পর্ব – চৌদ্দ: টানেলভিশন ও মননের চোখ
নিজের আলোকশরীরের দিকে তাকিয়ে হতবাকই হতে লাগল অর্ণব। ওর দেহকাঠামোর ভেতর থেকে বেরুতে থাকা আলোর বিম আটকে যাচ্ছে ভাসমান কালো তেলের ঘুটঘুটে স্তরের আড়ালে। চাদর ফুঁড়ে এই আলো ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পথ পাবে না। আটকে থাকবে তেলের তলে। দম বন্ধ করা ভাবনাটা আকস্মিক নিম্নমুখী চাপ তৈরি করল। সেই প্রেসারের ঊর্ধ্বমুখী প্লাবনতায় সাঁই সাঁই করে ও উঠে যেতে লাগল উপরে। নিজের দেহকাঠামোর চলমান গতি এর আগে দেখেনি। এখন বুঝল কি বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার অ্যাডাপ্টেশন ক্ষমতা বেড়ে যায় বস্তু ও প্রাণির ছয় মাইল গভীর সাগরতল থেকে উপরের সারফেসে উঠে আসতে কত সময় লাগবে, বুঝতে পারল এ মুহূর্তে।
তল থেকে উপরে ওঠার এক পর্যায়ে ক্ষীণভাবনা হঠাৎ মিলিয়ে গেল অক্সিজেনের বুদবুদ দেখে। সাগরজলের এক মাইল গভীর পর্যন্ত থাকতে পারে অক্সিজেন কণা- এ সাধারণ জ্ঞানটি অচেনা লাপডাপ বাড়িয়ে তুলল বুকের বন্দরে।
আবার বাস্তব জগতের দিকে উঠে যাচ্ছি ও। এক মাইলের মধ্যে অতি স্বল্প আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে- জীবনের নতুন আকাঙ্ক্ষা আলোর কামড় বসিয়ে দিল বুকে। সেই অনুভব লাল কাঁকড়ার ক্ষতবিন্দুতে বসিয়ে দিল জীবনকামড়। বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাসের ঢেউ উঠল দেহ-তরঙ্গমালায়। আর তখনই চোখ খুলে যেতে লাগল; ঊর্ধ্বমুখী ধাবমান পথে দেখতে লাগল জীবন নয়, মরণচিহ্ন। সারি সারি মৃত ডলফিন, রূপচাঁদার মরা ঝাঁক, টুনামাছের মৃত্যুর মিছিল। জীবনকামড়ে এভাবে মরণচিহ্ন ভেসে উঠতে পারে না ভাবলেও তেল দূষণের কারণে দেখতে বাধ্য হচ্ছে হাঙর, সালমন ফিস আর উড়ালমাছের জলজীবনে ভয়াবহ বিপর্যস্ত দৃশ্য।
ঊর্ধ্বগামী যাত্রায় আকস্মিক সমুদ্র উপকূলের কোরাল রিফ, প্রবাল প্রাচীরে ধাক্কা খেল অর্ণবের দেহতরঙ্গ কণা। হুট করে এখানে নিজেকে আবিষ্কার করে জমাট বেঁধে গেল সব ধরনের জিজ্ঞাসা, অনুভব। দেখল প্রবাল কীটগুলো প্রায় মৃত, শ্বাস নিতে পারছে না। কীট থেকে সৃষ্ট স্টোনের মতো শক্ত প্রাচীরের গায়েও বসে গেছে তেলের কালো স্তর। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ সামুদ্রিক প্রাণিজ প্রবাল বাঁচার তাগিদে সাগর উপকূলে ইকোসিস্টেম, বাস্তুসংস্থানের মাধ্যমে টিকে থাকে। বেঁচে থাকার এ প্রাকৃতিক যুদ্ধের সঙ্গেও আকস্মিক যুক্ত হয়ে গেল অর্ণবের নিজের সংযোগ। জীবনের অনুভব ছড়িয়ে গেল আলোর দেহকণায়। সংযোগের কারণে দেখতে পাচ্ছে উর্বশী ছুটে বেড়াচ্ছে চন্দনার সন্ধানে। কী করবে সে? চন্দনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে বললেও ফিরে আসেনি। উভয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উদ্বেগের কালো দূষণে ছেয়ে গেছে তার মনন। সেই দূষণ সমুদ্র দূষণের মতো ভয়াবহ না হলেও হাহাকার ছড়িয়ে দিচ্ছে উর্বশীর আগ্রহে, মননে। প্রবাল প্রাচীরের ক্যালসিয়াম কার্বনেটের জমাট ও শক্ত পাথরে আস্তরণের মতো দুর্ভাবনার কঠিন শিলার আবরণ তৈরি হয়ে যাচ্ছে উর্বশীর মননের কেন্দ্রে। এই অপ্রতিরোধ্য দেয়াল ভেঙে আবার নিশ্চয় বেরুতে পারবে উর্বশী শক্ত মোড়ক