মনুষ্য সমাজ আজ উন্নতির চূড়ায় বসে। প্রকৃতির অন্যান্য জীবকুলকে সম্পূর্ণভাবে নিজের শাসনে এনে তাদের বাঁচা-মরা অর্থাৎ অস্থিত্ব রক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিজের করায়ত্ত করে মানুষ এখন পৃথিবী ছেড়ে অন্য গ্ৰহ দখল করে সেখানে বসবাসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। সেকারণে মঙ্গল গ্ৰহের অবস্থা মানে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু, সব জানার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এখনও যা ঠিক আছে তাতে হয়তো দুই হাজার তেত্রিশ সালেই পৃথিবী থেকে প্রথম কোন মানুষ মঙ্গলগ্ৰহে যাবে। ঠিক যেমন ‘বাইবেল’ মতে অন্য কোথা থেকে পৃথিবীতেও প্রথম আদম আর ইভ নামে মানব, মানবী এসেছিল এবং তাদের থেকেই মনুষ্য সমাজের সৃষ্টি! অনেকটা সেইরকম আরকি? হ্যাঁ, একটাই তফাৎ এখন পর্যন্ত যা ঠিক আছে তাতে শুধুমাত্র ‘অ্যলিসা কারসন’ নামের একটি মেয়ে একা মঙ্গল গ্রহে যাবেন এবং তিনি আর ফিরবেন না। ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষ মঙ্গলে থাকতে পারবে কিনা তার একটা ট্রায়াল মাত্র। অনেক অনেক বছর পরে যখন ইতিহাস রচনা হবে তখন হয়তো বলা হবে, বাইবেল তো আরো পুরানো ছিল তাই সেখানে মনুষ্য সমাজ সৃষ্টির জন্য নর-নারী দূজনকেই লেগেছিল কিন্তু খৃষ্টের জন্মের দুহাজার পঁয়ত্রিশ বছর পরে উন্নত মানুষ যখন মঙ্গলে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল তখন ডাক্তারী শাস্ত্রের সাহায্যে তাঁর (কারসনের) শরীর এমন ভাবে তৈরি করেছিল যে সে একাই নিজে নিজে গর্ভধারণ করতে পারতো (এখনকার মতো) এবং তার থেকেই মঙ্গলে আজকের মনুষ্য সমাজের সৃষ্টি! এইরকম কিছু একটা যে ঘটবে না বা হতে পারে না তা কি আমরা হলফ করে বলতে পারি? বর্তমানে এখনও পর্যন্ত পুরুষরা গর্ভধারণ করতে পারে না। রূপান্তর কামী পুরুষ হলে আলাদা কথা। পুরুষে পুরুষে, বা নারীতে নারীতে বিয়ে তো এখন অনেক দেশেই সিদ্ধ। এরপর হয়তো এমন দিন আসবে যখন পুরুষের সাহায্য ছাড়া নারী একাই গর্ভ ধারণ করতে পারবে! হয়তো বা ভবিষ্যতে পুরুষরাও গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারবে! বিশ্বাস নেই কিছুই, মানুষের যা চিন্তা ভাবনা তাতে সে যতটা পারে প্রকৃতির গড়া সিস্টেমকে ভাঙাচোরা করে নিজের মতো গড়বে যাতে ভবিষ্যতে নিজের আত্মহননের পথ নিজেই করতে পারে। সে যাইহোক এখনও পর্যন্ত যেহেতু মেয়েরা একাই গর্ভধারণ করতে পারে তাই হয়তো অনেক ভেবে চিন্তে একজন মেয়েকেই প্রথম মঙ্গল গ্ৰহে পাঠানো হচ্ছে। সেই মেয়ে যাকে পুরুষ সমাজ এখনও জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তার জন্য নয়, শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। কথায় কথায় মেয়েদের সৌন্দর্য যাচাই করে তার জীবন পথ মাপার চেষ্টা করে। যে সময়ে মঙ্গলে মানুষ যাচ্ছে তাও আবার একটি মেয়ে, সেই সময়ে কি মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্য দিয়ে তাকে বিচার করবো? না তার বুদ্ধিমত্তা, কর্মক্ষমতা এসব দিয়ে বিচার করবো? আজকের দিনে সমাজ গঠনে নারীদের ভূমিকা কি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীতে যে প্রথম দুবার ‘নোবেল’ পুরস্কার পান তিনি কিন্তু কোন পুরুষ না, তিনি একজন নারী। এরপরেও এই উন্নত সময়ে অহরহ মেয়েদের সৌন্দর্য দিয়ে কি তাকে বিচার করা বা ভাবা ঠিক হচ্ছে? সেই প্রসঙ্গের অবতারণার জন্যই মানুষের উন্নতির পর্যায় এবং মঙ্গলে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ।
এইরকম উন্নতির পর্যায়ে এসেও আমরা সমাজে নারী পুরুষের গুণাগুণ বিচার করার সময় অবচেতন মনে পুরুষের ধনদৌলত, বুদ্ধিমত্তার কথা, আর মহিলাদের শারীরিক সৌন্দর্যের কথা বলি। আর এটা আমরা বলেই থাকি। আধুনিকতার এই চরম পর্যায়ে অর্থাৎ বিজ্ঞানের এই চূড়ান্ত উন্নতির সময়েও সাধারণত নারীদের গুণ বিচার করার সময়ে তাঁর সৌন্দর্যের কথাটাও অবশ্যই আমরা মাথায় রাখি কিন্তু পুরুষদের গুণ বিচারের ক্ষেত্রে তার শারীরিক অবস্থার কোন কথা রাখিনা। রাখি, যদি তার শারীরিক কোন প্রতিবন্ধকতা বা অন্য কোন কারণ থাকে তবেই। উচিত না হলেও বা এটা অমানবিক হলেও আমরা এইরকমই করি। আর এটা কতবড় অন্যায় সে বোঝার মতো ক্ষমতা পুরুষ জাতির নেই তা বলতে পারবো না। বরং এটাই বলতে পারি বা এটাই সত্যি, নারীদের একাসনে বসাতে পুরুষের পৌরুষে আঘাত হানে। অবশ্য, কোথাও যখন নারী-পুরুষের তুল্যমূল্য বিচার করতে বসি তখন অবশ্য অন্য কথা বলি। তখন বলি, নারী শুধু পুরুষের সমকক্ষই নয় অনেক ক্ষেত্রে তারা এগিয়েও। সংসারের দশ দিক একাই সামলায় বলে নারীকে আমরা দুর্গার মতো দশভূজা আর পরিবারের সদস্যদের সবকিছু চাহিদা মনে রাখতে পারে বলে রাবণের মতো দশটা মাথার মানুষ বলতেও কার্পণ্য করিনা। আক্ষরিক অর্থে নারী জাতি তাই হলেও পুরুষ তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না। তাদের এই বক্তব্য যে শুধুমাত্র কথার কথা, আমাদের জীবনের পর্যায়গুলো বিচার বিশ্লেষণ করলেই আমরা নিজেরাই তা বুঝতে পারবো। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা নারীদের থেকে কি চাই? শারীরিক সৌন্দর্য না অন্যান্য গুণ? অবশ্যই সৌন্দর্য। হ্যাঁ, এরমধ্যে অন্য কোন ব্যাপার থাকলে আলাদা কথা। আর এখানেই প্রকৃতির কি অদ্ভুত লীলা। পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকেই মনুষ্য সমাজে পুরুষদের থেকে নারীদের শারীরিক ক্ষেত্রে বেশি সৌন্দর্যমন্ডিত করলেন। কিন্তু জগতের অন্যান্য পশুপক্ষীদের ক্ষেত্রে! সেখানে পুরুষদের দেখতে সুন্দর করলেন। স্ত্রী জাতিকে করলেন না। আমরা আমাদের চারদিকে তাকিয়ে দেখলে তার অজস্র উদাহরণ পাবো। সামান্য পিঁপড়ে থেকে বিশালাকায় হাতি বা সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সিংহ সব পুরুষরাই স্ত্রী জাতির থেকে সুন্দর। পুরুষ ময়ূরের সৌন্দর্যের গুণাগুণ করেন না এমন মানুষ ইহজগতে পাবোনা। হ্যাঁ, হয়তো কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আর মানুষের ক্ষেত্রে! সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতের বুদ্ধিমান পুরুষরা নারীদের চেয়ে সুন্দর নয়, এটা একটু ব্যতিক্রমী মনে হয় নাকি? আর বিচিত্রও, তাইনা? প্রকৃতির এ কি বিচার?
