পর্ব – তেরো: চোরাস্রোতে কি ভেসে গেছে সে?
অর্ণব কেবল অবাকই হচ্ছে না, বিমূঢ়তার আড়ালেও দেখছে নিজেকে; আনন্দঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে ওর দেহকাঠামোতে। ভালো করে খেয়াল করে দেখতে লাগল দেহের মাংসপেশির সুগঠিত বহিরাবরণটি আসল মাংসপেশি নয়; এটি পুরোপুরি আলোর গড়া দেহ। এ দেহরাজ্যে খেলা করছে আলোর তরঙ্গ, আলোর ঢেউ। ভোরে শান্ত পুকুরে শুয়ে থাকা আলো যেমন চিকচিক করে, আবার জলস্থিত পুকুরে ঢিল পড়লে যখন ঢেউ ওঠে- কেবল জল নয়; আলোর ঢেউও যেমন নান্দনিক শিল্পের ছন্দ ছড়িয়ে দেয়, তেমনি চিকচিক তরঙ্গ-আলো নেচে ধেয়ে বেড়াচ্ছে দেহকাঠামোর মধ্যে।
তাহলে কি আসল নয়, পরিবর্তিত নকল মানুষে পরিণত হয়ে গেছে নিজে?
প্রশ্নটি ঢিলের মতো আঘাত হানল অর্ণবের মস্তিষ্কের পুকুরে আর তখনই আলোর দেহের তরঙ্গদ্যুতির মধ্য থেকে আকস্মিক উলকাপতনের মতো একখণ্ড আলোর টুকরার উলকা-উড়াল ঘটল। টুকরাটি আলোর বিমে পরিণত হয়ে উড়ে যেতে লাগল আকাশে; হঠাৎ ধনুকের মতো বেঁকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ধারণ করে মুহূর্তের মধ্যে আলোক বিমটি কানেক্ট করে ফেলল উর্বশীকে। নিজ দেহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের আলোকশক্তির বিপুল ক্ষমতার সন্ধান পেয়ে প্রথমে ভড়কে গেলেও আবার সহজ হয়ে গেল অর্ণব। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আবিষ্কার করতে লাগল নিজের নতুনতর অস্তিত্বের উপস্থিতি। ধরে নিল ও বেঁচে নেই, বুঝল পৃথিবীর আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবন নেই তার। খিদা নেই, কাম নেই তবে আবেগ আছে। উর্বশীর জন্য অনুভব মিশে আছে নতুনতর সত্তার প্রতিটি অণুকণায়, কণাস্রোতে। সেখান থেকে বেরোয় নূরানি রোশনি, মমতার লাবণ্যপ্রভা, চন্দনজ্যোতি। তাহলে কি আত্মা বেঁচে আছে? মরে গেলেও মানুষের আত্মা মরে না!
গ্যালাক্সি কিংবা সাগরতলেও অবস্থান নিতে পারে আত্মা ধারণ করা আলো-দেহ?
মরার পর অমর আত্মার উপস্থিতির কথা বলা হলেও দেহ বিলীন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাহলে কি দেহও আলোর কণায় রূপান্তরিত হয়ে আত্মাটিকে নতুন মোড়ক পরিয়ে রাখে? সেই মোড়ক থেকেই কি শেষ বিচারের দিনে আবার পূর্ণাঙ্গ মানব অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটবে?
প্রশ্নগুলো স্রোতের মতো ভাসতে লাগল, উজ্জ্বল আলোকবাতির মতো ঝিকমিক বুদবুদ তুলতে লাগল সাগরতলে। বুদবুদের উৎস খুঁজতে গিয়ে তাকাল নিজের পায়ের দিকে।
আশ্চর্য! যেখানে লাল কাঁকড়া কামড়ে ধরেছিল সেখান থেকেই বেরুচ্ছে আলোর বিম, রংধনু। আর চারপাশ থেকে বুরবুর করে বেরুচ্ছে প্রশ্নমালার বুদবুদ; কেবল বুদবুদ বললে ভুল হবে- এ প্রশ্নবুদের উত্থানের মধ্যে ও দেখতে পাচ্ছে অনন্তজীবনের সীমাহীন নতুন গ্যালাক্সি; মহাশূন্যের চেয়েও বিরাট, রহস্যময় আর ঐশ্বর্যময় সেই সৌরজগৎই যেন সৃষ্টির আদিজগৎ- পেছনে টানতে থাকলে সে-জগৎ মিশে যাবে একবিন্দুতে। সেই একক সত্তা কি সমগ্র সৃষ্টিকুলের একক অধিকর্তা? সৃষ্টিকর্তা? তাঁর নূরের একক বিন্দুই কি সব শক্তির উৎস?
