নাটোরের সিংড়া উপজেলায় চলনবিল অঞ্চলের আত্রাই এবং বারনই নদী ও নাটোর সদর আর গুরুদাসপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নন্দকুজা নদীর তীরবর্তী এলাকায় নাটোরের ‘সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থা’ ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে ৮ টি নৌকা স্কুল চালু করে।
নৌকা স্কুলের উদ্ভাবন, সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, মোহাম্মদ রেজোয়ান।সংস্থাটি ২০০৫ সালে গেটস ফাউন্ডেশনের ‘অ্যাকসেস টু লার্নিং’ অ্যাওয়ার্ড পায়।পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, পাবনা জেলায় চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলায় বিস্তার ঘটায়।
ভাসমান স্কুলে সংযোজিত হয় প্রযুক্তি, বিনোদন, সাংস্কৃতিক, লাইব্রেরি, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। বন্যাপ্রবণ এই এলাকার জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দানের কর্মযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থা’ বন্যাপ্রবণ এলাকায়, শিশুদের শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ানের নকশা করা আলোচিত ভাসমান স্কুল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য মনোনীত হয়। ‘ডিজাইন উইথ দ্য ৯০%’ নামের ওই প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিলেন কুপার হিউইট, স্মিতসোনিয়ান ডিজাইন মিউজিয়াম এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তরের ডিসকভারি সেন্টারে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯ মে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রদর্শনী হয়। সিয়াটলের ওই প্রদর্শনীতে বিশ্বজুড়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য ও টেকসই আশ্রয়স্থল, খাদ্য, পানীয় জল, স্যানিটেশন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর ২৫টি ডিজাইন ও উদ্ভাবন প্রদর্শিত হয়।
সেই প্রদর্শনীতে সিধুলাই‘এর নৌকা স্কুল, রিমোশন হাঁটু (একটি সাশ্রয়ী মূল্যের কৃত্রিম হাঁটু, যা চলাচলের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে), বাইসাইকেল ফোন চার্জার (পুরনো বাইসাইকেল ও রেডিওর পার্টস থেকে তৈরি মোবাইল ফোন চার্জার), ফ্রিজ প্রিভেন্টিভ ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার (গ্রামাঞ্চলে ভ্যাকসিন পরিবহন করার সময় জমে যাওয়া প্রতিরোধ করে সঠিক তাপমাত্রা নিশ্চিত করে) এবং অন্যান্য মনোনীতদের কাজ তুলে ধরে।
প্রদর্শনীর আয়োজকরা টেকসই বিকল্প প্রযুক্তি ও বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের সম্বন্বয়ে নৌকা স্কুল উদ্ভাবন এবং বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক ডিজাইন আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করতে সিধুলাই‘এর নৌকা স্কুলকে নির্বাচন করেন। ‘ডিজাইন উইথ দ্য ৯০%’ প্রদর্শনীতে এমন ডিজাইন দেখানো হয়, যা বিশ্বের পিছিয়ে পড়া ৯০% জনগোষ্ঠীর জন্য উৎসর্গ করা হয়।
বন্যাপ্রবণ এলাকায় বছরজুড়ে মানসম্মত শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে ভাসমান শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন মোহাম্মদ রেজোয়ান। তিনি ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে ভাসমান স্কুল তৈরি, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তার উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন, গ্রিন এনার্জি ও শিক্ষা বিষয়ে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানিত ফেলো তিনি। মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘শ্রী সত্য সাঁই অ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যান এক্সেলেন্স ২০১৬’ এবং ‘কারি স্টোন ডিজাইন প্রাইজ ২০১৭’ পেয়েছেন।
এ ছাড়াও এসএএম সুইস আর্কিটেকচার মিউজিয়াম ২০১৭-১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাজলে ‘বেঙ্গল স্ট্রিম’ স্থাপত্য প্রদর্শনীতে রেজোয়ানের নৌকা স্কুলের ডিজাইন প্রদর্শন করেন।
এই ট্রাভেলিং স্থাপত্য প্রদর্শনীটি পর্যায়ক্রমে ২০১৮-২০ সালব্যাপী ফ্রান্সের বরদোর আর্কিচেকচার সেন্টার আর্ক-অন-রেভ, ফাঙ্কফুর্টের জার্মান আর্কিটেকচার মিউজিয়াম এবং লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়।
সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থা জাতিসংঘ পরিবেশ পুরষ্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের পরিধি বর্তমানে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।নৌকা স্কুলের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে লাইব্রেরী, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, ইন্টারনেট ও সৌরবিদ্যুত নিয়ে আসে।
সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার কম্পিউটার প্রশিক্ষক মো. আরিফুল ইসলাম সাময়িকীকে জানান, করোনা কালিন সময় ১০ জন করে ৪ টা ল্যাপটপে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সকাল ১০ টা হতে ১২ টা পর্যন্ত পাঠাগারে বই পড়ানো এবং কম্পিউটার ট্রেনিং দেয়া হয়।তিনি ১৩ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
বিলদহর পশ্চিম পাড়ার হুসনেআরা সাময়িকীকে জানান, ‘সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার নৌকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমাদের গ্রামের অনেকেই সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে আয় করছে।আমি এখানে ২ মাস হচ্ছে সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।’
বিলদহর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন সাময়িকীকে জানান, ‘এই ভাসমান স্কুলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।এখানে আসতে আমার খুব ভালোলাগে।আমি কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে চাই।’
সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার প্রোগ্রাম ম্যানেজার মধুসূদন কর্মকার সাময়িকীকে জানান, ‘কিশোর কিশোরীরা সৌরশক্তি সম্পন্ন নৌকা লাইব্রেরীতে আসে, এখানে তারা বই পড়ে, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সংস্থা বন্যাপ্রবন এই এলাকাতে নৌকায় প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নিজ অর্থায়নে পরিচালনা করছে ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে।
প্রতিবছর ১৩,৫০০ জন সুবিধাবঞ্চিত কিশোরী ও নারীরা এই প্রশিক্ষণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও প্রশিক্ষণ নৌকা থেকে নদীর পাড়ে জলবায়ু পরিবর্তনে মানানসই জীবন যাত্রার উপর সান্ধ্যকালীন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।’
সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থার সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সুপ্রকাশ পাল সাময়িকীকে জানান, ‘বর্তমানে ২৬টি স্কুলের নৌকায় প্রতিদিন তিন শিফটে ২,৩৪০ জন ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে। প্রতিটি নৌকায় একবারে ৩০ জন ছাত্রছাত্রী ধারণ করতে পারে। প্রতিদিন সকালে নৌকা স্কুলগুলো বিভিন্ন গ্রামে যায় এবং শিশুদের বাড়ীর সামনে থেকে নৌকায় তুলে নেয়।
তারপর নৌকাটি একটি জায়গায় দাঁড়ায় এবং শিশুদের শিক্ষা প্রদান করে।স্কুলগুলোতে ল্যাপটপ, কয়েক শত বই থাকে এবং সোলার প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের মাধ্যমে নৌকার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলো চালানো হয়। স্কুলে যাওয়া শিশুরা ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী।
শিক্ষামূলক ২০১৭ সালে নৌকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার জন্য খেলা-নৌকা ডিজাইন করা হয়েছিলো।নৌকায় ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা জন্য শিক্ষামূলক খেলার উপকরণ সংযোজন করা হয়। শিশুদের জন্য প্রায় ৫০০ বই আছে। এছাড়া ইণ্টারনেট সংযোগযুক্ত চারটি ল্যাপটপের সাহায্যে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভিডিও শিশুদের দেখানো হয়।’
তরুন স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ান সাময়িকীকে জানান, ২০০২ সালে নিজের অর্থায়নে একটা ডিজাইনকৃত নৌকা তৈরি করতে সক্ষম হই। ভাসমান স্কুল কার্যক্রম চালু করি।২০০৫ সালে একটি অবিশ্বাস্য সুসংবাদ পাই।আমার দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন বড় আকারে সম্প্রসারনের জন্য বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করেন।
গেটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এই ছোট প্রতিষ্ঠানটির কর্মপরিধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন। নৌকা বৃদ্ধি পায়, সমস্ত নৌকায় সৌর বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার আনা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটিতে ৫০,০০০ বই ও ১০০ টিরও বেশি কম্পিউটার আনা হয়।
নৌকা স্কুল ডিজাইনের ১৬ বছর পর দ্বিতীয়বার আমাদের কাজ গেটস ফাউন্ডেশনে আবার প্রদর্শিত হবে। একজন স্থপতি হিসেবে সত্যিই সম্মানিত বোধ করি। আশা করছি, আমরা বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের উন্নয়নে, জীবন বদলে দেওয়া আরও ডিজাইন আনতে পারব।’
চলনবিলের এই মডেল বর্তমানে বিশ্বের আটটি দেশে অনুরূপ ভাসমান স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন লাখো মানুষের জীবনের পরিবর্তন ঘটছে, অপর দিকে বিশ্বের দ্বারে বাংলাদেশের উদ্ভাবন অনুকরণ হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল হচ্ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা।