সে একটা সময় ছিল৷ যখন কালাপানি পার হলেই জাত যেত৷ সেকালে পুরুষদের বিলেত যাওয়াটা একটা সমস্যা ছিল৷ বাঙালি মেয়েদের কথা তো ভাবাই যেত না৷ তবু সেই অকল্পনীয় ব্যাপারটি ঘটেছিল ১৮৭১ সালে, সে একটা সাড়া জাগানো ঘটনা৷
কুলীন বাঁড়ুজ্জে বাড়ির বউ গেলেন স্বামীর সঙ্গে বিলেত ৷ ব্রাহ্ম শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দুরা ভিন্ন জাতের মানুষ বলে ভাবত৷ ভারত বন্ধু মেরি কার্পেন্টার ভারতে বেড়াতে এসে বরানগরের শ্রমজীবী বন্ধু বিখ্যাত শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সস্ত্রীক ইংল্যান্ডে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন৷ শশী পাঁজা সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন৷ ১৮৭১ সালের ১৯শে এপ্রিল তিনটি শিশুসন্তানকে দেশে রেখে দিয়ে রাজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায় স্বামী শশীপদর সঙ্গে “ওলগা” নামক একটা ছোট জাহাজে চেপে বিলেত রওনা হলেন৷ এক মাসেরও বেশি জাহাজে কাটিয়ে মে মাসের শেষে তারা মেরী কার্পেন্টারের ব্রিস্টলের “রেডলজ হাইস” বাড়িতে গিয়ে উঠলেন৷ প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় মেয়ের পায়ের ধুলো পড়ল লন্ডনের মাটিতে৷ এই ব্রিস্টলেই রাজা রামমোহন রায় সমাহিত হয়েছিলেন ৷
ইংরেজি ভাষা না জানার জন্য রাজকুমারী কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না৷ ইংল্যান্ডের মেয়েদের সঙ্গে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলতেন৷ স্বামীর সঙ্গে সর্বত্র যান৷ প্রায় আট মাস ইংল্যান্ডে বাস করে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেশে ফিরলেন ৷ এ সময়টা একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল সেখানে৷ রেড লজে থাকতেই গর্ভবতী রাজকুমারী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন৷ যিনি পরবর্তীকালে আলবিয়ন রাজকুমারী ব্যানার্জি নামে সুখ্যাত এবং এই পুত্রটি “The first Brahmin Subject of her Majesty born on British ground.”
আস্তে আস্তে মেয়েদের কাছে বিলেতে যাওয়ার দ্বার উন্মোচিত হল৷ এরপর ১৮৭৭ সালের কথা৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী স্বামীকে ছাড়াই বিলেতের পথে রওনা হলেন- সঙ্গে সাহসী সঙ্গীরা বলতে ছয় বছরের ছেলে, চার বছরের মেয়ে এবং ভৃত্য রাম৷ জাহাজঘাটায় জ্ঞানদানন্দিনীকে একা দেখে বিলেতবাসী আত্মীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন বললেন, “সত্যেন্দ্র একি করলেন? নিজে সঙ্গে এলেন না?” শিশু সন্তানদের নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী জ্ঞানেন্দ্রমোহন এর বাড়িতে উঠেছিলেন৷ ব্রাইটলে প্রায়ই মেম সাহেবদের সঙ্গে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতেন বিলেতে প্রথম বরফ পড়া দেখে জ্ঞানদা নন্দিনী মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন৷ পাতলা রেশমি শাড়ি পড়েই ছুটলেন বরফ কুড়োতে৷
বিলেতে প্রায় আড়াই বছর আলাদা আলাদা ভাড়া বাড়িতে থাকলেন৷ একটা সুন্দর বিলিতি কুকুর পুষে ছিলেন৷ ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন৷ খুব ভালো লাগতো তার ফরাসি জাতীয় সংগীত৷ ছেলেরা সমুদ্রের ধারে বালিতে খেলা করত৷ আর তিনি কখনও পাহাড়ে কখনও সমুদ্রে কখনওবা ফুল বিছানো প্রান্তরে আবার কখনও বা পাইন বনের ছায়ায় কবিতা আবৃত্তি করতেন৷ অল্প ইংরেজি জানতেন জ্ঞানদানন্দিনী৷ জ্ঞানেন্দ্রমোহন এর বাড়িতে থাকার সময় জ্ঞানদানন্দিনীর স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দেবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে এলেন৷ কাজ চালানো ইংরেজি দিয়েই জ্ঞানদানন্দিনী বিলেতে কাটিয়ে দিলেন৷
