আকাশটা রোদ ঝলমলে। একটা হলুদ ঘুড়ি মাথার ওপর পাক খাচ্ছে। অনেক উঁচুতে উঠে গেল ঘুড়িটা। আরে আরে, কোথা থেকে একটা লাল রঙের ঘুড়ি এসে সাঁই সাঁই করে ওপরে উঠছে। এই এই, লাল ঘুড়িটা হলুদটা কে ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে। এবার হলুদটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মনে হয়, সেই তালেই আছে। খুব মারকুটে তো ওই লাল ঘুড়িটা!
‘লাটাই টা ঠিক করে ধর, আরও সুতো ছাড়, শুভ ! লাল ঘুড়িটার মতলব ভাল না। সাবধান, শুভ! সাবধান ’আরে লাল ঘুড়িটা তো তীব্র গতিতে নিচে নামছে। সর্বনাশ!
‘শুভ, সরিয়ে নে তাড়াতাড়ি, গোটা – গুটিয়ে নে সুতো। ধরে ফেলবে যে!’ বলতে না বলতেই লাল ঘুড়িটা হলুদটাকে প্যাঁচ কষে কেটে দিলো।‘ যাঃ, ভো কাট্টা! পারলি না তো, শুভ ! হেরে গেলি!’ একটু জোরেই বোধহয় আওয়াজ বেড়িয়েছিল রুদ্রনীলের গলা দিয়ে। হঠাত তার কানে গেলো, কেউ ওনাকেই বলছেন-
‘আপনার কী খুব কষ্ট হচ্ছে?’
ঘাড় ঘুরিয়ে রুদ্রনীল দেখলেন এক মহিলা। শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরের এক ফালি কাচের জানালায় প্রতিফলিত হয়ে মহিলার রুপোলী চুলের গুচ্ছে বিলি কাটছে। একটি হাত খোঁপা এলিয়ে আছে ঘাড়ে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওনার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এক পলক দেখেই রুদ্রনীলের বুকটা কেঁপে উঠল। শ্রাবণী! না না, তা কি করে সম্ভব!
আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যেতেই ধীরে ধীরে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলেন রুদ্রনীল। ক্রমশঃ চেতনায় ধরা দিল আশপাশের টুকরো ছবি। মনে পড়ল উনি হাসপাতালে আছেন জ্বর হয়েছিল, সাথে নিঃশ্বাসের কষ্ট। সেই রাতে কিভাবে যে সব ব্যবস্থা হল ! এই ডামাডোলের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা, হাসপাতালে এডমিট করানো, সব…সব ঝক্কি সামলেছিল একা ছেলেটা। সত্যি, সেদিন সুমন না থাকলে কী যে হত! ভাবনায় যতি পড়ল।
‘কাউকে ডাকবো?‘ রুদ্রনীলের পাশের বেডের সেই মহিলা। উদ্বিগ্ন চোখে চারিদিকে দেখতে লাগলেন কোন নার্স কে দেখা যায় কিনা। এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে এমনিতেই স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা কম ।
‘না না, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিকই আছি।‘
রুদ্রনীলের স্বাভাবিক গলা শুনে মহিলা আশ্বস্ত হলেন।
‘ আপনি … মানে… কখন…’
‘ আমি এই ঘন্টাখানেক হল, ভর্তি হয়েছি।‘
‘ও!’
‘ আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন।‘
রুদ্রনীলের মনে পড়ল ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নের কথা। এইসময় ওয়ার্ডে একজন ডাক্তারবাবু ঢুকলেন, সাথে সিস্টারও রয়েছেন। প্রত্যেক পেশেন্ট এর কাছে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করা, কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা জানা, আর সাথে সিস্টার কে নির্দেশ দেওয়া – এভাবেই রাউন্ড দেন প্রতিদিন এঁরা। রুদ্রনীলের বেডের সামনে এসে ডাক্তার বাবুর ভুরু কুঁচকে গেলো।
‘ কি হল, খাওয়াদাওয়া করছেন না কেন ঠিক করে?’
‘খাচ্ছি তো, ডাক্তারবাবু।‘
‘উহু, আরও বেশি করে খেতে হবে । প্রচুর প্রোটিন নিতে হবে, না হলে লড়বেন কি করে এই রোগের সাথে ?’
‘কিছু ভালো লাগে না,মুখে। কোন স্বাদ নেই ।‘
‘ সে তো একটু হবেই । তবু জোর করে খেতে হবে, উপায় নেই!’
