পর্ব – সতেরো: বাস্তবের সড়কে কেন এত মোড়?
চন্দনাকে উদ্ধারকারী পুলিশসদস্য হাসপাতালের ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলেন রোগিণীর পাশে। সিভিল ড্রেসে আসায় অনেকে তাকে চিনতে না পারলেও উপস্থিত চেনা সাংবাদিকরা তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। রোগিণীর পাশে দাঁড়ানো উর্বশীর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিই রোগিণীর বোন, ম্যাডাম?’
প্রশ্ন শুনে পাশে ঘেঁষে দাঁড়ানো সাংবাদিকদের একাংশ সরে যেতে লাগল পেছনের দিকে।
এখনও উত্তর দেয়নি উর্বশী। উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলেন না পুলিশ সদস্য। খোঁজ করতে লাগলেন কর্তব্যরত চিকিৎসকের।
পাশে দাঁড়ানো নার্স বলল, ‘জরুরি ব্যবস্থাপত্র ট্রিটমেন্ট সিটে লিখে উনি রোগিণীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার করেছেন। ডিউটি রুমেই আছেন তিনি।’
‘ফাইলে ‘পুলিশ কেস’ সিল দিয়েছেন?’ নার্সের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘জি। দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্রও তৈরি করে রেখেছি আমরা।’
আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল কণ্ঠ থেকে। তাৎক্ষণিক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে আঙুল তুলে উর্বশীর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘উনি কি মা?’
‘জি।’
‘আসুন। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিই আমরা।’
ভিড় হটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। একজন রিপোর্টার পুলিশের কাছ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলেন, ‘রোগিণী কলগার্ল নয়? লোকাল পত্রিকায় তো তাকে সেভাবেই লেবেল করেছে।’
পুলিশ সদস্য বললেন, ‘আমিই নির্যাতিতা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছি, আমাকে তো কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। পত্রিকা অফিসে কে জানাল যে সে কলগার্ল?’
প্রশ্ন শুনে দমে গেল রিপোর্টার। ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল উর্বশীর সামনে থেকে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগিণীর অবস্থা বর্ণনা করে ওদের বললেন, ‘জরুরি চিকিৎসা পুরোপুরি দিতে পেরেছি, বলব না। মনে হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে জঙ্গলের খাদে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, দেহাভ্যন্তরে কিংবা মস্তিষ্কে কোনো রক্তপাত হয়েছে কিনা নিশ্চিত নই আমরা। ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো দরকার মনে করেছি। কাগজপত্রও করে রেখেছি আমরা। উপযুক্ত অভিভাবক কিংবা আপনাদের মাধ্যমে তাকে ঢাকায় পাঠানো উচিত।’
অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগল উর্বশীর চোখের আলো। কোরালপ্রাচীরের শক্ত তলে চাপা খেতে লাগল বুক। চাপা শ্বাস ঠেলে বেরিয়ে এলো তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, ‘ওকে কি রেপ করা হয়েছে?’
‘পুরোপুরি রেপড হয়েছেন বলা যাবে না, তবে শারীরিক জখম আছে তার শরীরে। গলা ঠেসে ধরে শ্বাসরোধ করার প্রমাণচিহ্ন আছে। চেষ্টা হয়েছিল ধর্ষণের। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভিকটিম সম্ভবত তা প্রতিরোধ করতে পেরেছেন।’
পুলিশ সদস্য কথাটার শেষাংশ লুফে নিয়ে বললেন, ‘ধর্ষণের চেষ্টাও ধর্ষণের আওতায় পড়ে। তবে সর্বোচ্চ পরিণতি থেকে সম্ভবত নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন ভিকটিম।’
ওদের কথা থেকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুমান করতে পেরে ভীত হলেও, জিভ ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হতে লাগলেও আকস্মিক চোখের আঁধার ফুঁড়ে প্রসব ঘটল নক্ষত্রের। আলোর কামড় খেল চেপে ধরা বুকের পাটাতন। দীর্ঘশ্বাসের পাশাপাশি পায়ের তলেও পরিষ্কার সন্ধান পেয়ে গেল শক্ত মাটির। বুঝল কেবল ক্ষণস্থায়ী বালির বাঁধে উঠে আসেনি ও, মাটি ফেটেও বেরুচ্ছে সবুজ গুল্মরাশি। আর তখন ঘটল আত্মবিশ্বাসের বিস্ময়কর উদ্ভাস। প্রত্যয়ী কণ্ঠে উর্বশী বলল, ‘ভিকটিমকে ঢাকা নিয়ে যাব। সব ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ।’
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। চিকিৎসক ও পুলিশ সহায়তা করলেন। সব প্রস্তুতি শেষে পুলিশটি বললেন, ‘আমি এ থানার এএসআই- জলিল। আমার নম্বর স্টোর করে রাখুন। যেহেতু এখানেই ধর্ষণ চেষ্টা হয়েছে তাই মামলা চলবে এ থানা থেকে। আমার সর্বোচ্চ সহায়তা পাবেন আপনারা।’
অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের ভিন্ন সড়কে উঠে গেল উর্বশী। বাস্তবের সড়কে এত মোড়! এত বাঁক খেতে হয়! আর কত বাঁক খেতে হবে? আলোর কণারূপে প্রশ্নগুলো ছড়াতে লাগল বিশ্বলয়ে। তখনই মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কাজী নজরুল ইসলামের ত্রিতালের ভৈরবী ভজন :
খেলিছ এ বিশ্ব ল’য়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে॥
শূন্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা-বিলাসে;
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥
চলবে…