ছয় বছর বিলেত বাসের পর বউবাজারের বিখ্যাত শ্রীনাথ দাস এর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ দাস স্বদেশে ফিরে এলেন৷ সালটা ছিলো ১৮৮২৷ কিন্তু কোনও কারণে পারিবারিক মনোমালিন্য ঘটায় পাঁচ মাস পর স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন৷ আসলে এবার স্বামীকে একা যেতে দিতে চাননি তিনি৷ নিজেই যেতে চেয়েছিলেন স্বামীর সঙ্গে ৷ বয়স তখন আঠোরও পূর্ন হয়নি৷ একটি মাত্র শিশুকন্যা তিলোত্তমা ৷
উনিশ শতকের নারীবাদী লেখিকা এবং সমাজসেবিকা কৃষ্ণভাবিনী দাস। তিনি ১৮৬২ সালে মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর বয়সে দেবেন্দ্র নাথ দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর ১৮৭৬ সালে দেবেন্দ্রনাথ আইসিএস (Indian Civil Service) প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্যে বিলেতে যান। উক্ত পরীক্ষায় তিনি ১৭তম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ওই বছর ১৬জন প্রার্থীকে নিয়োগদানের কারণে তিনি উক্ত চাকরিলাভে বঞ্চিত হন। হতাশ হয়ে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গণিত বিষয়ের ওপর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আরো কয়েক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং বৃটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৮৮২ সালে তিনি দেশে ফিরে ৬ মাস অবস্থান করে কৃষ্ণভাবিনীকে নিয়ে বিলেতে প্রত্যাবর্তন করেন।
বিয়ের পূর্বে কৃষ্ণভাবিনী পিতৃগৃহে সাক্ষরতা অর্জন করেন। পরে তিনি তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বামীর যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য নিজ তাগিদেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেন।
তখনকার নারীরা বিদেশভ্রমণ করলে তা সম্মানজনক মনে করা হতো না। কিন্তু নির্ভীক কৃষ্ণভাবিনী ছিলেন এ মানসিকতা থেকে মুক্ত। তাঁর বিলেত যাওয়ার বাসনা ছিল তীব্র। সেখানকার সমাজ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর প্রবল। তাঁর মধ্যে ছিল সমাজ ও সভ্যতা পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতা। তিনি সেখানকার মানুষ ও সমাজব্যবস্থা বিশেষ করে ইংরেজ নারীদের মুক্ত জীবন দেখে খুবই মুগ্ধ হন। বৃটেনে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখতে আরম্ভ করেন। এর ফলশ্রুতিতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ” ইংল্যান্ডে বঙ্গ-মহিল(১৮৮৫)” শীর্ষক একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি লন্ডনের বিশেষ করে নারী সমাজে বেশ প্রশংসিত হয়। উক্ত গ্রন্থটিতে তিনি ইংরেজ নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তাঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। নারীদের তখন ভোটাধিকার ছিল না। ভোটাধিকার লাভের জন্য নারীদের আন্দোলন, প্রতিবাদ প্রভৃতি তথ্য তিনি তুলে ধরেন। কৃষ্ণভাবিনী তাঁর গ্রন্থে ইংল্যান্ডের সমাজ, সভ্যতা ও শিক্ষার বিশেষ করে সমাজ ও পরিবারের ভেতরে নারীর ভূমিকার কথা। তাঁর গ্রন্থে আরো রয়েছে বঙ্গীয় সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের অশিক্ষিত অসহায় রাখার চিত্র। তাঁর বর্ণনায়, বঙ্গীয় মহিলারা হল গৃহকোণে আটকে থাকা খাঁচার পাখি। তিনি এ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য একজন মহিলা হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন এ গ্লানির ভয়ে তিনি তাঁর গ্রন্থে নিজের নাম উল্লেখ করেননি। কৃষ্ণভাবিনীর বই লেখার উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালি নারীদের মুক্তি বিষয়ে তাদের সচেতন করা। তিনি গ্রন্থটিতে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির সুফলের কথার বিশেষ বর্ণনা দেন।