ধারণ করে লৌহমানবীতে বদলে যেতে পারে সে। উল্কা উড়ালের মতো ছুটে আসা ভাবনার ধারাল সুই গেঁথে যাচ্ছে আলোর দেহকোষে। বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরার কথা, ঝরছে না। রক্তের মতো টুপটুপ ঝরতে লাগল আলোর কণা। রক্তকণার মতোই লাল সে আলোর ফোঁটা দেখে কিছুটা হতচকিত হলো অর্ণব। ক্ষণকালের জন্য ও হারিয়ে ফেলেছিল উর্বশীর সঙ্গে সংযোগ। আঁধারে ডুবে গিয়ে আবার ভেসে উঠল। আবার স্থাপিত হলো সংযোগ। ফোঁস ফোঁস করছে উর্বশী। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে উষ্ণ বাতাস। চন্দনাকে উদ্ধারের প্রকৃত পরিকল্পনা না করে বেপরোয়া হয়ে এলোমেলো পদক্ষেপের কথা ভাবছে সে- বিষয়টি ধরা খেল অর্ণবের আলোর অ্যান্টেনায়। ভুল থেকে মহাভুলের জালে জড়াতে হয়; এ কথাও এখন উর্বশীর মাথায় নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে এগোতে হবে- বোধ পরিবর্তনের এ তরঙ্গমালা উড়ালউল্কার মতো উড়ে যেতে লাগল আকাশে- ওয়েব পোর্টালের চলমান তরঙ্গ থেকে চিত্রায়িত হতে থাকা টিভি স্ক্রিনের দৃশ্যমান ঘটনাপ্রবাহের মতো নতুন বোধের তরঙ্গ রংধনুর মতো বাঁক খেয়ে আঘাত হানল উর্বশীর ব্রেনওয়েভে।
জাদুর মতো কাজ করল উড়ালবোধের এ সংকেত। আকস্মিক উর্বশীর ব্রেনওয়েভে ঝড় থেমে গেল। বেপরোয়া চিন্তা আর আবেগের ঘূর্ণি স্থিত হয়ে গেল। না-বুঝেশুনে নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরুনোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে চন্দনার জীবনে কী কী ঘটতে পারে কাগজ-কলম নিয়ে লিস্ট তৈরি করতে লাগল। কী হলে কী করবে ছক তৈরি করে প্রস্তুতি নিতে নিতে মনে মনে বলল, ‘তোমাকে ছাড়ব না হিকমত আবসারি। আমার বান্ধবীর কোনো ক্ষতি হলে ছাড় দেব না তোমাকে। তোমার সব কুকীর্তির কথা ফাঁস করে দেব। থানায় দেব তোমাকে। পুলিশে ধরিয়ে দেব।’
হঠাৎ ভাবনায় ঘটল সূক্ষ্ম পরিবর্তন। প্রথমে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন এক কণা আঘাত হানল নিজস্ব ভাবনার চলমান ওয়েব পোর্টালে। তারপর দিগ্ধিদিক ছুটতে থাকা ভাবনাকোষে বুলেটের মতো আঘাত হানতে লাগল কণাঝড়। ‘কুকীর্তি’ শব্দটিও সুইয়ের মতো ঢুকে গেল চক্ষুকোটরে- ‘কুকীর্তির জন্য কি চন্দনাও দায়ী নয়?’ নতুন প্রশ্নটির আক্রমনের ধার নতুন জিজ্ঞাসার দ্বার খুলে দিল। বান্ধবীর দোষ দেখার সুযোগ পেলেও বাস্তবতার কারণে দুষতে পারছে না চন্দনাকে। তবে ভাবনার পরিবর্তন হলো- এত দুঃসাহসী হওয়া উচিত হয়নি চন্দনার। সিংহের গুহায় ঢুকে স্বার্থ উদ্ধার করবে অথচ নিজে অক্ষত থাকবে- তেমনটি আশা করা ঠিক হয়নি। চন্দনার এ ভুলকে ভুল হিসেবে দেখলেও সরু টানেলের মধ্যে ও কেবল দৃঢ়চেতা চন্দনাকে খুঁজছে। টানেলের বাইরে কী ঘটছে, চন্দনার স্বরূপ কী, দেখার সুযোগ পাচ্ছিল না কিংবা স্বজনপ্রীতির কারণে দেখতে চাচ্ছে না- এমনও হতে পারে।
