পর্ব – বাইশ: মমতার কোপ, বিশ্বাসের আলো
ফ্ল্যাটবাড়ির দরজার তালাটি নিরাপদ নয় ভাবতেই পারছে না উর্বশী। যে কেউ ঢুকতে পারে দরজা খুলে! দৃশ্যমান চেনা মানুষ আর অদৃশ্যে থাকা চেনা-অচেনা মানুষরূপী হায়নার দলও ঘুরঘুর করছে চারপাশে। নিরাপত্তাবোধের দেয়ালে ফাটল তৈরি হয়েছে। একা ফ্ল্যাটে থেকে নিজেকে দাঁড় করানোর আকাক্সক্ষাও জীবনযুদ্ধের শুরুতে প্রশ্নছুরিতে বিদ্ধ হচ্ছে। পেছনে হটবে নাকি সামনে এগোবে, নাকি বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে উঠার পর সাময়িক বিরতি দিয়ে আবার নামবে জটিল পথে? এ প্রশ্ন কেবলই জীবনের মেটাফোর নয়, ধোঁয়াশাপূর্ণ প্রতীকী বাস্তবতা নয়, খোলা তলোয়ারসম বাস্তবের ধারালো ঘা খেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা ভাঙাচোরা জীবন সড়কের জীর্ণদশার চিত্রমাত্র।
এ খড়খড়ে সড়কে হাঁটা দুরূহ, নিরাপত্তা আরো বেশি উদ্বেগপূর্ণ। বিস্তৃত সংকটের পথে হাঁটার সাহসে ভাটা পড়ল। নিজেদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে নতুন তালা লাগানোর ব্যবস্থা করলেও বুঝল, তালা সব ধরনের সুরক্ষা দিতে পারে না। সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না হলে পাওয়া যাবে না আসল সুরক্ষা। একাকী সামনে চলার সহজ পথ নেই- এমন ভাবনার আলোকেই কাজ করল উর্বশী। ফ্ল্যাটের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দরজায় নতুন তালা লাগিয়ে নীচে নেমে এসে সিকিউরিটি গার্ডদের বলল, ‘কয়েক দিন বাইরে থাকব। আশা করি বাসার নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব আপনাদের।’
‘একশ ভাগ নিশ্চিত থাকুন। অবশ্যই আমরা খেয়াল রাখব।’ জবাব দিল গার্ডদের পাশে দাঁড়ানো অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার। ম্যানেজারকে উদ্দেশ করে কথা বলেনি উর্বশী অথচ তিনিই জবাব দিলেন। আগ বাড়িয়ে বাড়তি কথা বলার জন্য চোখ তুলে উর্বশী সরাসরি তাকাল তার দিকে। চোখ না নামিয়ে ম্যানেজার দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললেন, ‘বাড়ির দেখভালের দায়িত্ব আমাদের, তবে সুনাম রক্ষার দায়িত্ব অ্যাপার্টমেন্টে থাকা সকল মালিক এবং ভাড়াটিয়ার।’
কথার নিশানা ঘুরে গেছে, টের পেল উর্বশী। কথা বাড়াবে, না ইঙ্গিতটা বুঝেও নীরবে বেরিয়ে যাবে বাড়ি থেকে, ভাবার জন্য কিছুটা সময় ব্যয় হলো। তারপর হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে, নিজেকে রিলাক্স করে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘বাড়ির সুনাম নষ্ট হওয়ার মতো কি কোন ঘটনা ঘটেছে?’
‘জি। ঘটেছে। ভালো করেই জানেন আপনি। পুলিশ এসেছে তদন্ত করতে, অশ্লীল খবরও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়- দুই তরুণীর কারণে এই বাড়িতে রাত-বিরাতে আসছে তরুণের দল, শহর এলাকায় কিছু কিছু বাসা-বাড়িতে চলছে অশ্লীল ব্যবসা- এসব খবরে কি বাড়ির মর্যাদা থাকে, ম্যাডাম?’
