ট, কথা বার্তায় স্বতঃস্ফূর্ত। কী কারণে যেন সেদিন লিটু অনুপস্থিত। হাফিজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন আমি পারব কিনা। বললাম, আমি তো এর আগে কখনো এটি করিনি। হাফিজ ভাই আমাকে স্নেহ করতেন। বললেন – আরে আমরা শিখিয়ে দেব, চলো।
আমাকে পছন্দ করার আরেকটি কারণ ছিল – এক বছর আগে আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন জাতীয় নৈতিকতা দিবসে আমি নির্ধারিত বক্তৃতায় অংশ নিয়ে ছোটদের গ্ৰুপে প্রথম হয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম – ছোটদের শেক্সপিয়র যেটি পরবর্তীতে আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ভর্তির জন্য মৌখিক পরীক্ষায় খুব সহায়তা করেছিল। ভাইভা বোর্ডে প্রফেসর সদরুদ্দিন আহমেদ স্যার আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি ইংরেজি কোন বই পড়েছি কিনা। স্যারকে সবিনয়ে জানিয়ে দিই আমি মফস্বলের ছেলে যেখানে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজি আলাদা কোন বই পাওয়া যায় না। তবে আমি শেক্সপিয়রের সবগুলি নাটকের অনুবাদ পড়েছি। স্যার জানতে চাইলেন আমাকে কোন নাটক থেকে প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিতে পারব। উত্তরে জানালাম – রোমিও জুলিয়েট, জুলিয়াস সিজার অথবা ওথেলো। স্যার আমাকে ওথেলো থেকে একগুচ্ছ প্রশ্ন করেন। রোমিও জুলিয়েট থেকে একটি দু’টি। আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলাম আর তার ফলেই ইংরেজি বিভাগে ছাত্রত্ব লাভের সুযোগ লাভ করি আমি।
নগেন স্যারের ক্লাসের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি এই ঝামেলা দূর করতে চাইলেন। আমাকে বললেন – যাও যাও। পরে মাগুরা সিও অফিসের (বর্তমান উপজিলা পরিষদের) মিলনায়তনে উপস্থিত হলাম। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। বাচ্চু ভাই, লালা ভাই, হাফিজ ভাই আমাকে সাহস দেয় – আমি যেন মনে করি, আমার সামনে কেউ নেই, আমিই এখানকার রাজা, আমি যা বলবো সবাই সেটা শুনবে। আমি বললাম, আমার তো গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বললো, একদম ভয় পাবার দরকার নেই। আর যদি পা কাঁপে তাহলে আমি যেন সামনে থাকা চেয়ারটা না ধরি, ইত্যাদি।
সেভাবেই আমি শুরু করলাম এবং অতি অবশ্যই পা কাঁপতে থাকলো। গলা প্রথম দিকে শুকালেও দ্রুতই আমি সেটি থেকে মুক্তি পেলাম। হয়তো ইতোপূর্বে নৈতিকতা দিবসে নির্ধারিত বক্তৃতা পর্বে প্রথম হবার অভিজ্ঞতা ও তার আগে একুশের নির্ধারিত বক্তৃতা পর্বে অংশ নেবার অভিজ্ঞতা খানিকটা কাজে লাগলো। তবে নির্ধারিত বক্তৃতা আর বিতর্ক প্রতিযোগিতার মধ্যে বিস্তর ব্যাবধান। নির্ধারিত বক্তৃতা বাসা থেকে প্রস্তুত করে মুখস্থ করে চালিয়ে দেয়া যায় যা বিতর্কের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। বিতর্কে অনেক কিছুই ভাবতে হয়, করতে হয় তাৎক্ষণিকভাবে। যাহোক, ৫ মিনিটের বক্তৃতা শেষ করে চলে এলাম চোখ-কান বন্ধ করে। বাচ্চু ভাই, লালা ভাই, হাফিজ ভাই দারুন খুশি। আমাকে খুব উৎসাহ দেয়া হলো। আমার ধারণা একটু বেশিই দেয়া হলো আমার নতুনত্ব বিবেচনা করে, আমাকে সাহস ও উৎসাহ দেবার