পর্ব – ষোল: অনন্য শূন্যতারও রয়েছে পরিধি
চন্দনার কাছে ভিড়তে পারছে না উর্বশী, সঙ্গে আসা চন্দনার মা-ও ভিড়ের মধ্যে ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টারদের ঠেলে এগোতে পারছেন না। বোকার মতো ওরা দাঁড়িয়ে রইল হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের পাশে। নিজেদের পরিচয় দেবে কাকে- নিরাপত্তারক্ষী কারা, আদৌ নিরাপত্তারক্ষী আছে কিনা, না জেনে, খুঁজতে লাগল উদ্দেশ্যহীন। নিজেকে বড্ড একা মনে হতে লাগল। একাকী মনোভাবের সঙ্গে যুক্ত হলো শূন্যতার অভাবনীয় চাপ। শূন্য বুক। শূন্য চোখ। চাউনি শূন্য। উর্বশীর কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না।
হঠাৎ তাকাল পায়ের দিকে। হেমন্তের নরম রোদের বিকিরণ ঘটতে দেখল জীবনকামড়ের ক্ষত থেকে। সাথে সাথে পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল শূন্য ভাবনাপাত্র। সঙ্গে সঙ্গে কল করল রাতে কর্তব্যরত গাজীপুরের টহল পুলিশকে।
রাতের ডিউটি শেষে ব্যারাকে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার শিরোনাম পড়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক এ মুহূর্তে উর্বশীর কল পেয়ে উদ্বেগ কেটে গেল তার। ব্যথিত মনে স্বস্তি ফিরে পেলেন।
কল রিসিভ করে পুলিশ বললেন, ‘এসেছেন আপনারা?’
‘জি। এসেছি। মা-ও এসেছেন।’
এ মুহূর্তে চন্দনার মা অধিষ্ঠিত হয়ে গেলেন নিজের মায়ের আসনে। ‘চন্দনার মা এসেছেন’ না-বলে বলল ‘মা-ও এসেছেন’- শব্দ তিনটির ভেতর থেকে আলাদা একটা তাজা শক্তির উদগীরণ ঘটল। সেই শক্তিতরঙ্গ ছুঁয়ে গেল পুলিশ সদস্যের মনও।
চন্দনাকে পত্রিকার শিরোনামে সম্বোধন করা হয়েছে পেশাজীবী যৌনকর্মী হিসেবে। এ শব্দটি মানতে পারছিলেন না চন্দনাকে উদ্ধারকারী পুলিশ। পেশাজীবী বহু যৌনকর্মী ধরেছেন তারা- এ মেয়েকে সেই ধরনের মনে হয়নি একবিন্দুও। এ ধরনের ভুল নিউজের ক্ষতিকর প্রভাব ভয়াবহ। সামাজিক ঘৃণা আর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে মনে হলো এক ঝটকায়। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবেই কেউ এমন খবর রটিয়েছে। অদক্ষ সাংবাদিকরা লুফে নিয়ে তা প্রকাশ করে দিয়েছেন! উর্বশীর উত্তর শোনার পর তাই রাতের টহল পুলিশের চোর বা সন্ত্রাসী খোঁজার মনোভাবের চেয়েও বিপদগ্রস্ত একজনকে উদ্ধার করতে পারার গৌরববোধ ছড়িয়ে গেল মননে। তিনি জানালেন, ‘আমার এখন ডিউটি নেই। আজ আমার অফ ডে। তবু আসছি আমি। আপনারা রোগীর পাশে থাকুন।’
সংযোগ কেটে গেছে দেখে উর্বশী আবার তাকাল নিজের পায়ের দিকে। আবারও বিপুল উদ্দীপনায় ঝিকমিক করে বেরুতে দেখল হেমন্তের রোদকণা। রোদের বিকীরণ চোখে পুরে ও এবার তাকাল এক ব্যস্তত্রস্ত রিপোর্টারের চোখের দিকে। বলল, ‘প্লিজ আমাদের একটু ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করুন।’
রিপোর্টার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কারা? ভিকটিমের দলের কেউ?’