‘খবরটার সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখতে হবে না? কোনো দুষ্টচক্র যদি ভুল বা মিথ্যা খবর দেয়, না বুঝেশুনে সব বিশ্বাস করলে বাড়ির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে না?’
‘খবরটা সত্য নয়, জানি ম্যাডাম। কিন্তু বাইরে কিংবা পাড়ার মানুষজনের কাছে বাড়ির ইজ্জত ক্ষুণ্ন হয়েছে- এ খবর তো সত্য। তারা তো সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে মুখরোচক খবর হিসেবে সবই বিশ্বাস করবে- আর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় এ ধরনের ব্যবসা বাড়ছে, সে-খবরও মিথ্যা নয়।’
ম্যানেজারের ভদ্রোচিত ভাষার আড়ালে শ্লেষাত্মক আক্রমণে ফালাফালা হতে গিয়েও নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে উদ্ধত কণ্ঠে উর্বশী বলল, ‘এ বাড়ির ম্যানেজার হিসেবে সত্যটা জানলেই চলবে আপনার, তাহলে মিথ্যা উন্মোচিত হবে সহজেই। অন্যদের কথার খোঁচায় তখন খসে পড়বে না শ্লীলতার মোড়ক, অশ্লীলতার ইমেজ নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে না।’ উর্বশীর কথার দাপটে ভুল নিউজের আলোকে গড়ে ওঠা ম্যানেজারের মনে গেড়ে বসা অশ্রদ্ধার উঁচু টিলাটি হঠাৎ চুরচুর করে ভেঙে পড়ল। অবনত চোখে ম্যানেজার বলল, ‘জি ম্যাডাম। জি ম্যাডাম।’
হাতে ধরা হালকা দুটো ব্যাগ নিয়ে এবার খোলা সড়কে এসে দাঁড়াল উর্বশী। একবার তাকাল খোলা আকাশের দিকে। সড়কের পাশে বিরাট শিশুগাছের সবুজ পাতার ঝাঁকের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেঁড়া ছেঁড়া নীলাকাশ। দৃশ্যমান ছেঁড়া আকাশের কোথাও ফাটল নেই। বিস্তৃত আকাশের বুকে তুষারকণার আড়ালে ফুটে আছে জাদুকরী এক সাদা গোলাপ। ঝরা তুষারকণার শরীর চুঁইয়ে ঝরে যাচ্ছে ম্যানেজারের কথার আঘাতে বের হওয়া কষ্টকণা। একবার পেছন ফিরে তাকাল ও। দেখল অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে ম্যানেজার। যেন সে মানুষ দেখছে না, দেখছে আকাশ থেকে নেমে আসা, সড়কে দাঁড়ানো এক আলোরপরী। শুদ্ধতার ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে ম্যানেজারের চোখে! এ ঢেউয়ের উৎস কি? অর্ণবদ্যুতি কি তবে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে তার চারপাশের মানুষজনের চোখের ময়লা, নোংরা চাউনি? আবার সে তাকাল আকাশের দিকে। সাদা গোলাপের পাপড়ি চুঁইয়ে তুষারকণা নেমে যাচ্ছে সাগরপানে। একই কণার স্পর্শ নিশ্চয় একই সঙ্গে পাচ্ছে অর্ণবও। ভাবনার চাপা ঢেউ এভাবে কাব্যঢেউয়ের আলোড়ন তুলল উর্বশীর মনে:
‘আমার অশ্রু যেন ঝেড়ে ফেলা ময়লা
কিছু যাদুকরী গোলাপের পাতা হতে,
আর আমার শোক চুঁয়ে পড়ে সেই ফাটল হতে
ঝরে তুষার আকাশ হতে; যে আকাশ বিস্মৃতিতে।’…
আয়েশা ঝর্ণা অনূদিত ডিলান টমাসের কাব্য-আলোড়ন থেমে গেল। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নতুন ধরনের হলুদ ক্যাব। আগেই কল করেছিল।
গাড়িতে উঠে বসার পরই যাত্রা শুরু করল ক্যাবটি। ক্যাবযাত্রায় নিজেকে নিরাপদ ভাবলেও নিরাপত্তাহীনতাজনিত শঙ্কার গোপন ঘন্টি বেজে উঠল। বুকের ভেতরের উদ্বেগঘণ্টার আওয়াজ জোরালো হতে হতেও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ল না। ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, ‘বুকিংয়ের সময় গন্তব্যের কথা উল্লেখ করেছিলাম, মনে আছে তো?’
