ঢ্যাপা ঢেঁকি বা ঢেঁকি শাক
ঢ্যাপা শাক। কেউ বলেন বৌডগা। অবার অন্য মুখে ‘ঢেঁকি’।
বর্ষা কালে ফলন খুব। কলকাতা তথা রাজ্যের প্রায় সব জেলার বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। কলা পাতায় মুড়ে সব্জিয়ালারা খুব যত্ন করে বাজারে আনেন সবুজ লকলকে ঢেঁকি শাক। শাকের ডাঁটা খুব নরম। মাথাগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত বাঁকানো।
কাচা লঙ্কা ও কাসুন্দি দিয়ে সেগুলো মেখে খেতে ভালোবাসেন বহু বাঙালি। তবে অন্য ভাবেও খাওয়ার চল আছে। পশ্চিমবঙ্গ বা বাঙালাদেশ ছাড়াও অন্য বহু স্থানে এই শাক ভক্ষনের রেওয়াজ আছে। ভারতের জম্মু, উত্তরাখণ্ড, অসমে ঢেঁকি শাক বহু মানুষ পছন্দ করেন। ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার প্রায় সর্বত্র বিভিন্ন নামে ঢেঁকি শাক খাওয়া হয়। জাপানে এর নাম ওয়ারাবি, কোরিয়াতে গোসারি, চীন দেশে জুকাই। চীন, কোরিয়া, জাপান, ইন্দিনেসিয়া, নেপাল, ভুটান সব জায়গাতেই মানুষ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রান্ন ক’রে এই শাক খায়।
ঢেঁকি শাকের কি আদৌ শাক? শাক বলতে বোঝায় পাতা সমৃদ্ধ ছোট গাছ। ঢেঁকি শাক কিন্তু পাতা সমৃদ্ধ গাছ নয়। এক ধরনের ফার্ন। উদ্ভিদ কুলের প্রাচীনতম সদস্য।
রকমারি ফার্ন আছে পৃথিবীতে। দশ হাজারেরও বেশী। এরা টেরিডোফাইট (Pteridophyte) বিভাগের (Division) অন্তর্গত। অনেক ধরনের ফার্ন আবার বিষাক্ত। যেমন ব্র্যাকেন (Bracken)। পৃথিবীর সর্বত্র ব্র্যাকেন জন্মায়, ব্যতিক্রম আন্টারটিকা মহাদেশ। ব্র্যাকেন সুস্বাদু কিন্তু ক্যানসার রোগ সৃষ্টি করে (Carcinogenic)। প্যালিকুইলোসাইড (Ptaliquiloside) নামের ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে ব্র্যাকেনে।
প্যালিকুইলোসাইড-এর উপস্থিতি আবিষ্কার হয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্যনালী এবং পাকস্থলীতে এমনকি রক্তেও ক্যানসার সৃষ্টি করে ব্র্যাকেন। এ তথ্য মেনে নিয়েও ব্র্যাকেন ভক্ষণের পক্ষে যুক্তি আছে অনেক। ব্র্যাকেন পাতায় উপস্থিত প্যালিকুইলোসাইড যৌগটি জলে দ্রবনীয়। তাই ব্র্যাকেনকে বহুক্ষন জলে ভিজিয়ে রেখে সিদ্ধ করে অনেক দেশে খাওয়া হয়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ব্র্যাকেন প্রচুর জন্মায় এবং একটি জনপ্রিয় খাবার।
যে কয়েক ধরনের ফার্ন আমরা খাই তার মাথা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত বাঁকা, ইংরাজিতে বলে ফিড্ডল হেড ফার্ন (Fiddle head fern)। বেহালা জাতীয় তারের বাদ্য যন্ত্র ফিড্ডল নামে পরিচিত। সেই কারণেই বাঁকানো মাথার এই শাকের ইংরাজি নাম ফিডল হেড ফার্ন (Fiddle head fern)। বাঁকান মাথার এই ফার্নেরও রকমফের আছে। যেমন অস্ট্রিচ ফার্ন, লেডি ফার্ন, সিনামন ফার্ন, ভেজিটেবল ফার্ন। এর অনেক গুলোই আমাদের দেশে পাওয়া যায়। অস্ট্রিচ ফার্ন স্বাদে অতি উত্তম। বহু দেশে পাওয়া যায় আর মানুষ খেতেও পছন্দ করেন।
খোলা মাঠে জন্মায় আবার ঘরের মধ্যে ছায়ায় জন্মাতে পারে ঢেঁকি শাক। কিন্তু এই আদিম গাছের তো ফুল ফলে না, ফল ধরে না। তাহলে এদের জন্ম হয় কি ভাবে?