‘দলের মানে? উনি মা আর আমি ওর বোন।’
উত্তর শুনে হকচকিয়ে গরগর করে রিপোর্টার প্রশ্ন করল, ‘যৌনকর্মীদের মা থাকে? বোনও থাকে?’
‘আবোলতাবোল কী প্রশ্ন করছেন? পথ ছাড়ুন।’ গর্জে উঠল উর্বশীর কণ্ঠস্বর। তার দৃপ্তস্বরে কেঁপে উঠল পুরো ক্যাম্পাস। হাসপাতালের স্যাঁতসেঁতে আলো-বাতাসহীন ওয়ার্ডে প্রতিটি শব্দতরঙ্গ থেকে সারবাঁধা বর্ণগুলো লাইনচ্যুত হয়ে ছুটোছুটি করে প্রতিধ্বনিত করতে লাগল উর্বশীর গর্জন। কেবল ‘পথ ছাড়ুন’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না দৃপ্ত উচ্চারণের ধার। সেই ধারাল শব্দোল্লাসের ভেতর থেকে ঝকমক ছড়াতে লাগল শর্ট সার্কিটের মতো আলো, তরঙ্গজ্যোতি। হকচকিয়ে দ্রুত সরে গিয়ে পথ খুলে দেওয়া রিপোর্টারদের উদ্দেশ্যে উর্বশী প্রশ্ন করল, ‘উনি কি শব্দ উচ্চারণ করেছেন, শুনেছেন আপনারা? সবার ছবি তুলে রাখলাম।’ বলেই মোবাইল সেট দিয়ে বিভিন্ন ডিরেকশনে সবার ছবি ধারণ করে আবার বলল, ‘উনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। সাক্ষী দিতে হবে সবাইকে।’ তারপর গটগট করে হেঁটে গেল সে চন্দনার পাশে।
কাছে গিয়ে চন্দনাকে দেখল- চোখ বুঁজে আছে চন্দনা। স্যালাইন চলছে। মা পাশে দাঁড়িয়ে মমতার হাত ছোঁয়ালেন মেয়ের কপালে। মমতার স্পর্শে খুলে গেল চোখ। দুই প্রিয়জনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একবার নির্ভরতার শ্বাস ঢুকল ভেতরে। আবার চোখ বন্ধ করল। ঠোঁটটা একবার কেঁপে কেঁপে উঠল। আনন্দঢেউ ছুটে গেল চন্দনার মুখের রেখাচিত্রে।
বদ্ধ চোখের পাতা ভিজে গড়িয়ে পড়তে লাগল কয়েক ফোঁটা অশ্রু। এ সময় এক রিপোর্টার এসে প্রশ্ন করল, ‘আপনারা উনার কে হন?’
উত্তর দিল না উর্বশী। নিস্তব্ধ মায়ের মুখেও উত্তর নেই। কথা নেই।
‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’ আবারও প্রশ্ন করল রিপোর্টার। এবারও উত্তর পেল না রিপোর্টার।
‘উনি একজন যৌনকর্মী? কথাটা কি ঠিক?’
প্রশ্ন শুনে ক্ষণকালের জন্য নির্বাক হয়ে রইল উর্বশী। তারপর আগুন চোখে তাকাল প্রশ্নকারীর দিকে। ক্রোধের পারদ ধাই ধাই করে উঠে গেল বিপদসীমার উপরে।
আবারও প্রশ্ন, ‘এ পেশায় কতদিন ধরে আছেন আপনারা?’