‘জি ম্যাডাম। মনে আছে। ধানমন্ডিতে যেতে হবে।’
‘কতক্ষণ সময় লাগতে পারে?’
‘অবরোধ চলছে দেশে; ঢাকার রাস্তা ফাঁকা বলা যাবে না, ঢাকা শহরের সব গাড়ি রাস্তায় নেমেছে মনে হচ্ছে। জ্যামে না পড়লে মিরপুর থেকে যেতে সর্বোচ্চ ত্রিশ মিনিট লাগতে পারে। তবে…।’
কথা শেষ না করে থেমে গেল ড্রাইভার।
‘তবে… আবার কী?’
আচমকা পেট্রল বোমা উড়ে আসতে পারে গাড়ির দিকে। এ ছাড়া আর কোনো ভয় নেই।’
‘বলেন কী? এটা কি কম বড় ভয়ের কারণ নাকি? এর চেয়ে বড় ভয়ও থাকতে পারে চলার পথে?’
উত্তর দিল না ড্রাইভার। মোটামুটি ফাঁকা সড়কে প্রায় উড়ে উড়ে যেতে লাগল। শ্যামলীর মোড়ে এসে দাঁড়াল ট্রাফিক সিগনালে। লালবাতি জ্বলছে না। ট্রাফিক পুলিশের হাতই লালবাতি হিসেবে কাজ করছে।
সিগনালে দাঁড়ানোর পর মুখ খুলল ড্রাইভার, ‘পেট্রল বোমার চেয়ে বড় ভয়ের কারণ নেই। তবু পথে নামতে হয় ম্যাডাম। ঘরে বসে থাকলে কীভাবে মালিক ব্যাংকের গাড়ি-লোনের কিস্তি শোধ করবেন? ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি না নেওয়ার কারণেই ১২ দিন অবরোধে ঘরে বসেছিলাম। আজ নেমেছি সড়কে। ভয় করছে। তবু তো চলতে হবে।’
ড্রাইভারের ভীতি সঞ্চারিত হলো ওর নিজের মনে। তুলনামূলক একটা চিত্র জেগে উঠল কল্পচোখে। কোন ভয়টি বেশি মারাত্মক- পেট্রল বোমার ভয়, নাকি কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল বোমার কালিমা লেপনের ভয়? জীবনহানির ভয় নাকি সম্ভ্রমহানির ভয়? হলুদ বা ভুল সাংবাদিকতার ভয়? নাকি অন্য কোনো ভয়?
মাথায় প্রশ্নের আনাগোনা থেমে গেল। সামনের সিট থেকে দৈনিক পত্রিকাটি ড্রাইভার বাড়িয়ে দিল পেছনে। সিগনাল এখনও চলার সংকেত দেয়নি। যাত্রীসেবার লক্ষ্যে, যাত্রীর উদ্বেগ কমানোর উদ্দেশ্যেই পত্রিকাটি পেছনে বাড়িয়ে দিয়ে সামনে তাকাল ড্রাইভার। পথচারীরা এলোমেলোভাবে পেরোচ্ছে সড়ক। ট্রাফিক পুলিশ এখনও হাত তুলে রেখেছে। কতক্ষণ থাকবে এ সিগনাল? ট্রাফিকের অবরোধকে রাজনৈতিক অবরোধের চেয়েও এ মুহূর্তে কম শক্তিশালী মনে হলো না।
আকস্মিক হাসি ফুটল ড্রাইভারের চোখে। স্টার্ট নিয়ে ছুট দিল সে সামনে। পত্রিকার পাতায় মগ্ন হলো উর্বশী। চলমান গাড়িতে কিছুই পড়তে পারছে না ও। পড়তে থাকলে মাথা ঘোরায়; বমি বমি লাগে। কিন্তু সব উপসর্গ উড়ে গেল। চুম্বকের মতো চোখ সেঁটে গেল খবরের কাগজে- বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অবরোধের ১৩তম দিন গতকাল ১৩টি জেলায় সহিংসতা ঘটেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আগুন দেওয়া হয় ১৯টি যানবাহনে। ভাঙচুর করা হয় আরও ১১টি। আটক করা হয় কমপক্ষে ১৪৯ জনকে।
চলমান গাড়িতে মোশন সিকনেসে মাথা ঘুরছে না। ভয়াবহ নিউজটি পড়ার পর এক চক্কর পাক খেল মাথা। কেন এ অবরোধ? কেন এ সহিংসতা? কেন এ ধরপাকড়? প্রশ্নের উত্তাপ জ্বালিয়ে দিল চোখের মণি। আবার পড়তে লাগল খবরটি : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৬ জানুয়ারি (২০১৫) থেকে চলছে অবরোধ। তবে ৪ জানুয়ারি শুরু সংঘাতের। এই দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৫ দিনে সহিংসতায় নিহত হলেন ২৭ জন। আহত পাঁচ শতাধিক। এ সময়ে আগুন দেওয়া হয় ২৩৮টি যানবাহনে। ভাঙচুর করা হয় অন্তত ৩০৭টি।
দেশের সংঘাতের সামনে সম্মানের খুঁটিতে অশ্লীল-বোমার আক্রমণকে তুচ্ছ মনে হলো। বিপর্যয়ের ভেতর থেকে বুকে পুরে নিল সাহস। প্রথম কাজ হবে প্রিয়জনদের সহযোগিতা নেওয়া। বাবাকে সব খুলে বলার তাগিদও বোধ করল। গাজীপুরের এএসআই জলিল সাহেবকেও ফোন করার তাগিদবোধ করল। কল করতে গিয়ে থেমে গেল হঠাৎ ড্রাইভারের গাড়ি চালনায় বেপরোয়া গতি দেখে।
‘কী ব্যাপার? এভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন?’
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই ব্রেক কষল ড্রাইভার। ভয়ের সলতেয় জ্বলে উঠে বলল, ‘ম্যাডাম? দেখুন, সামনে দেখুন কারা যেন সামনের বাসে আগুন দিয়েছে!’
সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল উর্বশী। মুহূর্তের ব্যবধানে আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। জানালা দিয়ে ধুপধাপ লাফ দিচ্ছে আতংকিত মানুষ। সড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অসহায় পুলিশ! এক তরুণ দগ্ধ এক তরুণীকে কোলে নিয়ে ছুটছে কোনো যানের আশায়। চোখের পলকে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটি বিস্ময় আর যন্ত্রণার শিখা প্রজ্বলিত করে দিল মস্তিষ্কে। বিধ্বস্ত অবস্থা আবার কাটিয়ে ওঠার পরে শুনল ফায়ার ব্রিগেডের জরুরি ঘণ্টাধ্বনি। কোথায় যাচ্ছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িবহর? আগুন নেভাতে না আগুনে দগ্ধ যাত্রীদের উদ্ধার করতে, নাকি পেট্রলে পোড়া লাশ উদ্ধার করতে? জানে না উর্বশী। চোখ বন্ধ ছিল দীর্ঘক্ষণ, কতক্ষণ সময় পেরিয়ে এসেছে বোঝার আগে হঠাৎ দেখল হাজির হয়েছে সে নিজেদের বাড়ির সামনে।
পেট্রল বোমা আর অশ্লীল বোমার আঘাতে জর্জরিত মনের দেয়ালে ফাটল তৈরি হয়ে গেছে। জীবনের জয় আর সম্মান ধরে রাখার আকাক্সক্ষার সলতেয় আলো ফোটাতে চাইল ও। বাসায় ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বেশ কিছু সময় পরে দাঁড়াল বাবার ঘরের সামনে।
বাবাকে দেখে চমকে উঠল উর্বশী।
মেয়েকে দেখেও চমকালেন উর্বশীর বাবা।
মেয়ের মুখে বসে গেছে দুশ্চিন্তার ছাপ। বাবার মুখেও ফুটে আছে উৎকণ্ঠার ছায়া।
‘কী হয়েছে, বাবা! তোমাকে এমন লাগছে কেন?’ প্রশ্ন করল উর্বশী।
‘একই প্রশ্ন তো তোমাকেও করতে চেয়েছি আমি। প্রশ্নটি করলাম না। তবে তুমি ফিরে এসেছো, এজন্য ভালো লাগছে।’
‘ফিরে এসেছো’ বাক্যটি আকস্মিক নাড়িয়ে দিল মনের সচেতন স্তর। আসলেই কি চলে এসেছি স্থায়ীভাবে? নিজেকেই প্রশ্ন করল নিজে। স্বচ্ছ উত্তর খুঁজে পেল না। ধোঁয়াশায় ঢেকে রইল। তবে কি মনের গোপন ঘরে ফিরে আসার আকাক্সক্ষাও লুকিয়েছিল, জানে না ও। নিজেকেই পরিচ্ছন্নভাবে দেখার সুযোগ পেল না। চুপ হয়ে রইল উর্বশী। পেট্রল বোমায় আক্রান্ত মানুষজনের মতো জীবন বাঁচানোর তাগাদা না থাকলেও সম্ভ্রম বাঁচানোর তাগিদের কোনো দুর্বলতার সংকেত দেখল না ও।
ক্ষুরধার চোখ মেলে প্রত্যয়ী মনে ও আবার চোখ রাখল বাবার চোখে।
চোখ নামিয়ে বাবা আবার বললেন, ‘মেয়েদের সম্ভ্রমরক্ষা করে চলতে হয়। একবার কালিমা লেপে গেলে সহজে তোলা যায় না সে দূষণ।’
‘এ কথা কেন বলছো তুমি, বাবা?’
‘দেখো পত্রিকায় যে-খবর ছাপা হয়েছে, তার তাপে পুড়ে গেছে আমার সব, মেয়ের প্রতি আস্থা-বিশ্বাসের ঘাটতি না থাকলেও ফাটল তৈরি হয়েছে মনের দেয়ালে। বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মানসিক চাপ আর যাতনা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন হার্টের চিকিৎসকরা। সেই দহন নেভাব কীভাবে? সাড়ে তিন হাত ভূমি ডাকছে আমাকে। তাই সব কথা লুকিয়ে না রেখে উজাড় করে বলছি তোমাকে। তুমি ঠিকমত চললে কষ্ট কমে যাবে আমার।’
বাবার কথা শুনে দমে গেল উর্বশী। চোখ বুজে কল্পচোখে দেখে নিলো পেট্রল বোমার দাউ দাউ আগুনের মতোই জ্বলছে বাবার হৃৎপিণ্ড। এ মায়াবী মাংসপিণ্ডের আগুন নেভাবে কীভাবে? অশ্লীলতার আক্রমণ থেকে কীভাবে বাঁচবে? কীভাবে বাঁচাবে বাবাকে? ভাবনার তাপ মনের গিটারে আবার বাজিয়ে দিল ডিলান টমাসের কাব্যপংক্তি:
আর তুমি, আমার বাবা, সেখানে দুঃখময় উচ্চতায়
তোমার অভিশাপ, দয়া, ক্রুদ্ধ অশ্রুসহ আমি এখন,
প্রার্থনা করি- যেও না ভদ্রলোক সেই শুভরাত্রির ভেতরে
কোপ প্রচণ্ড কোপ আলোর মৃত্যুর বিপরীতে।
কন্যার সম্মানের ওপর মিথ্যা কালিমা বাবার বুকে কোপ বসিয়ে দিচ্ছে, সন্দেহ নেই। মিথ্যা জেনেও মিথ্যার বিষপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছেন না তিনি। সত্যের ছোঁয়া পাচ্ছেনই। তবে মনকে প্রবোধ দেওয়ার কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই তাঁর চিন্তনে, বোধের জগতে। দুর্ভাবনা আর আবেগের যন্ত্রণার ঘোরে আটকে গেছেন তিনি, মেয়েকে সামনে পেয়েও। দুঃখময় যা, তার উঁচু পাহাড় থেকে নামতে পারছেন না এখনও।
চোখ বুজে উর্বশী কল্পচোখে আবার দেখতে লাগল সড়কে চলন্ত বাসটি। একবার দেখল, বাস নয়, যেন জ্বলছে নিজের বাবা। আবার দেখল নিজের জীবন বাজি রেখে জ্বলন্ত বাস থেকে কোলে করে বাবা উদ্ধার করছেন নিজের মেয়েকে। মেয়ের চোখ খোলা। কাঁদছে না। রাস্তার ওপর উদ্ধারকারীর কোলে চড়ে ছুটে চলা মেয়েটিকে কাঁদতে দেখেছিল চিৎকার করে। অথচ বাবার কোলে নিজেকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। নিজের চোখ থেকে বেরুতে দেখল আগুন। লালের মধ্যে হলুদের ছোপও বসে আছে। সব ছাপিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে উপরে, আকাশের অনন্ত সীমানায় পৌঁছানোর আগে কালো ধোঁয়া ক্রমশ পরিষ্কার হতে হতে মিলিয়ে যেতে লাগল নীলাকাশে। তার দূরবর্তী কেন্দ্রে উর্বশী দেখল ঘুরছে একটি আলোকপিণ্ড। ধনুকের মতো চন্দন রোশনি নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ঢুকে যাচ্ছে নিজের চোখের ভেতর। হঠাৎ চোখ তুলে উর্বশী তাকাল বেদনায় মুহ্যমান বাবার চোখের দিকে।
বিস্ময়ের অলৌকিক দ্যুতি খেলে গেল বাবার চোখে। তাঁর বুকের ভেতরের আগুন নিভে গেল। মমতার কোপ খেয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। বিশ্বাসের আলোয় নড়ে উঠে হু হু করে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে সামলে দৃপ্তকণ্ঠে বললেন, ‘আমার মেয়ের প্রতি রয়েছে শতভাগ বিশ্বাস। আস্থা। মেয়ের যে কোনো বিপদে আমি থাকব তার পাশে।’
নিজের ঘরে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল উর্বশী। ঝকঝকে রোদ। রোদের দিকে তাকালে আলাদা করে রংধনু দেখা যায় না। কিন্তু এখন ঘটল বিস্ময়কর পরিবর্তন- গ্যালাক্সির কক্ষপথ থেকে নেমে যাচ্ছে অগ্নিগোলক, সাগরের দিকেই ছুটছে আগুনগোলা। ওয়েব পোর্টালে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভিজ্যুয়াল ইমেজ- কে ও?
অর্ণব?
না। অর্ণব না। অর্ণবের আলোর তরঙ্গে খেলছে এক শিশু। কাঁদছে, যেন কেঁদে কেঁদে ডাকছে তার মাকে?
কোথায় তার মা?
নিজের মধ্যেই কি অবচেতনে গেড়ে বসে আছে মাতৃত্বের শেকড়?
এমন দৃশ্য উপহার দিল কেন অর্ণব? কী চায় সে? নিজেকে আড়াল করে কোন মায়ার বাঁধনের সংকেত পাঠাল? চোখ খিঁচে চোখের কর্নিয়ায় সেঁটে থাকা মাইক্রোচিপ উদ্দীপ্ত করে উর্বশী এবার পালটা সংকেত পাঠাল।
উত্তর নেই। উত্তরের বদলে ভেসে আসছে সেই কান্নাধ্বনি। কোনো এক শিশু ডাকছে তাকে দূরবর্তী গ্রহপৃষ্ঠ থেকে। কেন এ ডাক? মাতৃত্বের শেকড় কি টান দিতে চায় অর্ণব? শিশুটিও?
চলবে…