প্রয়োজনে। সেই আমার বিতর্কে হাতেখড়ি। আমরা সেদিন থানা পর্যায়ে জিতে গেলাম। এলো এর পরে মহকুমা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। বিতর্ক হবে মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে মাগুরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের। ভালো কম্পিটিশন হলো। সেখানেও ভালো ভালো বিতার্কিক ছিল – ডেলি (বর্তমানে এ্যাডভোকেট ও আওয়ামী লীগ নেত্রী) সেই সময়ে বালিকা বিদ্যালয়ের নাম করা বিতার্কিক। অন্য আর কারো কথা মনে নেই। এখানেও জিতলাম আমরা।
এরপর জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে যশোর গমনের পালা। কী কারণে যেন লালা ভাই যেতে পারবেন না। তাই সেখানে যাবে নিয়ামুল করিম লিটু বন্ধুবরেষু। আমাদের আগ্রহ প্রবল। কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে সেই প্রথম যশোরে যাব। এর আগে আমি একবার কি দুইবার বাবার সাথে যশোরে গিয়েছি। বড় শহর। বেশ লাগে। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের যশোর যাবার জন্যে টাকা দেবে কে! বিদ্যালয়ের সেই স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি খুবই বিরসবদনে বললেন এর জন্যে তাঁর কাছে কোনো ফান্ড নেই। আমরা নিজেরা যেতে চাইলে যাবো না হলে বাদ। শুধু স্কুল থেকে একজন শিক্ষক পাঠাবেন যদি আমরা যাই। সেই শিক্ষকের যাওয়া আসার ভাড়া তিনি দেবার ব্যবস্থা করবেন। স্যার যেভাবে কথা বলছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল সেই স্যারের যাওয়া আসার ব্যবস্থাটাও আমরা করতে পারলে ভালো হয়। এর পরের বারও একই ঘটনা ঘটলো – আবারো আমরা মহকুমা চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা সদরে যাবার অপেক্ষায়। এবার দল হলো সম্ভবত আহসানউল্লাহ, দীন-উল- ইসলাম, লিটু/কাজল ও আমাকে নিয়ে।
আমি তখন একটু বড়সর হয়েছি। কচি-কাঁচার আসর করি। মাগুরা কচি-কাঁচার আসরের আহ্বায়ক। শাকুর সাহেব নাম একজন এসডিও ছিল সেই সময়ে। আমরা তাঁর শরণাপন্ন হলাম। ক্লাস নাইনে পড়া দু’তিনটি ছেলে তাঁর কাছে একটি আবদার নিয়ে গেলো যে তিনি যেন এদের মাগুরা থেকে যশোর যাওয়া আসার বন্দোবস্ত করে দেন। কতই বা খরচ! সেই সময় মাগুরা থেকে যশোরের ভাড়া ছিল চার টাকা লোকাল গাড়িতে। যেতে তিন-চার ঘন্টা লেগে যেতো। তাহলে যাবার জন্যে চার টাকা, আসার জন্যে চার টাকা, আর রিকশা ভাড়ার জন্যে দুই টাকা। এই সাকুল্যে দশ টাকা। আমরা চার জনের জন্য চল্লিশটি টাকার সাহায্য প্রার্থনা করলাম। তিনিও প্রধান শিক্ষকের মত বিরস বদনে জানালেন – বাজেট নেই। আমরা তাও একটু বললাম, এটাতো মাগুরা মহকুমার একটা সম্মানের ব্যাপার। তিনি কোনো পাত্তাই দিলেন না। আমরা বিশ টাকাতে নামিয়ে নিয়ে এলাম আমাদের বাজেট এই কথা ভেবে যে আর বিশ টাকা আমরা কোনো না কোনো ভাবে ম্যানেজ করবো। কিন্তু অবশেষে ফিরতে হলো শুন্য হাতে। না বিদ্যালয় প্রশাসন, না জেলা প্রশাসন – কেউই আমাদের জন্যে কিছু করতে পারলেন না।
