ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের শোষণ ও নির্যাতনের ইতিহাস কম বেশী অনেকের জানা। এই উপমহাদেশ থেকে বহু আগে ইংরেজদের পতন ঘটলেও তাদের শোষণ নির্যাতনের নানা স্মৃতি আজও রয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ব্রিটিশ শাসনামলে নীল চাষের জন্য কৃষকদের ওপর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীলকর ইংরেজ সাহেবদের নির্যাতনের নির্মম স্মৃতি কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা দিয়ে অতিবাহিত হওয়া বড়াল নদীর পারে নওশেরা গ্রামের নীলকুঠিবাড়ি।
অযত্ন আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এই নীলকুঠি বাড়িটি ধসে পড়ে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে। ইতোপূর্বে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে বাগাতিপাড়া সদর, পারকুঠি, নূরপুর, কুঠি বাঁশবাড়ীয়া, চিথলিয়া এলাকায় ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সময় তৈরি স্থাপনা।
তাদের সময়কার অনেক সম্পদ এখন বেদখল হয়ে গেছে। তবে এখনও কালের স্বাক্ষী হিসেবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া ধংসপ্রায় নওশেরা গ্রামের নীল কুঠিবাড়ি সংস্কারসহ ইংরেজদের নির্মম নির্যাতন কাহিনী সংরক্ষণ করার দাবী স্থানীয়দের।
সম্প্রতি নওশেরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেই অভিশপ্ত নীলকুঠিটি চিনিকলের আখ ক্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নীলকুঠির তিনদিকের জমিতে চাষ করা হচ্ছে আখ। কুঠির পেছন দিকের বারান্দার সামনে পালা করে রাখা হয়েছে কর্তনকৃত আখ।
কুঠির পেছন দিকটি দেখে বোঝার উপায় নেই সামনে আছে শত বছরের ব্রিটিশ নির্যাতনের ইতিহাসের সাক্ষী কুঠির ফটক। পেছন পেরিয়ে সামনে এগিয়ে দেখা যায় কুঠির সম্মুখভাগের বারান্দা জঙ্গলে ঢাকা। সেসব পেরিয়ে সামনে গেলেই উঁকি দিচ্ছে ছয়টি দরজা।
দুইশো বছরের পুরাতন কুঠির দেয়াল ভেদ করে ভেতরে জন্মেছে লতা-গুল্ম, যা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। পাশের একটি ভাঙ্গা দরজা পেরিয়ে ভেতরে গিয়ে বোঝা যায় দৈর্ঘ-প্রস্থে কতটা বড় কুঠির এক একটি কক্ষ। একেটি কক্ষে যেন শোনা যায় নীলকরদের চাবুক খাওয়া কৃষক-প্রজার আর্তনাদ।
বেশ কয়েকটি কক্ষে দেখা গেছে শীতের তীব্রতা থেকে উষ্ণতার জন্য নির্মিত ফায়ারপ্লেস। নীলকুঠি থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই পাওয়া যায় পারকুঠি। পারকুঠিতেই জমা করা হত জমি থেকে কেটে আনা নীলগাছ।
পারকুঠির অদূরে একটি পুকুরেই ধোঁয়া হতো নীলগাছগুলো। সেই পুকুরটি এখনও রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। তবে পারকুঠিটি কয়েকদফা ভূমিকম্পে বিলীন হয়ে গেলেও এখনও রয়েছে কিছু স্মৃতিচিহ্ন। স্থাপিত পারকুঠির নামেই এলাকার নামকরণ হয় পারকুঠি।
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ব্রিটিশ শাসনের সময় ইংরেজরা বাগাতিপাড়ার নওশেরা, পারকুঠি, নূরপুর, কুঠি বাঁশবাড়ীয়া, চিথলিয়া এলকায় কুঠিবাড়ী স্থাপন করে স্থানীয় নিরীহ বাসিন্দাদের দিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ জমি পরিষ্কার করে নীলচাষের উপযোগী করে।
আর কৃষকদের জোরপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করা হত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সে সময়ের স্থাপিত এই উপজেলার নীলকুঠিয়াল সাহেবদের অফিস-আদালত এবং নীল সংরক্ষণাগারসহ বহু স্থাপনা ভূমিকম্পে মাটির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
