পর্ব – পনেরো: মলিন মর্মে পুণ্যকিরণ
রুমমেট ফেরেনি। বিষয়টি জানানো উচিত ওর বাসায়। যদিও পিঁপড়ার সারির মতো মানুষ চলছে সর্বত্র। সেই দল থেকে কে কখন হারিয়ে যাচ্ছে- খোঁজ পাওয়া যায় না, কেউ জানানও দেয় না। হলুদ ঝরা পাতার মতোই সবাই ঝরে তা নয়, কখনও সবুজ পাতারাও ঝরে যায়। তুচ্ছ জীবনের এমন যাত্রায় কাছের মানুষই তো খোঁজ-খবর রাখবে নিকটজনের। তবে উৎকণ্ঠা থাকলেও টানেলভিশন অবমুক্ত হওয়ার কারণে উর্বশী খোলা চোখে দেখার সুযোগ পাচ্ছে সব। আরও কিছুক্ষণ দেখবে, নাকি ওর পরিবারকে জানাবে, জানালে কী পরিণতি হবে, তারা সেটা কীভাবে মোকাবিলা করবেন, ভেবে নিয়ে কল করল চন্দনার মায়ের ফোনে। ফোন এনগেজড, নাকি বন্ধ, নাকি ব্যবহারই করেন না এ নম্বরটি- বুঝতে পারল না উর্বশী।
মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে। থানায় জানানো দরকার। কেলেঙ্কারি তো ফলাও করে প্রকাশ পেয়ে যাবে, প্রকাশিত হয়ে পড়বে প্রিন্টিং অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্স মিডিয়াতে। যদি অক্ষত থাকে, নিরাপদে সময় পার করতে থাকে চন্দনা তখন তো এই খবর থানা-পুলিশ করার জন্য নিজেও অভিযুক্ত হয়ে যাবে! দুটো পথের কোন পথে এগোবে, ভেবে না পেয়ে নিজেকেই উর্বশী প্রশ্ন করল, ‘হোয়াট ডু আই ওয়ান্ট?’
প্রশ্নের আলো গ্রহণ করে জ্বলে উঠল প্রতিপ্রভা কোরালের মতো প্রতিসরিত বিভা- সেই বিভায় আলোকিত হয়ে উঠল উর্বশীর মস্তিষ্কের সার্কিট, ‘চন্দনার ভালো চাই। এর বেশি চাওয়া নেই।’ এমন ভাবনার কেন্দ্রে ঘূর্ণাবর্ত হলো নতুন কর্মোদ্দীপনা। থানার দিকেই যেতে হবে ওকে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করছে দুটি কথা- বিপদে না পড়লে আসতে না পারার কারণ জানিয়ে কল করত চন্দনা। কলও করছে না, আসছেও না, আবার মোবাইল ডিসকানেকটেড। ঘোরতর কোনো বিপদের আঁচই করছে উর্বশী।
ঘর থেকে বের হবে, এমন সময় তার পায়ের ক্ষতস্থান থেকে বেরুতে লাগল আতশবাজির আলো। এ আলোর মধ্যে মিশে আছে মেঘের মতো ঘনীভূত কালো ছায়া। অর্ণবের ভাবনাতরঙ্গই কি ফুটে উঠতে লাগল ভাবনার আতশকাচে।
থমকে গেল উর্বশী। বেরুতে গিয়েও পা বাড়াল না বাইরে। এত রাতে একা বেরুনো ঠিক হবে না। সকালেই যাবে থানায়। সিদ্ধান্তটা পাল্টে গেল সময়ের দাবির চাপ খেয়ে। ঘরে ফিরে আসার পরই বেজে উঠল নিজের সেল নম্বর। কল রিং শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কেঁপে উঠল বুক! চন্দনা! চন্দনার কল! এমনি টেলিপ্যাথিক প্রশ্নের মোড়ক খুলে ও তাকাল সেটের দিকে।
হতাশ হলো। না। চন্দনার কল নয়।
কল বেজে থেমে গেছে। এত রাতে কে কল করবে? ভিন্ন নম্বর থেকে চন্দনার কলও তো হতে পারে।
আবার বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই কল অ্যাটেন্ড করার পর শুনল, ‘আপনি কি উর্বশী?’
‘হ্যাঁ। উর্বশী বলছি।’
‘দেখুন, গাজীপুরের গভীর খাদের কাছে পড়েছিল এক তরুণী, নিজের নাম বলছেন না, কেবল আপনার নম্বরটি আর নাম উচ্চারণ করেছেন, তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছেন তিনি।’
‘কে? আপনি কে বলছেন?’
‘আমি টহলপুলিশের এক সদস্য বলছি।’
‘জি। আমার এক বোন গাজীপুরে বেড়াতে গিয়েছিল অফিস-টিমের সঙ্গে। সে ছাড়া আর কারও আমার নম্বর মুখস্থ থাকার কথা নয়। সম্ভবত সেই-ই হবে।’
‘তার অফিসের নাম, বসের নাম জানেন? কোন রিসোর্টে উঠেছিলেন, জানেন?’
‘না। জানি না। তবে তার অফিস প্রধানের নাম জানি, হিকমত আবসারি। ওর ফোন সেট ঘেঁটে দেখুন। এ নামে অনেক কল থাকতে পারে…’
‘স্যরি। উনার কাছে সেট নেই। সম্ভবত উনার ওপর অত্যাচার হয়েছে। আমরা উনাকে গাজীপুর হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছি। হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
এমন খবরে প্রিয়জনরা সাধারণত চিৎকার করেন কিংবা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অথচ উর্বশীর বেলায় ঘটল আশ্চর্য এক প্রতিক্রিয়া। আবেগে কোনো ঢেউ উঠল না, শীতল জলস্রোত বয়ে গেল দেহের ওপর দিয়ে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল না ও। রাগে ফুঁসেও উঠল না, শক্ত পাথরেও পরিণত হলো না, প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলেও উঠল না।
লাইন ডিসকানেক্ট হওয়ার আগে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘প্লিজ, ওর দেখভাল করুন। সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এটা আপনার প্রতি আমার দাবি নয়, অধিকার।’
‘অধিকার’ শব্দটির ভেতর থেকে ছুড়ে দিল ভিন্নমাত্রায় আলোক নির্দেশনা। ‘অ’ ত্ত-ই-কার, ‘ধ’ ‘ক’ ‘র’- প্রতিটি বর্ণই আঘাত করল কর্তব্যরত পুলিশের মস্তিষ্কে।
টহল পুলিশ জবাব দিল, ‘জি ম্যাডাম। আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ করছি আমরা। আগে প্রয়োজন উনার চিকিৎসা। তারপর বাকি পদক্ষেপ নেব।’
লাইন কেটে গেল। মধ্যরাতে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। গাড়িও পাওয়া যাবে না। গাজীপুরে যাওয়ার উপায় নেই। চন্দনার মাকেও ধরতে পারছে না। আর কার হেল্প নেওয়া যায়? ভাবনার জট খুলছে না। উপায় খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা লাগছে। হঠাৎ লাল কাঁকড়ার কামড়স্থল থেকে বিকীর্ণ হতে লাগল আলোর কণা। আর তখনই ‘কী হলে কী করব’ ভেবে রাখা ছকটি ঝরঝর করে ভাসতে লাগল চিন্তনজগতে- ‘বান্ধবীর কোনো ক্ষতি হলে ছাড় দেব না তোমাকে। তোমার সব কুকীর্তির কথা ফাঁস করে দেব। পুলিশে ধরিয়ে দেব।’ হিকমত আবসারির উদ্দেশে ভেবে রাখা কথাগুলো তাজা শব্দবুলেটে পরিণত হলো। শব্দবুলেট হাতে পাওয়ার পরই কল্পচোখে দেখল চন্দনার দুর্দশার চিত্র। ওই বাস্তব কল্পচিত্র মনের মানচিত্র ফুঁড়ে বেরিয়ে মিশে গেল বিকীর্ণ জীবনআলোর মূলগতির সঙ্গে। উর্বশীর অনুমান করা কল্পনাটি সঞ্চারিত হয়ে প্রতিস্থাপিত হলো অর্ণবের আলোকস্তম্ভে। তাই অর্ণব দেখতে পেল উর্বশীকে। সমুদ্রদূষণে ঝাঁকবাঁধা উড়ন্ত মাছের উড়ালগতি হারানোর মতো, মৃত ডলফিন আর বিশাল আকারের তিমির দেহের পতনের মতো নিথর হয়ে পড়ে আছে চন্দনা। শ্বাস নিতে পারছে এখনও। তবে মনে হলো কালো তেলে ঢেকে যাওয়া সামুদ্রিক প্রাণিজ প্রবাল কীটের শ্বাসকষ্টের চেয়েও ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। মানবদূষণের এ ধকল ট্যাংকার ডুবির তেলদূষণের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর যাতনা তৈরি করছে- চন্দনার কষ্ট উর্বশীর অনুভবের মতোই যাতনাময় সুই ফোটাচ্ছে অর্ণবের বোধেও।
নিরুপায় উর্বশীর বোধের ভেতর থেকে জেগে উঠল প্রার্থনা সংগীত :
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে
তব, পুণ্যকিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্ অকূল-গরল-পাথারে!
… আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া, ব’সে আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু, দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।
উর্বশীর অন্তরছেঁড়া রজনীকান্ত সেনের প্রার্থনাধ্বনির শব্দকণা মিশে গেল অর্ণবের আলোকতরঙ্গেও। আর তখনই ঘটল আরেক মানবীয় অনুভবের উদ্ভাস। সেই তরঙ্গকণা ওয়েব পোর্টালে ঢুকে ছড়িয়ে যেতে লাগল বিশ্বলয়ে। কর্তব্যরত পুলিশের মগজের বৈদ্যুতিক তরঙ্গেও মিশিয়ে দিল হৃদয়হরা দায়িত্ববোধ।
উর্বশীর কল্পচোখ এখন ছুটছে পুলিশভ্যানের সঙ্গে। ব্যক্তিগত সংযোগের কারণে কল্পচোখের দৃশ্যচিত্রের একই পট দেখছে অর্ণবও।
পুলিশ অফিসার চন্দনার উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘আপনার বোনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা দূরে আছেন। এখন ভাবতে পারেন আপনিই আমার বোন।’
এ বিপদে এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে। উর্বশী আর অর্ণবের নির্ভরতার উঁচু আসনে উঠে গেলেন টহল পুলিশ। আস্থা আর বিশ্বাসের চন্দনআলো ছড়িয়ে যেতে লাগল। জীবনযন্ত্রণার অশুভ পর্দার আড়ালে ডুবে যাওয়া চন্দনার শরীর ছুঁয়ে বেরুতে লাগল অন্য আলো। উর্বশীর আস্থা আর বিশ্বাসের চন্দনআলো জোছনার মতো আলোর কণা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।
কর্তব্যরত পুলিশ আবারও চন্দনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি জ্ঞান আছে? শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?’
আকাশের ম্রিয়মাণ নক্ষত্ররাজি জ্বলে উঠল আবার দপ করে। সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়ালো চন্দনা। মুখে কথা না বলতে পারলেও জানান দিল জ্ঞান ফিরেছে তার।
চন্দনার জীবনের সাড়া আছে দেখতে পেয়ে ভয় আর আতঙ্কের খোলস মুহূর্তেই ঝরে গেল উর্বশীর দেহ থেকে। খোলসহীন নতুন সত্তায় একত্রে আসন নিল অর্ণবও। চন্দনার ভালো-মন্দের অনুভবের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়ে যায় অর্ণব? কেন দীপ্যমান হয়ে ওঠে ও? প্রশ্নের উত্তর পুরোপুরি জানা না থাকলেও উর্বশী বুঝে গেছে স্বচ্ছতা, সততা আর নৈতিকতার স্খলনে আড়ালে চলে যায় অর্ণব আর ভালো কাজের ফলাফলে তার আলোর বিকিরণ আরও জোরালো হয়। কাঁকড়া উন্মোচিত গ্রাহকযন্ত্রের দুর্বিনীত আলোর টান কি তবে আসে ত্বকবিহীন, ব্যারিকেডহীন কোষ-কেন্দ্রের চুম্বক টান থেকে? উভয়ের মধ্যে মমতার বন্ধন আছে, কোষের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া টানও আছে; থাকতেই পারে? কিন্তু সেই টানের প্রভাবে কীভাবে মানবিক সত্তার অবমুক্তি ঘটল পুলিশের মনে?
যেভাবেই ঘটুক না কেন অসহায় মুহূর্তে অচেনা দূরের মানুষটিকেও মনে হতে লাগল কাছের মানুষ। চারপাশের হাজারো দুঃসংবাদ, জ্বালাও পোড়াও আর পেট্রল বোমার আতঙ্ক, ঘোরতর, ধ্বংসলীলার মধ্যেও ব্রেন জাগিয়ে তুলছে সঠিক কাজের ধারণা, বুঝতে পারল উর্বশী।
চলবে…