বিলেত ফেরত স্বামীকে পরিবার ও সমাজ গ্রহণ করতে চায়নি৷ কিন্তু কৃষ্ণভাবিনী কিভাবে স্বামীকে ত্যাগ করবেন ৷ শিশুকন্যা তিলোত্তমাকে রেখে স্বামীর সঙ্গে বিলেতের জাহাজে উঠলেন ৷ বিলেতে থাকাকালীন তিনি খবর পেলেন তাদের অনুপস্থিতিতে কন্যা তিলোত্তমাকে মাত্র নয় বছর বয়সে এক ধনী গৃহে বিয়ে দিয়েছেন তার শ্বশুর প্রতিশোধ নেবার জন্য ৷ এ খবর পাওয়ার পর তিনি ব্যথিত হয়ে উঠলেন ৷ এদিকে বিলেতে অধ্যাপনা করতে করতে কৃষ্ণভাবিনীর স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন ৷ স্বদেশে ফেরার জন্য তখন তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন৷ বিলেত তাকে কোনও ভাবেই আকর্ষিত করতে পারেনি৷ এভাবেই বিলেতের মাটিতে আট বছর কাটিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেশে ফিরলেন কৃষ্ণভাবিনী ৷
১৮৯২ সালে এক প্রবল জেদে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়৷ কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁরা বিএ পাস করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট।
গ্র্যাজুয়েট হবার পর কাদম্বিনী দেবী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি ডাক্তারি পড়বেন। ১৮৮৩ সালে মেডিকেল কলেজে ঢোকার পরেই তিনি তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন। দ্বারকানাথ ছিলেন একজন ৩৯ বছর বয়েসের বিপত্নীক। আর কাদম্বিনীর বয়স তখন ছিল মাত্র একুশ। কাদম্বিনী ফাইনাল পরীক্ষার সমস্ত লিখিত বিষয়ে পাস করলেও প্র্যাকটিক্যালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অকৃতকার্য হন। ১৮৮৬ সালে তাঁকে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসারীতিতে চিকিৎসা করবার অনুমতি পান। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি সরকারের স্কলারশিপ পান যা ছিল মাসে ২০ টাকা ।
তিনি পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করার পর ১৮৯২ সালে বিলেত যান। এক বছর পরে এল আর সি পি (এডিনবরা), এল আর সি এস (গ্লাসগো) এবং ডি এফ পি এস (ডাবলিন) উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন। বিলেত যাবার আগে ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন৷ তিনটি শিশু সন্তানের জননী স্বামী দ্বারকানাথের কাছে শিশু সন্তানদের রেখে এডিনবরা ও গ্লাসগো থেকে নিয়ে এলেন সম্মানিত উপাধিগুলো আর নিয়ে এসেছিলেন সবার জন্য ছোট বড় উপহার সামগ্রী৷
নিজে বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানী স্বামীর সঙ্গে ১৯০০ সালে লন্ডন ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করে এলেন অবলা বসু৷ ১৯০০ সালে আচার্য জগদীশচন্দ্র বিদেশে গেলে অবলাও তার সঙ্গে যান৷ স্বামীর সঙ্গে গিয়ে বসেছেন বিজ্ঞান সভায় উপরের গ্যালারিতে সবার অলক্ষ্যে৷ বৈজ্ঞানিকদের জন্য আহুত সান্ধ্য ভোজে বঙ্গ নারীর প্রথম বৈজ্ঞানিকদের জগতে প্রবেশ ঘটল দুরু দুরু বক্ষে৷ অন্য এক পৃথিবীতে তারা এসেছেন ৷ সেখানকার শৃঙ্খলা এমনকি ট্রাফিক পুলিশের যান নিয়ন্ত্রণ দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন৷ বিস্মিত হয়েছিলেন ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে দেখেও৷ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে তিনিই সম্ভবত প্রথম বাঙালী মহিলা লিফটে ওঠেন৷ সেখানে মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট আসন দেখে অবলার মনে পড়ে, “লক্ষ্ণৌ নবাবদের প্রাসাদের অন্তঃপুরের কথা।”
ঘুরে ঘুরে দেখেন লবি, ভোট দেবার ঘর, ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচার স্থান —
“পার্লামেন্ট দেখিবার ইচ্ছা অনেকদিন হইতেছিল, তাহা পূর্ণ করিয়া গৃহে ফিরলাম৷”
রাজকুমারী, জ্ঞানদা, অবলা এমনকি কৃষ্ণভাবিনীও নানাভাবে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ শুনেছি সুনীতি দেবী ছিলেন কুচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এর স্ত্রী এবং অন্যদিকে প্রখ্যাত ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা৷ সুনীতি দেবী তাঁর স্বামীর সঙ্গে প্রায় তিন বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন সম্ভ্রান্ত অভিজাত মহলে ৷ সুনীতির পুত্রের ধর্ম মাতা হয়েছিলেন ইংল্যান্ডেশ্বরী৷ মহারানীর সিংহাসন আরোহণের হীরক জয়ন্তী উৎসবে যোগদানের জন্য সুনীতি দেবী ১৮৯৭ সালে বিলেতে যান৷ সেখানে তিনি প্রথম মহিলা সি আই ই উপাধি পান৷ এরা সকলেই জাহাজে চেপে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন ৷
কিন্তু প্রথম প্লেনে চড়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হন একদা রানি মৃণালিনী সেন৷ কবি এবং চিন্তাশীল এই বিদূষী নারী এককালে ছিলেন কুসংস্কারময় এবং পর্দানশীন ৷ মৃণালিনীর দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় কেশবচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র নির্মল চন্দ্র সেনের সঙ্গে ৷ দ্বিতীয় স্বামীর সান্নিধ্যেই তার প্রতিভার উন্মেষ ঘটে৷ তিনি তার স্বামীর কর্মস্থল লন্ডনে প্রথমবার যান ১৯০৯ সালে৷ পরে ১৯১৩ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি ওখানে বাস করেন৷ তার স্বামী ওখানে ইন্ডিয়া অফিসে ভারতীয় ছাত্রদের শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন৷ বিদেশে তিনি অভিজাত জীবনই যাপন করতেন৷ মহাত্মা গান্ধী তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে লন্ডনে এসে প্রথম মহাযুদ্ধে আহত সৈনিকদের জন্য যে “এম্বুলেন্স কোর” গঠন করেন মৃণালিনী সেই ত্রাণকার্যে নিজেকে যুক্ত করলেন৷ এ সময় গান্ধীজি মৃণালিনীর কাছে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং তাকে শিক্ষয়িত্রী বলে সম্বোধন করতেন৷
মিস মেয়োর কুৎসাপূর্ণ গ্রন্থ ‘মাদার ইন্ডিয়া’র তীব্র প্রতিবাদ করে মৃণালিনী প্রবন্ধ রচনা করেন, হিন্দু দর্শন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি উপর প্রদত্ত তার বক্তৃতাবলী লন্ডনের নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে৷
রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পান “দি পোয়েট রবীন্দ্র নাথ টেগোর” প্রবন্ধ রচনা করে বিদেশিদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে আরও উন্নত করেন ৷ তার দীর্ঘ লন্ডন বাসকালে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সমাজ প্রগতির কথা জনসভায় উত্থাপন করে ভারতকে জগত সম্মুখে শ্রেষ্ঠ আসনের মর্যাদায় উন্নীত করেন৷ এই মৃণালিনীই আবার প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি যুদ্ধে নিহত ভারতীয় এবং ফরাসি সৈন্যদের আত্মদানকে সম্মান জানানোর জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সভার আয়োজন করেন ৷
এরপর অনেক বঙ্গ ললনারাই বিলেত ভ্রমণ করেছেন৷ কিন্তু সবকিছু শেষে তাদের ভারতবর্ষের জন্য মন কেমন করে উঠেছে ৷ সুদূর প্রবাসে থেকেও বাংলার জন্য প্রাণের টানে বাঙালি নারীরা আজও উন্মুখ হয়ে থাকে ঘরে ফেরার জন্য ৷