জন্ম হয় ছোট বীজগুটি (Spore) থেকে। গাছের পাতার পেছনে থাকে অসংখ্য ছোট ছোট বীজগুটি বা স্পোর (চিত্র ১)। অপুস্পক শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ (Bryophyta) বীজগুটির সাহাজ্যেই বংশ বিস্তার করে। শ্যাওলাও আদিম গাছ, ফুল-ফল হয় না, আবার শিকড় এবং পাতাও থাকেনা। ফার্নের (Pteridophyte) শিকড় কান্ড ও পাতা থাকে কিন্তু ফুল-ফল হয় না। ফার্ন পাতার পেছনের বীজগুটি মাটিতে ঝরে পড়ে। পর্যাপ্ত জল ও অনুকূল আবহাওয়ায় স্পোর গুলো থেকে ফার্নের জন্ম হয়। বীজগুটি সংগ্রহ করে ফার্ন চাষ করেন অনেক দেশের মানুষ।
ঢেকি শাকের মধ্যে উপকারী কিছু উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। উঁচু মাত্রার লৌহ ঘটিত লবণ, ফাইবার, অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega 3-fatty acid) এবং ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড ফার্নের পাতায় এবং ডাঁটায় মজুত থাকে। প্রসঙ্গক্রমে, মানব শরীর প্রায় সব প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি করে নিতে পারে। পারেনা শুধু লিনোলেইক অ্যাসিড (বা ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড), আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড) তৈরি। এ দুটি বাইরের খাদ্য থেকে (পাম তেল, রেপসিড তেল, বাদাম, অ্যামন্ড, মাছের তেল) সংগ্রহ করতে হয়।
ওমেগা থ্রি এবং অমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃৎপিণ্ড-ক্রিয়া ভালো রাখে। এই সব কারনেই অনেক দেশে ঢেঁকি শাকের খুব কদর। কদর এবং উপকারিতা থাকলেও খুব ভালো করে একে ধুয়ে রান্না করে খাওয়া উচিত। কারণ পাতা ও ডাঁটার গায়ে বহু জীবাণু (Microbes) লেগে থাকে। ঢেঁকি শাক ধোবার পর শাকের গা থেকে রোঁয়া (Hair) সরিয়ে ফেলতে হয়। এরপর ঢেঁকি শাক ফুটন্ত জলে অন্তত দশ মিনিট সেদ্দ করা দড়কার। সেদ্দ করা শাক নিয়ে রান্না শুরু হয়। উপযুক্ত ভাবে রান্ন না হলে (Uncooked) অর্থাৎ তাপ না পেলে শাকের কোঁচকানো অংশে থায়ামিনেস উৎসেচক (Thiaminase Enzyme) থেকে যাবার সম্ভাবনা। আধ সেদ্ধ পাতার থায়ামিনেস ভিটামিন বি-এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিয়ে শরীরকে বিপাকে ফেলতে পারে।
ঢেঁকি শাকের রন্ধন প্রণালী বড় বিচিত্র। দেশে দেশে বহু উপাচারে মানুষ এই শাক রান্না করে। ঢেঁকি শাকের পাতার বাঁকানো (চিত্র ২) অংশ সেদ্ধ ক’রে, তেল বা মাখনে ভেজে, মসলা সহযোগে বা বিনা মসলায় খাওয়া যায়। লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে যে, কাঁচা লঙ্কা ও কাসুন্দি দিয়ে মেখে এই শাক খেতে ভালোবাসেন বাঙলার অনেক মানুষ। বাঙালি রসনার উপযোগী নিত্য নোতুন রান্নার উদ্ভাবন হয়েই চলেছে। কলকাতায় এই শাকের সাথে ডিম মিশিয়েও খাওয়া হয়। বাঙলার বাইরে, হিমাচল প্রদেশে ঢেকি শাকের আচার খুব বিক্রি হয়। নেপাল, সিকিম এবং দার্জিলিঙে ঘরে তৈরি মাখন বা চিস দিয়েও ঢেঁকি শাক খাওয়া হয়।
অল্প চেষ্টায় এই শাক ফলানো সম্ভব। অনেক দেশে অর্থকরি ফসল হিসাবে ঢেকি শাকের চাষ হয়। ঘরের শোভা বৃদ্ধিতেও (Indoor plant) এর ব্যবহার প্রচলিত। শাকটি আবার ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ। সঠিক উপায়ে চাষ ও সব্জি হিসাবে গুরুত্ব পেলে ঢেঁকি শাক বঙ্গ প্রদেশেও একটি অর্থকরী ফসল হয়ে উঠতে পারে।