বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিদের মাঝে এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশকে বাংলাভাষার “শুদ্ধতম কবি” বলা হয়। কবি কুসুমকুমারী দাশের জ্যেষ্ঠ সন্তান মিলু হলো কবি জীবনানন্দ দাশ যিনি বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কবি হিসাবে সর্বসাধারণ্যে আজ স্বীকৃত।
তাঁর দুঃখ-দুর্দশা- দারিদ্র, কল্পনা, ভাবনার জগত আর সাদামাটা জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে। বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনবোধের যে প্রকাশ তিনি করে গেছেন রবীন্দ্র উত্তরকালে তা সত্যিই বিরল। তাঁর রচিত ’বনলতা সেন’ কবিতার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর সুন্দর রূপের উপলব্ধি প্রকাশ করে গেছেন। কিশোর বয়সেই ছড়া লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। সম্ভবত তাঁর মা কবি কুসুমকুমারী দাসের প্রভাব তাঁর উপরে ছিল। ১৯১৯ সালে বরিশালে মনমোহন চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা ’বর্ষ আবাহন’ ছাপা হয়। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা না হলেও পত্রিকার বাৎসরিক সূচিপত্রে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়েছিল। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঐ একই বছরে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ’স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ প্রবন্ধটি ’ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় (এটি ছিল সাধুভাষায় তাঁর রচিত একমাত্র প্রবন্ধ) এবং ’কল্লোল’ পত্রিকায় ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়।
কবি পেশাগত জীবনে ছিলেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলে তিনি আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েন, কিন্তু থেমে যায়নি তাঁর লেখা। টিউশনি আর কলকাতা, ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকলে সেখান থেকে সামান্য পরিমাণে আয়-রোজগার হত। ১৯৩২ সাল থেকে বেকারত্ব, অর্থ সংকট, পরমুখাপেক্ষিতা তাকে করে তোলে অপমানিত ও অবসাদগ্রস্থ। জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ ‘জীবনানন্দ দাশের দিনলিপি’তে লিখেছেন: ‘নানা রকমভাবে এই অকর্মক জীবনযাপন ঘোচাবার চেষ্টা তিনি (জীবনানন্দ) করেছেন।’
১৯৩৩ সালে তিনি ২৩টি ছোটগল্প লেখেন। ‘কারু বাসনা’, ‘জীবন প্রণালী’ ও ‘বিভা’ নামে তিনটি উপন্যাস লেখেন যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। অর্থ সংকট ঘোচাবার লক্ষ্যে তিনি সিনেমার গান লেখারও পরিকল্পনা করেছিলেন। বরিশালে থাকাকালীন তিনি ‘রূপসী বাংলা’র ৬১টি সনেট কবিতা রচনা করছিলেন এবং ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ নামে নামকরণ করবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু এই বইটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫৪ সালে কবির মহাপ্রয়াণের পর কবির বোন সুচরিতা দাশ এবং ভূমেন্দ্র গুহ ১৯৫৭ সালে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। ভূমেন্দ্র গুহ তার ‘আলেখ্য: জীবনানন্দ’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, সিগনেট প্রেসের দীলিপ কুমার গুপ্ত গ্রন্থটির নাম রাখেন ‘রূপসী বাংলা’। এই গ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় আবহমান বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছে। তিনি প্রকৃতির পাশাপাশি রূপকথা, পল্লীগীতি, পাঁচালী, লোককথা, ইতিহাস, পুরাণ ও প্রবচনের আত্মীকরণ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর লেখা সর্বমোট ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প অপ্রকাশিত ছিল। জীবনানন্দ দাশের কাব্য সংগ্রাহক দেবীপ্রসাদ বন্দোপ্যাধ্যায় লিখেছেন: ‘কবি শিক্ষা বা অনুশীলন বলে সরিয়ে রেখেছিলেন কবি খাতাখানি, বহু আমন্ত্রিত হওয়ার অধ্যায়েও পত্রিকাতে ছাপেননি’।
জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পরে যতটুকু জনপ্রিয় তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ততটাই জনপ্রিয় ছিলেন না। তৎকালীন সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন নতুন কাব্যধারা নির্মাণ করতে যেয়ে। জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রতার মধ্যে। তবু তাঁর মানবিক চেতনা, তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, তাঁর লেখা কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ আজও মানুষের ভাবনার দরজায় কড়া নেড়ে যায়…