কিছু কিছু স্থানে এই নীল কুঠি ও কলকুঠিগুলির কিছু অংশ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলকুঠি তারই অংশ বিশেষ নীলকর ইংরেজ সাহেবদের ডাকবাংলো। আজও এসব এলাকায় রয়েছে অভিশপ্ত নীল চাষ-নীলকর আদায়কারী সাহেবদের নিয়ে আসা সাওতাঁল-বাগদীসহ বিভিন্ন আদিবাসী।
স্থানীয় শিক্ষাবীদ, রাজনৈতিক প্রবীণ ব্যাক্তি ও স্থানীয় গবেষকরা বলছেন, নীল চাষে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় তাদের মধ্যে কুরীয়াল টিসি চুইডি, সিনোলব ম্যাকলিইড, ডাম্বল, ব্রীজবেন নিউ হাউজ সাহেবদের নাম উল্লেখযোগ্য।
এসব নীলকর সাহেবরা রাজশাহী, ঝিনাইদহ, শিকারপুর, কেশবপুর এবং নাটোরের বাগাতিপাড়া এলাকায় জোর পূর্বক নীল চাষ করাতো। পরে ইংরেজদের নিকট থেকে ভারত ও পূর্ববাংলা ভাগাভাগীতে রেনউইক এন্ড কোং পূর্ব বাংলা এবং ভারতের সমস্ত কুঠিগুলির মধ্যে নওশেরা তথা পূর্ব বাংলার সমস্ত সম্পদ রফিক এন্ড কোং এর নামে হয়ে যায়।
স্থানীয়দের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে , রফিক এন্ড কোং তার দখলদারিত্ব পাওয়ার পর নাটোর চিনিকল স্থাপনের পরমুহুর্তেই রেনউইক কোং এর পক্ষ থেকে রফিক এন্ড কোং বাংলাদেশ সুগার কর্পোরেশনকে নওশেরা কলকুঠি ও কুঠিয়ালদের সকল সম্পত্তি দিয়েছেন।
তারই ফলশ্রুতিতে সুগার কর্পোরেশন কোটি কোটি টাকার বিশাল গাছ লুটপাটের মত কেটে নিয়েছে। কালের স্বাক্ষী হিসেবে পড়ে রয়েছে ইংরেজ সাহেবদের জন্য তৈরি নীলকুঠি নামে পরিচিত নওশেরা গ্রামের সেই ডাকবাংলো।
এক সময়ের ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন অভিশপ্ত নীল কুঠিরের ডাকবাংলো অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। বিলীন হয়ে যেতে বসেছে ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা। কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা শতবর্ষী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নুর মোহম্মদের সাথে।
তিনি সাময়িকীকে জানান, ‘পারকুঠি ও নওশেরা গ্রামে ইংরেজরা নীলচাষের উপযোগী করে কুঠিবাড়ি স্থাপন করে। নীলকররা কুঠিবাড়ি স্থাপন করার পর ভারত উপমহাদেশ থেকে আদিবাসী ‘বাগদি’ সম্প্রদায়ের লোক এনে এখানকার জঙ্গল পরিস্কার করে।
এছাড়া খাজনা আদায়ের জন্য আনা হয় পাঠান খানদের। পরে এসব জমির মালিকদের নীলচাষে বাধ্য করা হয়। যারা অসম্মতি জানাতো তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ওই কুঠি বাড়িতে চাবুক পেটা করা হতো। নির্মম নির্যাতন করে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করা হতো।
চাষকৃত নীল কেটে কুঠি বাড়িতে এনে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে নীল তৈরী করা হতো। কিন্তু কৃষকদের ন্যায্যমূল্যও দেয়া হতো না। উপরন্তু মাথায় কাদা মাখিয়ে চাবুক পেটা করা হতো।’
নশেরা গ্রামের বাসিন্দা রনজিত সরকার সাময়িকীকে জানান, ‘তার বাবা ইংরেজ নীলকর সাহেবদের এখানে ঘোড়া গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করতেন। তিনিও দেখেছেন নীল চাষের জন্য কৃষকদের নির্যাতন করা হয়েছে এই কুঠিবাড়িতে ধরে এনে। ইংরেজদের পতনের পর পরে তার বাবা রেনউইক কোম্পানীতে কাজ করেছেন।’
নওশেরা গ্রামের বাসিন্দা সমাজসেবক আশরাফুল আলম খান ডাবলু সাময়িকীকে জানান, ধ্বংসপ্রায় ওই কুঠিবাড়ি সংস্কারসহ ইংরেজদের নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস সরকারি ভাবে সংরক্ষণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
স্থানীয় সচেতন মহলের নাগরিকরা বলছেন কুঠিবাড়ি, নীল তৈরির জন্য পুকুর, ডাকবাংলোসহ নানা স্থাপনা সংস্কারের পাশাপাশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণ করা উচিত। নইলে অদূর ভবিষ্যতে এই স্মৃতিগুলো বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।