প্রীতির এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে উর্বশীকে। চন্দনার ভুলগুলোও ধরতে হবে। সেই সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্ট ভুল আবিষ্কার করতে হবে। তা না হলে ভুলের সুতোয় প্যাঁচাতে থাকবে জীবন- এমনি অনুভবে ঋদ্ধ হওয়ায় অর্ণবের আলোর রংধনুতেও ঝিলিক দিল নতুন প্রেরণাতরঙ্গ। আর সঙ্গে সঙ্গে ফাটল তৈরি হলো টানেলভিশনের চারপাশে মোড়া শক্ত টানেলের কাঠামোতে। টুকরো টুকরো হয়ে গেল টানেল-প্রাচীর। প্রবাল প্রাচীরের ক্যালসিয়াম কার্বনেটের আস্তরণও ঝলকানো আলোর ঝাপটা খেলো। তেল দূষণের কারণে প্রবাল প্রাচীরের গায়ে লেগে থাকা কালো আবরণটি ধুয়ে যেতে লাগল নতুন ঝলকের প্রভাবে। এত সব বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল অর্ণব। গোলকধাঁধা লাগানো মেজ কোরালের ধাঁধা আর প্রতিপ্রভা কোরালের প্রতিসরিত আলোয় হতচকিত অর্ণবের বিহ্বলতা এখনও কাটছে না। চারপাশে দেখা গেল ঝলমলে অন্য এক প্রবাল জগৎ- মস্তিষ্কের মতো দেখতে ব্রেন কোরাল, দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক মুদ্রার মতো নৃত্যশিল্পীদের পাঁচ আঙুল মেলে ধরার মতো কারুকার্যময় ছড়ানো স্টাগহর্ন কোরাল, মেয়েদের কানে ঝুলতে থাকা দুলের মতো প্যাঁচানো মুক্তোঝলকের মতো স্পাইরাল ওয়ার কোরাল, মাথা উঁচিয়ে ওঠা ক্যাকটাসের ছোট ছোট খাঁজকাটাময় স্তম্ভের মতো দেখতে পিলার কোরাল, ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে মাশরুম কোরাল, জটিল রেখার টানে পাপড়িখোলা ফুলের মতো ফুটে থাকা চোখে গোলকধাঁধা লাগানো মেজ কোরাল, মৌচাকের আদলে গড়া ব্ল্যাক কোরাল, আর বিকিরণ গ্রহণ করে তা আলোরূপে ফিরিয়ে দেয় এমন প্রতিপ্রভা কোরাল। একই সঙ্গে এপারে চলমান জীবনে ঘোরের মধ্যেই উর্বশী দেখল টানেলভিশনের টানেলটি আর নেই। খোলা চোখে এখন দেখছে চারপাশের বিস্তৃত জগৎ, উপলব্ধির জগৎ প্রসারিত হতে হতে আছড়ে পড়েছে সাগরের তলদেশ পর্যন্ত।
উর্বশীর বিস্তৃত দৃষ্টিরেখার সীমানা অনুভব করে অর্ণব ভাবল, সর্বনাশ! এখন তো উর্বশী দেখে ফেলবে নিজেকে। আড়ালের জগতে কি আর তবে লুকিয়ে থাকতে পারবে না ও? নতুন প্রশ্নটির উল্কাকণা ঢুকে গেল অর্ণবের আলোদেহের কোষে। কোষের সংকেতযন্ত্রে পরিবর্তন ঘটে গেল। আর সেই বদলে যাওয়া সংকেতে ভেসে উঠল দেহের চোখ নয়, বোধের চোখে, মননের চোখ দিয়েই উর্বশী দেখতে পাবে সমুদ্রের তলদেশ। তবে মনের চোখে দেখার সীমানা প্রশস্ত হয়ে গেলেও দেহের চোখের সীমানা অতিক্রম করার সাধ্য নেই জীবিত মানবকুলের বা যেকোনো প্রাণির- এ ভাবনায় হালকা হলো মন। যাক, বাঁচা গেল তবে। এবার আকাশে তাকাল অর্ণব। এখন ঝকঝকে রোদ থাকার কথা নয়। এখনও কালো মেঘের চুপচাপ বসে থাকার ঢঙটা আক্রমণের পূর্বে চিতাবাঘের ঘাপটি মেরে থাকার মতোই মনে হতে লাগল। উর্বশীর জীবনের পেছনেও লুকিয়ে আছে এমনি ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ? যে কোনো মুহূর্তেই সুযোগ বুঝে লাফিয়ে পড়তে পারে তার ওপর- এসব ভাবনাও চেপে বসল মগজে।
উৎকণ্ঠা আবার ছেয়ে গেল অর্ণবের দেহকোষ-কলায়। সাগরের তলের দিকে যাত্রা করল ও। ইচ্ছার নাটাইয়ে টান খাওয়া মাত্রই ও নামতে লাগল সাগরের পেলাজিক স্তর পেরিয়ে- ইপিপেলাজিক, মেসোপেলাজিক, বাথিপেলাজিক, অ্যাবিসসোপেলাজিক অতিক্রম করে হাডোপেলাজিক স্তরে এসে বুঝল প্রায় ছয় মাইল দূরবর্তী তলদেশই হচ্ছে এখন ওর নিজের ঠিকানা। ঠিকানায় পৌঁছে আলোর তরঙ্গ প্রেরণ করল উর্বশীকে দেখার আশায়। দেহকোষের আলোকণায় তৈরি হলো নিম্নচাপ। নিম্নচাপ চোখে ধারণ করে ভয় পেল অর্ণব।
চলবে…