প্রত্যন্ত সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার কিংবা সিংহদুয়ার নামে খ্যাত ব্রিটিশ আমলের ক্যানিং শহর। বাঙালীর বৃহত্তম দুর্গোৎসবে ব্রিটিশ আমলের সেই ঐতিহ্যবাহী শহরে ফুটে উঠবে আফ্রিকা মহাদেশের জনজাতির জীবন বৈচিত্র্য। সেখানকার একটি পূজা মণ্ডপে দেখা যাবে আফ্রিকার জনজাতির ভাবধারার আদলে তৈরি করা হয়েছ প্রতিমা।
আফ্রিকার জনজাতির আদলে কলাকল্পের মণ্ডপে মা অন্নপূর্ণারুপে অধিষ্ঠিত হতে দেখা যাবে। কলাকল্প ক্লাব এবং গান্ধী কলোনীর গ্রামবাসীরা শরতের কাশ ফুলের ন্যায় মাথা দোলাতে দোলাতে মেতে উঠেছেন শারোৎসবে। এবছর কলাকল্পের ৪৪ তম বর্ষের এই পুজোকে ঘিরে শুধুমাত্র সুন্দরবন নয়, শহরতলি এলাকায়ও ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের জনজাতিদের রূপকে থিম হিসাবে মণ্ডপের প্রতিটি কােণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি থিমের আদলে তৈরী হয়েছে প্রতিমা। মৃন্ময়ী রুপের দেবী দুর্গার লাবণ্যময়ী রুপদান করেছেন প্রতিমা শিল্পী রনিৎ পাল।
দুর্গোৎসবে বাঙালীর বৃহত্তম উৎসব। যা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপামর বাঙালীর হৃদয়ের নাড়া দেয় শরতের কাশফুল আর শিউলির সুগন্ধী। তুলির টানে আফ্রিকার মানবজাতির উৎসব কলাকল্পের মণ্ডপে বাস্তবে তুলে ধরেছেন শিল্পী মানস সাহা। পুজো কমিটির সম্পাদক বিশ্বনাথ সাহা জানিয়েছেন ’শাস্ত্রীয় মতে আমাদের পূজোকে সার্থক করে তুলতে গ্রামের মহিলারাই এগিয়ে এসেছেন। এছাড়াও সরকারী বিধি নিষেধ মেনেই আমরা উৎসবে সামিল হয়ে আনন্দ উপভোগ করবো।’
পূজো কমিটির সভাপতি শম্ভু সাহা জানিয়েছেন, ‘উৎসব মূখর দিনগুলিতে আমরা অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পুজো উপহার স্বরূপ নতুন বস্ত্র তুলে দেবো কয়েক হাজার মানুষকে। পাশাপাশি পুজোর দিনগুলিতে নরনারাণ সেবা থাকবে প্রতিদিন।’
করোনাকে গ্রাস করবে ময়ূর– এই থিম নিয়েই ক্যানিং থানার অন্তর্গত অশ্বথতলা পোড়ামূড়া গ্রাম। এই গ্রামেরই গ্রামবাসীরা মিলিত ভাবেই দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন প্রতিবছর। এবছর ষষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করলো প্রত্যন্ত গ্রামবাসীদের এই দুর্গোৎসব। বর্তমানে করোনার তান্ডব চলছে। আগামী দিনে আসতে চলছে করোনা মহামারীর তৃতীয় ঢেউ। সেই করোনাকে প্রতিহত করে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর পোড়ামূড়া গ্রামবাসীরা। সরকারী বিধিনিষেধ মেনে গ্রামের অশ্বথ্থ গাছের তলায় আয়োজন হয়েছে ষষ্ঠ বর্ষের দুর্গোৎসব। মা দুর্গাকে আহ্বান জানিয়ে করোনামুক্ত করার ডাক দিয়েছেন মিলিত গ্রামবাসীরা। তাদের এবছের থিম করোনা বিনাশ যজ্ঞ- আর সেকারণেই সহস্র লোচন যুক্ত ময়ূরের আদলে তৈরী হয়েছে মন্ডপ।
পুজো কমিটির সম্পাদক বুদ্ধিশ্বর সরদার জানিয়েছেন ‘আমাদের জাতীয় পাখি ময়ূর।ময়ূর সমস্ত ধরনের সাপ,কীট,পতঙ্গ খেয়ে সমাজকে মুক্ত করে তোলে। দেবী জগৎজননী কার্ত্যায়ণী মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা, কার্তিকের বাহন সেই ময়ূর যাতে করে করোনাকে গ্রাস করে বিনাশ করে এবং সুস্থ সাবলীল সচেতন সমাজ গড়ে তোলেন সেই ভাবনা কে তুলে ধরার জন্য আমাদের মন্ডপ তৈরী হয়েছে।’
অশ্বথতলা ও পোড়ামূড়া দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি প্রদীপ নস্কর জানিয়েছেন ‘করোনা কে প্রতিহত করতে আমাদের পূজো মন্ডপে প্রতিমা দর্শনের জন্য বাধ্যতামূলক ভাবেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে দর্শনার্থীদের। এছাড়াও আমাদের মন্ডপে সামাজিক দুরত্ববিধি মেনেই প্রতিমা দর্শনের সুযোগ করে দেওয়া হবে দর্শনার্থীদের,পাশাপাশি আমাদের মন্ডপে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক,ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।“
কমিটির অন্যান্য সদস্য নবকুমার নস্কর,শংঙ্কর সরদার,জয়দেব সরদার’র জানিয়েছেন ‘বাঙালীর বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপূজো। করোনাকালে সেই উৎসব যাতে করে বেদনাদায়ক হয়ে না ওঠে সেইদিকে নজর রেখে আমরা গ্রামবাসীরা মায়ের আরাধনায় ব্রতী হয়েছি। পাশাপাশি আন্দের মধ্যে কাটাতে চাই উৎসবের দিনগুলো।
পাতাপুরিতে রাজবেশে দেবী দুর্গা– মাতলা নদীর তীরে অবস্থিত ক্যানিংয়ের রাজারলাট পাড়ার অনুষ্ঠিত হচ্ছে সার্বজনীন দুর্গোৎসব। এ বছর ৩৯ তম বর্ষে পদার্পণ করল। নিউষ্টার ক্লাব এর উদ্যোগে ৩৯ তম বর্ষের দুর্গোৎসবের এবারের থিম হিসাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে পাতালপুরি মহাকাল। শাস্ত্রীয় রীতিনীতি মেনেই নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে এই দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রতিমাও তৈরি হচ্ছে থিমের ওপর।পাতালপুরিমহাকাল আদলে প্রতিমা তৈরি করছে মৃৎশিল্পী গনেশ বায়েন। প্রতিমার উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট লম্বা স্বয়ং মা আন্নপূর্নারুপে দুর্গাকে মন্ডেপে শান্তিরুপিনী দশভুজা হিসাবে দেখা যাবে।সুন্দরবনের রাজারলাট গ্রামে বেশির ভাগ মানুষজন জেলে সম্প্রদায় ভুক্ত।সুন্দরবনের নদী,খালেবিলে মাছ কাঁকড়া ধরে তাদের কোন মতে সংসার চলে।অন্যান্য সাধারণ মানুষের সাথে তারাও পাতালপুরিতে মেতে উঠবেন উৎসবের আনন্দ মূখর দিনগুলিতে।
প্রত্যন্ত সুন্দরবনের মাতলা ও পিয়ালি নদীর তীরবর্তী সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে কুলতলি। এলাকার অধিকাংশ মানুষজন কৃষিজীবির উপর নির্ভরশীল। বিগতদিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষজন। এছাড়াও লকডাউন আর করোনার জোড়া ফলায় বিধ্বস্ত এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা।
ইতিমধ্যে শরতের আকাশে দোদুল্যমান কাশ ফুল আভাস বহন করে এনেছে শারদীয়ার আগমনীর বার্তা। যে এলাকার মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়- তাদের কাছে এমন মহামারী কালে শারোদ উৎসব যেন মলিন। এমন পরিস্থিতিতে দুর্গোৎসব প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। এলাকার মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে এগিয়ে এলেন স্থানীয় বিধায়ক ও গণেশ চন্দ্র মন্ডল ফ্যান ক্লাব ও কুলতলি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। এলাকায় শুরু হয় বাঙালীর বৃহত্তম দুর্গোৎসব। এবছর ষষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করলো সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার এই দুর্গাপুজো।এবছর পুজোর প্রধান আকর্ষণ দেশের ঐতিহ্যবাহী ইসকন মন্দিরের আদলে তৈরী মন্ডপ।সেই মন্ডপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন স্বপরিবার সহ স্বয়ং দেবী দুর্গা। শিল্পীর হাতের যাদুতে মন্ডপের প্রতিটি কোণে ইসকন মন্দিরের রুপ ফুটে উঠেছে। ইতিমধ্যে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের কুলতলি থানার অন্তর্গত জামতলার কুন্দখালি গণেশ চন্দ্র মন্ডল ফ্যান ক্লাব ময়দানে ভীড় জমিয়ে প্রত্যন্ত সুন্দরবন সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের উৎসব মূখর মানুষজন।
পুজো উদ্যোক্তা কমিটির অন্যতম সদস্য তথা কুলতলির বিধায়ক গণেশ চন্দ্র মন্ডল বলেন ‘দেশ তথা বিদেশে ছড়িয়ে ছিটেয়ে থাকা বাঙালী শরতের শারোৎসবে মেতে ওঠেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারী বিধিনিষেধ মেনেই কুলতলি সহ অন্যান্য সাধারণ মানুষজন যাতে শারোৎসবের আনন্দে সামিল হতে পারে সেই জন্যই এমন ইসকন মন্দিরের আদলে মন্ডপে দুর্গা পুজোর আয়োজন।’