আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুরুষদের অত্যাচার কয়েক যুগ ধরে সহ্য করতে করতে ওখানকার মেয়েদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সহ্যের বাঁধ ভাঙল নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়। যখন তাঁরা ধর্ষিতা হলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে। ধর্ষিতা হওয়ার পরে সমাজ থেকে বেরিয়ে এলেন মোট ১৫ জন সম্বুরু উপজাতির মহিলা। তাঁরা একদম আলাদা এক খণ্ড জমিতে থাকতে শুরু করলেন। ঠিক করলেন, এ বার থেকে পুরুষবর্জিত জীবন কাটাবেন তাঁরা। ফলে ওই জমিতে নিষিদ্ধ হল পুরুষ-প্রবেশ। পরে এই এক খণ্ড জমির নাম হল— ‘উমোজা উয়াসো।’
সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ শব্দের অর্থ হল ঐক্য বা একতা। আর উয়াসো হল উমোজা-র পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। এখানেই নতুন জীবন শুরু করলেন রেবেকা লোলোসোলি এবং তাঁর মতোই আরও ১৪ জন ধর্ষিতা।
উত্তর কেনিয়ায় এই সম্বুরু উপজাতির মধ্যে পুরুষদের প্রচণ্ড দাপট। তার জন্য ধর্ষণ, অল্প বয়সে বিয়ে, যৌনাঙ্গহানি বা খাতনা, বহুগামিতা, পান থেকে চুন খসলেই অকথ্য অত্যাচার এবং ক্রমাগত পারিবারিক হিংসার শিকার হন এই সম্প্রদায়ের মেয়েরা। তাই রেবেকারা ঠিক করলেন, তাঁদের এই নতুন গ্রামে থাকতে পারবেন তাঁদের মতোই অত্যাচারিত মহিলারা। সেটা ১৯৯০ সালের কথা। আজও উয়াসো উমোজা গ্রামে থাকতে পারেন কেবলমাত্র সেই সব মেয়েরাই, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে নিগৃহীতা হয়েছেন। মায়ের সঙ্গে ঠাঁই পায় তাঁদের ছোট ছোট সন্তানেরাও।
আজ এই গ্রামে থাকেন পঞ্চাশেরও বেশি মহিলা এবং তাঁদের দুশোরও বেশি ছেলেমেয়ে। হ্যাঁ, ছেলেরাও এখানে ঠাঁই পায়। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলেই তাঁদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়। এটাই অলিখিত নিয়ম। এখানকার সব মায়েরা সেটা মেনেও নিয়েছেন। তাই এই গ্রামে আঠেরো বছরের বেশি বয়সি কোনও পুরুষই দেখতে পাওয়া যায় না। এই গ্রামের মহিলারা মূলত কৃষিকাজ এবং পশুপালন করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। ইদানিং বেশ কিছু মহিলা অবশ্য রঙিন পুঁতি দিয়ে গয়না তৈরি করছেন। সেই চোখ ধাঁধানো গয়নাগুলো নিজেরাও পরেন, আবার বিক্রিও করেন। তাঁদের তৈরি গয়নাগুলো বেশির ভাগই কিনে নিয়ে যান এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা।
এই গ্রামে পর্যটকদের ঢুকতে গেলে একটা নির্দিষ্ট প্রবেশ মূল্য দিতে হয়। সেই প্রবেশ মূল্য বছরান্তে খরচা হয় গ্রামের উন্নতিকল্পে।
এই গ্রামে স্কুল থাকলেও নতুন প্রজন্মকে এঁরা নিজেরাই জীবনের মূল পাঠটা দিয়ে দেন। খুব ভাল করে বুঝিয়ে দেন জীবনের সাদা-কালো দিকগুলোকে। যাতে তাঁদের পরের প্রজন্মের মেয়েদের আর কখনও নির্যাতিতা হতে না হয়। এই উপজাতির বিভিন্ন বয়সের অন্তত দেড় হাজার মহিলা নিজেদের দেশের এবং বিদেশি সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়েছেন। তাঁদের আর ফিরিয়ে নেয়নি পরিবার। ফলে বাধ্য হয়েই উমোজা উয়াসো গ্রামে এসে নতুন জীবন শুরু করেছেন তাঁরা।
সমাজে ব্রাত্য মেয়েদের এই ভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা মেনে নিতে পারেননি সম্বুরু পুরুষেরা। হুমকি তো দেনই, মাঝে মাঝেই দলবল নিয়ে চড়াও হন গ্রামে।
এই তো কিছু দিন আগেও গ্রামে ঢুকে রেবেকাকে বেধড়ক মারধর করেছেন তাঁর স্বামী। চরম অত্যাচার করলেও এই মহিলাদের মনোবল কিন্তু তাঁরা ভেঙে দিতে পারেননি। এখন অবশ্য প্রতিবাদী রেবেকা এবং তাঁর সঙ্গিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেনিয়া সরকার।
উমোজা উয়াসো গ্রামের এই মহিলারা কিন্তু বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো থাকেন না। তাঁরা বিভিন্ন কাজে আশপাশের গ্রামে যান। আর যেখানেই যান, এই প্রতিবাদী জীবনযাত্রার জন্য তাঁরা আদায় করে নেন কুর্নিশ। এই প্রাপ্তি শুধু নিজেদের চৌহদ্দির মধ্যেই নয়, ২০০৫ সালে এই গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রেবেকা লোলোসোলিকে বিশেষ ভাবে সম্মান জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জেও।
উমোজা উয়াসো গ্রামের গোবরে লেপা মাটির কুঁড়েঘরগুলো আজ সমাজ-খেদানো মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। সেখানে তাঁরা নিজেদের মতো করে বাঁচেন। মায়েদের সঙ্গে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের এইচআইভি পজিটিভ নিরপরাধ সন্তানেরাও।