ডাক্তারবাবু চলে যেতেই রুদ্রনীল নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন।
শেষবার লকডাউন ঘোষণার পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই চিত্রিতা একদিন খাওয়ার টেবিলে বসে বলেই ফেলল যে এভাবে আর পারা যাচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে। সারাদিন শুধু সংসারের কাজ আর কাজ। সম্ভব নাকি কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে? অতএব, শুভায়ু কে ভাবতেই হল বউকে একটা ব্রেক দেওয়ার কথা। সাথে মিঠাই ও আছে। সবে পাঁচে পড়ল । তার ও বায়নাক্কার শেষ নেই। ‘বাপি, ভাল্লাগে না। কোথাও একটা চল তো!’ দূরে কোথাও তো যাওয়া যাবে না। বাঁকুড়া তে চিত্রিতার মাসতুতো বোনের বাড়ি। ওখানে সংক্রমণ প্রায় নেই বললেই হয়। আর ওরা থাকে মুকুটমনিপুরের কাছেই। ফলে ঘুরতে যেতে কোন অসুবিধেই নেই।’ সেইমতই প্ল্যান বানানো হল দিন চারেকের। রুদ্রনীলের জন্য কিছু খাবার বানিয়ে রাখার কথা তুলেছিল শুভায়ু। রুদ্রনীল অবশ্য সাথে সাথেই ছেলেকে থামিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে –
‘আরে, না না। আমার জন্য কিচ্ছু করতে হবে না। ফ্রিজে দুধ থাকলেই হবে। মুড়ি কলা এইসব দিয়ে হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না। এই বয়সে আর কি লাগে!’ চিত্রিতার ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য ভেসে এসেছিল –
‘কবে আপনাকে শুধু এইসব খাইয়ে রাখা হয়েছে? বয়স তো অনেকদিনই হয়েছে!’
‘না না, তা নয় …। আসলে তোমাকে আবার রান্না নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে, সেটাই চাইছি না। ‘গলার কাছে দলা পাকানো যন্ত্রণাটা কোনমতে গিলে নিলেন রুদ্রনীল। ওদের যাওয়ার দু’দিন আগে হঠাত সন্ধ্যে থেকে রুদ্রনীলের একটা শুকনো কাশি শুরু হয়। পরেরদিন একটু জ্বরও হয়। উনি নিজেই প্যারাসিটামল খেয়ে গারগেল করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন যাতে ওদের যাওয়ায় বাধা না পরে। এতদিন ধরে প্ল্যান করে তারপর ওনার জন্য যদি…। ভাবতেই যেন মরমে মরে যাচ্ছিলেন রুদ্রনীল। যাওয়ার আগের দিন রাতে শুভায়ু অবশ্য বাবার ঘরে এসে বলেছিল –
‘দেখো বাপি, তোমার শরীর বেশি খারাপ লাগলে বলো, আমাদের যাওয়া টা না হয় … ‘’
ভেতরে ভেতরে আঁতকে ওঠেন রুদ্রনীল। সর্বনাশ ! তাহলে আর দেখতে হবে না। চিত্রিতার কথার ঠেলায়
বাড়িতে টেকাই মুশকিল হয়ে যাবে। তাই তড়িঘড়ি বলে উঠলেন –
‘আরে না রে, সেরকম কিছু না। ঠিকই আছি । চিন্তা করিস না। তোরা ভালোভাবে ঘুরে আয়।‘
এরপর আর কথা বাড়ায়নি শুভায়ু। পরেরদিন ভোর ভোর বেড়িয়ে গিয়েছিল ওরা। এতটা রাস্তা শুভায়ুকে ড্রাইভ করতে হবে তো।
ওরা চলে যাওয়ার পরের দিন জ্বরটা বেশ বাড়ে। কাজের মেয়েটি এসে রুটি বানিয়ে দেয়, দুধ গরম করে দেয়। সেই রাতেই রুদ্রনীলের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তারপর যে কী ভাবে পাশের বাড়ির সুমন অত রাতে সব জোগাড় যন্ত্র করে ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে, সেসব কল্পনার বাইরে !
রাতের ডিনারে কিছুই মুখে তুলতে ইচ্ছে করছে না রুদ্রনীলের। খাবার দেখলেই বমি আসছে ।
‘ওকি! শুয়ে পড়লেন যে, কিছু তো খান! সারা রাত্তির খালি পেটে থাকা ঠিক নয়!’