এটি ছিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত মৌসুমী বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এটি প্রতি বছরেই হতো সেই সময়ে এবং একটি ভালো আয়োজন ছিলো। অনেকগুলি ইভেন্টে প্রতিযোগিতা হতো। সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, যন্ত্র সংগীত, আরো কী কী যেনো! এ ধরণের প্রতিযোগিতা শিশুদের খুব উজ্জীবিত করে, সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে তাদের ভিতরে। তাদের ভিতরে একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি আরো যে সকল গুণাবলী তৈরী হয় তা হলো – নেতৃত্ব, টিম-ওয়ার্ক, সহনশীলতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধাবোধ, একে অন্যের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা।
যাহোক, অবশেষে বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার খরচ আমি ম্যানেজ করলাম। অন্যরাও তাই। বাচ্চু ভাই এর বাবা মাগুরার স্বনামধন্য এ্যাডভোকেট ও এমপি ছিলেন। তাই তার কোনো অসুবিধা হলো না। হাফিজ ভাই এরও না। সমস্যা হচ্ছিল আমার আর লিটুর। আমরা ম্যানেজ করি। যশোরে গিয়ে আমরা যশোর জেলা স্কুলকে হারিয়ে যশোর জেলা চ্যাম্পিয়ন হই। এবার ঢাকায় যাবার পালা। সেই গল্পে যাবার আগে কয়েকটি প্রশ্ন মাথায় আসে।
শিক্ষার্থীদের এ ধরণের প্রতিযোগিতায় নিজ শহরের বাইরে অন্য শহরে বা এক স্থান থেকে অন্যত্র যেতে হলে এর ব্যয়ভার কেন বিদ্যালয় বহন করবে না? শিক্ষার্থীদের অর্জিত ক্রেস্ট বা মেডেল বা ট্রফি তো বিদ্যালয়েই জমা দিতে হয়। বিদ্যালয়ের কনটিজেন্সি ফান্ড শেষ করার জন্য বছর শেষে শিক্ষকবৃন্দের জন্য মিট-বৌল বা রাইস কুকার বা অন্য কিছু কেনা হয়। সেখান থেকে বা অন্য কোনভাবে এই প্রণোদনাটুকু দেবার ব্যবস্থা করা কি অসম্ভব কিছু?
বিদ্যালয় যদি তা করতে অপারগ হয়, জেলা বা উপজেলা প্রশাসন এই কাজটুকু কেন করতে পারবে না? এ ধরনের কাজে উৎসাহ দেয়াটা কি তাদের ’রুলস অফ বিজনেস’ এর মধ্যে পড়ে না? সামান্য এই ক’টি টাকা এত এত ফান্ড থেকে কিছুতেই জোগাড় করা যায় না, নাকি এটি মানষিক দৈন্য বা দায়িত্বহীনতার ছোট কোন নমুনা? মনে পড়ে, কলসিন্দুরের মেয়ে ফুটবলাররা বিদেশের মাটিতে টুর্নামেন্ট জয় করে দেশে ফেরার পরে তাদেরকে লাইনের বাসে করে গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, না স্থানীয় প্রশাসন, না বাফুফে তাদের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেছিল শুরুতে। এটি নিয়ে মিডিয়াতে সমালোচনা শুরু হলে কুম্ভকর্ণ কর্তাদের ঘুম ভাঙে। আর তারপরে মেয়েদেরকে সংবর্ধনা দেবার তোড়জোড় শুরু হয়।
অথচ ১৯৭২ সাল থেকে এ অব্দি যতগুলি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও শিক্ষাক্রম প্রনীত হয়েছে তার প্রতিটিতেই সহশিক্ষা কার্যক্রমকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এভাবেই শিক্ষাক্রম থেকে যায় কাগুজে কিছু কথা হয়ে। সহশিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়টি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এরকম যে শিক্ষার্থী নিজ গুণে বা পরিবারের সহায়তায় এটি অর্জন করবে। সফল হলে বিদ্যালয় কৃতিত্বের ভাগীদার, এমনকি কিছু না করেও; বিফল হলে অসাফল্যের ভাগীদার পুরোটাই শিক্ষার্থী একা।
“এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে?”
(চলবে)