দ্রিম করে একটা চড় উড়ে এসে আঘাত হানল রিপোর্টারের গালে। চড় খেয়ে অনেকটা উড়ে গিয়ে দুই-তিনজনের ওপর আছড়ে পড়ল প্রশ্নকারী। চড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে অদৃশ্য বৈদ্যুতিক শকও। উর্বশীর চোখ-মুখ থেকেও চর্তুমুখী ছড়িয়ে যেতে লাগল বিদ্যুতঝড়।
এত শক্তি হাতে জড়ো হয়েছে কোত্থেকে? নিজেই তাজ্জব উর্বশী। জমায়েত পুরুষ রিপোর্টারের দলসহ মোবাইল হাতে উৎসুক জনতাও প্রথমে ঘাবড়ে গেছে, তারপর ঝটপট সবাই তার স্ন্যাপ নেওয়া শুরু করেছে। সেদিকে খেয়াল নেই উর্বশীর। প্রশ্নকারী রিপোর্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে কণ্ঠে সিংহের গর্জন তুলে জবাব দিল, ‘তোর মা যৌনকর্মী, তোর বোন যৌনকর্মী, তোর বউ কিংবা প্রেমিকাও যৌনকর্মী, বুঝেছিস?’
আহত সাংবাদিক কোনোমতে দাঁড়িয়ে আবারো কী যেন বলতে চাচ্ছিল।
তীব্রগতিতে ছুটে যাওয়া যুদ্ধবিমানের আওয়াজের মতো আবারও ঝংকৃত হলো উর্বশীর কণ্ঠে, ‘সামরিক নারীবৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হকের নাম শুনেছিস? ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই লুৎফীর কথা শুনেছিস? মেয়েরা এখন আকাশ জয় করছে, আকাশযোদ্ধা হয়েছে। আর কতকাল অবলা নারী হিসেবে মেয়েদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করবি তোরা? বল, আর কত কাল?’
ঝড়ো আক্রমণ আর ভর্ৎসনার অপমান-যন্ত্রণা সামলে নিয়ে নত হয়ে এবার রিপোর্টার বলল, ‘স্যরি ম্যাডাম। এখানকার আঞ্চলিক পত্রিকার খবরে উনাকে যৌনকর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি কেবল তার সত্যতা যাচাই করার জন্য প্রশ্ন করেছিলাম।’
আক্রান্ত রিপোর্টারের জন্য অনুতাপ জাগলেও পোড়ামনের ক্ষতে নুনের ছিটা খেল। জ্বলে উঠল পোড় খাওয়া ক্ষত। এবার জিঘাংসার বহির্মুখী তির নয়, অন্তর্মুখী ছুরির বিষফলা ঢুকে গেল গহিনে। ক্ষণকালের জন্য গহিনতলে জেগে উঠল শূন্যতা। ক্ষণকালকে মনে হলো অনন্তকাল। অনন্ত শূন্যতা ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে কপালে বসিয়ে দিল হতাশার গোপন তিলক। নারীর এ শূন্যতার কি সত্যিই কোনো শেষ নেই?
নিজের দিকে ছুটে আসা প্রশ্নের আগুনতাপ থেমে গেল। পোড়ানোর আগেই নিভে যেতে লাগল তাণ্ডব তাপদহন।
কে যেন হাত রেখেছে ওর বুকের বাঁ পাশে।
কে? কে বাড়াল এমন মর্মছোঁয়া হাত? কে জানাল এমন উষ্ণ নিবেদন? কার পুণ্যকিরণে ধুয়ে যাচ্ছে অপমানের জ্বলুনি, লেপন?
উত্তরের জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ পেল না উর্বশী। ‘মলিন মর্মের কালিমা ঘুচায়ে’ রজনীকান্ত সেনের শব্দ ঢেউয়ে চড়ে স্বয়ং বুকের মধ্যে হাজির হলো অর্ণব। ফিসফিস করে বলল, ‘বি কুল বি ইজি।’
সঙ্গে সঙ্গে উর্বশী টের পেল বুকের ঘরে বিস্তৃত অনন্ত শূন্যতা সীমাহীন নয়। শূন্যতারও পরিধি রয়েছে, সেই পরিধির কেন্দ্র থেকে হতাশার তিলক ঠেলে বেরুচ্ছে সমর্পণের জোছনাফুল। আর তার পাপড়ি থেকে ছড়াচ্ছে চন্দন সৌরভ। সৌরভের কণাতরঙ্গে ভর করে বুরবুর করে বেরুচ্ছে অর্ণবদ্যুতি, চন্দন রোশনি।
চলবে…