পাশের বেডের মহিলা। নাছোড় বান্দা। বারে বারে অনুরোধ করতে লাগলেন। অগত্যা রুদ্রনীল উঠে বসলেন। মহিলা নিজে খেতে খেতে গল্প জুড়লেন। ওনার পরিবারের কথা। স্বামী মারা গিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। ভাবতেন, কিভাবে বাঁচবেন একা ! আর এখন, নাতি নাতনীদের নিয়েই সময় কেটে যায় ।কথা বলার ধরণেও কত মিল ! অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন রুদ্রনীল । আর এই যে গল্পে গল্পে রুদ্রনীলের বেশ কিছুটা খাবার খাওয়া হয়ে গেলো, এই কৌশল টাও তো ওনার খুব চেনা! যখনই কাজের চাপে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হত, ক্লান্ত রুদ্রনীল বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় টানটান হয়ে যেতেন। সেইসব দিনে শ্রাবণী কত খোশামোদ করে ওনাকে তুলে ডাইনিং টেবিলে বসাতো। তারপর নানারকম গল্প ফেঁদে ওনাকে ডিনারটা করিয়েই ছাড়ত। আর আজকাল, তিনি কি খেলেন, কতটা খেলেন, কে খোঁজ রাখে ! শুভ উইক ডেজ এ অফিস আর বাড়ি। চিত্রিতা একটা মন্টেসারি স্কুলে পড়ায়। মিঠি স্কুলে বেড়িয়ে যায়। আর উইকেন্ড গুলোতে তো ওদের বাইরে শপিং ডিনার এইসব লেগেই থাকে। নয়তো পার্টি। আজ এর বাড়ি তো কাল আর একজনের। এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে এসে মনে হয়েছিল বাড়িতেও তো আইসোলেশনেই থাকেন। শুধু ওখানে আলাদা করে চিহ্নিত করা থাকে না, এই যা ! বরং এখানে একজন মানুষের সঙ্গ পেলো তার মন ! কতদিন পর ভালো লাগার অনুভুতি এই অসুস্থ শরীরেও অনুভব করলেন রুদ্রনীল।
পরেরদিন থেকে একটু একটু করে সুস্থ বোধ করতে শুরু করলেন রুদ্রনীল। ওই মহিলার কাশিটা বাড়ছিল। তবু তারই মধ্যে চেষ্টা করতেন মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে। বাড়িতে নাতি নাতনী দুটোর দুষ্টুমির সাথে পাল্লা দিয়ে ওনাকেও যে কত কিছু করতে হয়, সেইসব মজার গল্প বলে জমিয়ে রাখতেন। এরই মধ্যে রুদ্রনীলের খাওয়ার দিকেও নজর রাখতেন প্রতিবার। রুদ্রনীলেরও সময় বেশ কাটছিল। হাসপাতালের একঘেয়ে পরিবেশেও একটা অন্যরকম আবহ তৈরি হয়েছে। একটা সংযোগ।
সেদিন রাতে ডিনারের সময় মহিলা বিছানা থেকে উঠে বসে খাবার খেতে পারলেন না। কাশির দমক টা বেড়েছে । রুদ্রনীলেরও খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেলো ওনাকে ওই অবস্থায় দেখে। প্রতিদিন উনি কত গল্প করেন, কখন খাওয়া হয়ে যায়, রুদ্রনীল টেরও পান না। আর আজ! দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না রুদ্রনীল। অনন্যা (পাশের বেডের মহিলাটির নাম, গতকালই কথায় কথায় জেনেছিলেন) শুয়ে আছে্ন। গায়ে চাদর ঢাকা দেওয়া। সেই সময় একজন সিস্টার এসে অনন্যার পালস দেখল। টেম্পারেচার মাপল। কিন্তু অনন্যা কোন কথা বলছেন না তো! তাহলে কি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ! মনে মনে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন রুদ্রনীল। অনন্যাকে অক্সিজেন মাস্ক পরানো হল। তার মানে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে । রাতে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। অনন্যার বেডের দিকে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। বারে বারেই চোখ ছলে যাচ্ছিল ওদিকে। কেমন আছেন এখন? শ্বাস পড়ছে তো? এরা তো নল লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। তারপর মাঝে মধ্যে এসে দেখে গেছে ঠিকই। তবু , বলা তো যায় না! মনে হচ্ছে নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে সামনে গিয়ে যদি দেখে আসতে পারতেন একবার! নিশ্চিন্ত হতে পারতেন কিছুটা। কাল রাতেও কত কথা বলছিল মানুষটা, কত প্রানবন্ত, আর আজ ঝরাপাতার মত পড়ে রয়েছে বিছানায়! মুখটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাই ভালো করে বুঝতে পারছেন না রুদ্রনীল। মনের মধ্যে একরাশ উৎকণ্ঠা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। জলের ঝাপটা লাগছে জানালার কাচে। এখন শ্রাবণমাস। সেদিনও ছিল ভরা শ্রাবণ।
‘আজ কেমন আছ, বনি?’ শ্রাবণীর বেডের পাশে টুল্ টা টেনে নিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন রুদ্রনীল। পাংশু মুখে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ঘাড়টা সামান্য হেলালেন শ্রাবণী। প্রায় বারো দিন হল হাসপাতালে ভর্তি। সারারাত জেগে বসে থাকেন বাড়িতে রুদ্রনীল। চোখ বুজলে বনির মুখটাই শুধু ভেসে ওঠে। পরের দিন আবার ছুটে যান। একই প্রশ্ন, বনির ঠোটের কোনে সেই ম্লান হাসি! আশ্চর্য! ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েও কোনরকম প্রকাশ নেই ! পরেরদিন অপারেশন। ও.টি. র বাইরে রুদ্রনীল কেমন যেন জড় পদার্থের মত। কোন চেতনাই কাজ করছে না। নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। সময় যেন থেমে গিয়েছে! ওই তো, ওই তো ও.টি. র দরজা খুলল। ট্রলিটা বেরোচ্ছে। কিন্তু সবটাই সাদা চাদরে ঢাকা কেন! চিৎকার করতে চাইছেন রুদ্রনীল। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না! ছটফট করতে করতে ঘুমটা ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে গেল পাশের বেডের দিকে। একি! বেড তো খালি! বুক্ টা ধক করে উঠল রুদ্রনীলের। কি হল অনন্যার ! শূন্য বিছানার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন রুদ্রনীল। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে ।