নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া উপজেলা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিল বেষ্টিত গ্রামটির আয়তন গ্রায় দুই বর্গকিলোমিটার।
চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল নেই। ঝগড়া-বিবাদ বা কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নেই।এমনকি স্বাধীনতার পর এই গ্রামের কেউ কখনও মামলা করতে থানায় যায়নি।সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন গ্রামের সবাই। বিস্ময়কর এ গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। এটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত।
গ্রামের বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক প্রামাণিকসহ অন্যরা সাময়িকীকে জানান, ‘এখানে শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। শীতকালে এই গ্রামে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে, কিন্তু পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর।
ব্রিটিশ আমল থেকে নিজস্ব স্বশাসন ব্যবস্থা চলে আসছে এখানে। এ গ্রামে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, মাদক ব্যবসা নেই। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী, শতাধিক চিকিৎসক। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।’
হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি মো. আলমগীর কবীর শাহ সাময়িকীকে জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে জেনেছি ১৯১৪ সালে প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যায়, এই গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষী ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা।
গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধা একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়।
এই পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন সভাপতি, একজন সহসভাপতি ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এছাড়া ৫ জন উপদেষ্টা থাকেন। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করেন।
এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করেন। বড় কোনো অপরাধ সংগঠিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর করে। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়ায় প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। শুরুতে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেন। পরে এখানে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বর্তমানে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় দুটি স্কুলও চলছে। চলনবিলবেষ্টিত হওয়ায় আগে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই ছিল গ্রামটির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে পরিষদের চেষ্টায় এখন সারা বছর সড়কপথে যাওয়া যায় এই গ্রামে।এই গ্রামে ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়।
ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
একটা সময় এই গ্রামে কোনো কবরস্থান ছিল না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কেউ মারা গেলে পুকুরপাড় ও কোনো উঁচু স্থানে তাকে কবর দেয়া হতো। পরিষদের চেষ্টায় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান করা হয়েছে। কবরস্থানের দেখভালের জন্য আছে ছয় সদস্যের একটি কমিটি।
চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল ইসলাম ভোলা সাময়িকীকে জানান, ‘পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে।
হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ সাময়িকীকে জানান, আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে নিজেদের মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যে- শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ।
আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিঞা, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম একে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমত উল্লাহ প্রমুখ। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রেখে সবাই মিলেমিশে গ্রামে সুশিক্ষা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনই আমাদের মূল লক্ষ্য।
সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর-ই-আলম সাময়িকীকে জানান, থানার পরিসংখ্যানই বলে, হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। জমিজমা নিয়ে বিরোধ হলেও গ্রামের পরিষদই তা সমাধান করে।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম সামিরুল ইসলাম সাময়িকীকে জানান, হুলহুলিয়া গ্রাম দেশের আর দশটা গ্রাম থেকে অনেকটা আলাদা। এই গ্রামের মানুষ সামাজিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
জেলা প্রশাসক মো. শামীম আহমেদ সাময়িকীকে জানান, ‘আমি বিমহিত হয়েছি, এটা শুধু নাটোর জেলার জন্য না সারাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে এ গ্রামে কোনো মামলা নাই। গ্রামের বিচার ব্যবস্থা, শতভাগ শিক্ষিতের হার, নির্বাচনের পদ্ধতি সবকিছু মিলে নাটোরের জন্য অহংকারের বিষয়।’পরবর্তীতেও তারা এটা বজায় রাখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক।
গ্রামবাসী মনে করেন, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ও শতভাগ শিক্ষিত হওয়ার কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও মননে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। একারণে গ্রামের মানুষজন কলহ ও সংঘাত থেকে দূরে থাকেন। এছাড়া গ্রামটি পরিচালনার জন্য তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। যা সবাই মেনে চলেন।
গ্রামে কোনো সমস্যা-সংকট দেখা দিলে গ্রামবাসী মিলে সংবিধানের আলোকে সমাধান করেন। গ্রামবাসীর দাবি, গত ২০০ বছরে কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য পুলিশকে তাদের গ্রামে যেতে হয়নি। শুধু তাইনা, গ্রামের মানুষজন শতভাগ শিক্ষিত। গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুকমুক্ত। এজন্যই গ্রামটিকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।