সমাজে নারীদের অন্যান্য গুণ উল্লেখের সাথে সাথে পুরুষ কেন নারীদের শারীরিক সৌন্দর্যের কথাও বলে? সবার প্রথম যেটা মনে হয় ‘বিবেক’। মানুষের (পুরুষের) বিবেক। উন্নত মানুষ যদিও বলে মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোন জীবের কোনরূপ বুদ্ধি, বিবেক নেই। হ্যাঁ, বর্তমান সময়ের মানুষকে দেখলে মনে হয় তার পুরো শরীর জুড়েই বুদ্ধি গিজগিজ করছে। যদিও সেটা সুবুদ্ধি না কুবুদ্ধি সেটা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। আমরা তো দেখছি, মানুষেরই সৃষ্ট অতিমারী আজ মানুষকেই ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আর মানুষ যত উন্নত হচ্ছে পৃথিবী তত দুষণ, হিংসা, ধর্মীয় হানাহানি প্রভৃতিতে একেবারে ভরে যাচ্ছে। মানুষ যেখানে বসে সেখানেই চষে। একেই তো বলে কালিদাসী প্রথায় বাঁচা? সে যাইহোক বুদ্ধি তো অনেক, কিন্তু বিবেক? ওটা কি মানুষের সত্যিই আছে? ওটা হয়তো মানুষ তৈরীর সময় প্রকৃতি দিতে ভুলে গেছেন। আর যদিও বা বিবেক দিয়ে থাকেন তা পৃথিবীর অন্য জীবের থেকে একটু কমই দিয়েছেন। তা নাহলে, আশি বছরের সন্ন্যাসীনী ধর্ষিতা হতেন না বা মায়ের সামনে তার নাবালিকা মেয়েকে দশ জন মিলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতো না। জীবনদায়ী ওষুধের (টীকা) পরিবর্তে নির্বিকার চিত্তে জল বা অন্যকিছু মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দিতো না। ভাবা যায়! তাই বলছি জন্তু জানোয়ারের থেকে মানুষের বিবেকবোধ একটু কম। আর এই বিবেকবোধ কম হওয়ার জন্যই পুরুষজাতি অনেক সময়ই নিজের স্ত্রীর থেকে অপরের স্ত্রী বা অন্য নারীকে সুন্দর দেখে। আমি এখানে ভালবাসার কথা বলছিনা, বলছি শারীরিক সৌন্দর্যের কথা। আর এটার চল আমাদের সমাজে প্রথম থেকেই। পুরুষ সমাজে নারীদের বুদ্ধি নিয়ে হাসিঠাট্টা খুব সাধারণ ব্যাপার একটা। ‘মেয়েলি বুদ্ধি তো’! হাসিঠাট্টার মাধ্যমে আমরা তো প্রায়শই এও বলে থাকি, দূর আগেকারের রাজা, নবাবরাই ভালো ছিল। অন্ততপক্ষে অনেকগুলি বিয়ে তো করতে পারতো। একজন কাজ করবে, একজন বাচ্ছা মানুষ করবে, এইরকম আর কি। আর সতীন নিয়ে আসার কথা তো আজও আমরা অহরহ বলে থাকি। আর সেখান থেকেই বর্তমানে কবিতা, কাব্য, সিরিয়াল বা সিনেমায় নারীদের নিয়ে এমন বক্তব্য বা ঘটনা আমরা অহরহ দেখতে পাই। নিজের স্ত্রীর সামনে অপরের স্ত্রীর বা অপর মহিলার গুণগান সমাজ অশালীন চোখে দেখে না। কিন্তু বিপরীত কিছু ঘটলে পুরুষ কি বলে বা কি করে? তখন আমাদের (পুরুষের) ভদ্রতার মুখোশ খুলে পড়ে। কি ভাষা তখন আমরা ব্যবহার করি, তা কোনদিন ভেবে দেখেছি কি? আমার সামনে কোনদিন যদি আমার মেয়েকে তার স্বামী একই ভাবে বলে তখন বুঝতে পারি এটা কতটা কষ্টকর বা মনকে কতটা ব্যথা দেয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেটা একেবারে সাময়িক। এ সবই ঘটে চলেছে বংশানুক্রমে কারণ পুরুষের বিবেকবোধ এই উন্নত সময়েও একটু কম, তাই।
আর একটা ‘ঈর্ষা’। এটা একেবারে সহজাত। পৃথিবী মানুষ শাসিত আর সমাজ পুরুষ শাসিত। আমরা মুখে যাই বলি সমাজের শাসন ক্ষমতা ঘুর পথে হলেও পুরুষদের দখলে রাখি। অতএব শাসনকর্তার সামনে শোষিতা মাথা তুলে দাঁড়াবে কি? এটা কোনদিন হয় নাকি? তাই পুরুষরা সমাজের অঘোষিত শাসক মানে প্রথম শ্রেণীর আর নারী শোষিতা বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। অবচেতন মনে হলেও এই শাসনের লোভটা আমাদের মজ্জায় মজ্জায় একেবারে ঢুকে গেছে। তাই কিছুটা শারীরিক ক্ষমতার জোরে আর কিছুটা প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির জোরে পুরুষ নারীকে অবদমিত করে রাখে। আর সেখানেই বুদ্ধি, বিবেচনার সাথে পুরুষ কৌশলে নারীর শারীরিক সৌন্দর্যের কথাও তুলে আনে। মানে এটাই বোঝায় সৌন্দর্য প্রকৃতির দেওয়া আর অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি এগুলো অর্জন করতে হয়। তাই, পুরুষ সমাজ নারী সমাজ থেকে বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে।
আমরা বলি, পৃথিবীতে কেউই একেবারে পারফেক্ট নয়। ঠিক তেমনি মনুষ্য সমাজেও পুরুষের শারীরিক গঠন বা ক্ষমতার তুলনায় নারীরা শারীরিক ভাবে দুর্বল আর সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নারীরা বেশি মোহময়ী বা সুন্দরী যাতে অন্ততপক্ষে অবিবেচক, লোভী পুরুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও নারীদের থেকে বা স্ত্রীর থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে না পারে। শুধু মনুষ্য সমাজে নয় পু্রো জীবকুলেই পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক গুণবতী। তাই, নারীর শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়, মায়া – মমতা, সহনশীলতা এসব গুণের জন্যেও মানুষের সামাজিক বন্ধন এখনও অটুট।