দুম করে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। আলোর বিস্ফোরণে টুকরো হয়ে উড়ে যেতে লাগল প্রশ্নকণার ঢেউ। এসব উত্তর জানার শক্তি নেই তার- বুঝে আবার তাকাল পায়ের দিকে। ওয়েব পোর্টালে ভেসে বেড়ানো লক্ষ কোটি ইকেট্রোনিক ইমেজ আর তার গতিপ্রকৃতির ভেতর থেকে আলাদা ঢঙে বেরিয়ে এলো উর্বশীর ইমেজ। অর্ণব এখন পুরোপুরি দেখছে উর্বশীকে- উর্বশীর চারপাশে উন্মাতাল ঢেউ তুলছে আলোর তরঙ্গ। চারপাশের কালো জগৎ আলোকিত হয়ে উঠছে, উর্বশীর দিকে ছুটে আসা কুচকুচে কালো রাহুর সর্বগ্রাসী আগ্রাসন সেই উল্লসিত ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে সরে যাচ্ছে। ঝকমকে রোদের আলো-আকৃতির একটা ক্যাপসুল ঘিরে রেখেছে উর্বশীকে। সেই ক্যাপসুলের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে; রাহুগ্রাসী কালো জগৎও সরে যাচ্ছে দূরে… ক্রমশ বিস্তৃত রোদের পরিধির সীমানা ঘেঁষে অর্ণব দেখল উর্বশীর বান্ধবী চন্দনাকেও, জীবনপ্রকৃতির কালো রশ্মিপাতের চার দেয়ালের ভেতর একফোঁটা আলোর মতো এখনও জ্বলছে সে- অগ্নিপ্রভার উদ্গীরণ ঘটছে তার আত্মবিশ্বাসের কেন্দ্র থেকে। সেই বিশ্বাসের তেজষ্ক্রিয়তায় ছড়িয়ে যাচ্ছে রঞ্জনরশ্মি। অর্ণব স্পষ্টই রঞ্জনরশ্মির ক্ষুরধার ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে কৃষ্ণ আলো ভেদ করে দেখে নিচ্ছে চারপাশের জড়ো হওয়া হায়েনার দল। আঁধারে চকচক করতে থাকা হায়েনার সারবাঁধা চোখের মতো লোভী চোখের মিছিল দেখে উদ্বিগ্ন হলো অর্ণব। এভাবে ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হয়নি, ভুল করেছে চন্দনা, ভুলের পেছনে আছে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়! কিন্তু যা-ই থাকুক, ভুলের মাশুল না দিয়ে কীভাবে সে রক্ষা পাবে! এই চিন্তার রেখা থেকে আকস্মিক ধনুক বিমের পাশ থেকে ছলকে বেরিয়ে গেল অতিবেগুনি রশ্মি; আলট্রা-ভায়োলেট রে। এই-রে মুহূর্তে মিশে গেল চন্দনার আত্মবিশ্বাসী অগ্নিপ্রভার বিকীরণের সঙ্গে। আর তখনই চন্দনাকে ঘিরে থাকা হায়েনার চকচকে চোখগুলোতে প্রতিসরিত হয়ে ঢুকে যেতে লাগল পরাবর্তক রিফ্লেক্টর, তেজস্ক্রিয় রেডিও অ্যাকটিভ আতশকাচ।
মিরাকল!
হায়েনাদলের চকচকে চোখের বিকিরণ জমে সূর্যগ্রহণের মতো ঘুটঘুটে কালো হয়ে গেল।
ওরা পালিয়েছে। বা আত্মগোপন করে আছে। অথবা নতুন কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে? আঁধারে লুকিয়ে যাওয়া হায়েনার পরিকল্পিত ছক উন্মোচিত হয়ে গেল অর্ণবের রেইনবোর বিকীর্ণ পরিধি থেকে। ওদের দেখতে পাচ্ছে না আর। তখনই শুনল চন্দনার উদ্দেশে মোবাইল ফোনে বলা উর্বশীর মানবীয় চিৎকার, ‘চন্দনা, নিজ পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সব বিকিয়ে দেব না আমরা। প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়ে সব বিলিয়ে দিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার চেয়ে, প্রতারণার ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টাই করতে হবে, নজর দিতে হবে বিপর্যয়ের আগে সৎ জীবনযাপনের দিকে। লুণ্ঠনের পর প্রতিবাদী হয়ে বাহবা কুড়োনোর চেয়ে লুণ্ঠিত না হওয়ার উদ্ভাবনী পথেই চলতে হবে। ফিরে আয়। সম্মতি যেন ওরা না নিতে পারে তোর। আত্মবিশ্বাস হারাবি না, খবরদার!’
উর্বশীর উচ্চারিত টুকরো টুকরো শব্দতরঙ্গ অর্থপূর্ণ বাক্যে সুশোভিত হয়ে আঘাত হানল অর্ণবের আবেগপ্রভায়। উর্বশীর চিৎকারের অর্থ অনুভব করে বুঝল চন্দনার চোরাগলিতে ঢুকে পড়ার উদ্দেশ্য। অন্যায় আর প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রশংসাসূচক শব্দমালার পেছনেও ওত পেতে আছে মুখ বুজে না-থেকে প্রতিবাদী হওয়ার শিক্ষা। এই শেখার বিষয়টাকে অস্বীকার করা যায় না। তবে পচা গর্তে পা দেওয়ার আগেই শেখার বিষয়টা কাজে লাগানো উচিত ছিল চন্দনার- এমনি ভাবনার আলো-জোয়ার ঢুকতে লাগল অর্ণবের রশ্মি-দেহের অনুকণায়। আর তখনই দেখল কেবল মানবকুলে নয় সাগরতলেও শুরু হওয়া বিশৃঙ্খলা, তেলের ট্যাংকার ডুবির বিপর্যয় চলছেই। জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস আর দিশেহারা অবস্থার পরিণতি হচ্ছে ৩৭ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বিনাশ, খাদ্যের অভাবে ডলফিন ও জলজ প্রাণিদের এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি। বিকট আকারের তেলস্রোত ধাওয়া করছে ডলফিন দলসহ সাগরগর্ভের মৎসপ্রজাতিদের। নদীদূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে সাগরেও। এত গভীর জলে বেঁঁচে আছে কীভাবে ডলফিন আর হাঙরের দল! এখানে তো অক্সিজেন নেই, সূর্যের আলোও ঢুকতে পারে না এ স্তরে। তাহলে তার মতোই দেহ ত্যাগ করেছে ওরা? আলোর দেহ হয়ে ডুবে যাচ্ছে সাগরতলে? ওদের তো আক্রমণাত্মক মনে হচ্ছে না। নিরীহ ডলফিনের পাশাপাশি হাঙরও আছে, তিমির বিশাল দেহও গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এ কি বিপর্যয়! এ কি ধ্বংস! হাহাকার করে উঠল অর্ণবের মন।
আবারও চমকে চমকে অর্ণব দেখতে লাগল ভয়ঙ্কর বক্রপৃষ্ঠ দাঁতাল কুঁজোমাছ আর তোবড়ানো গালওয়ালা গভীর সমুদ্রের মাছদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা। এত তলে তো তেল নেমে আসার কথা না! তবু এত অনিয়ম হচ্ছে কেন সাগরতলে?
একটা কুঁজো মাছ বিশাল হা করে বর্শার মতো দাঁত বের করে এগিয়ে যাচ্ছে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা এক ডলফিনের দিকে। বুঝতে পারল ওই মরদেহ আলোর দেহে পরিণত হয়নি। কুঁজো মাছ তো কখনও! দিকে ধেয়ে আসেনি অথবা খাওয়ার জন্য এখন অথচ ছুটছে ডলফিনের ডুবতে থাকা দেহের দিকে। মাছদের দেহের লোভেই তোবড়ানো আর কুঁজোদের রাজ্যে উল্লাস বয়ে যাচ্ছে। খাদ্য পেয়ে কি উৎসব জেগে উঠেছে জলজ মৎস্যকুলে। আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে হা-করা কুঁজো মাছ! এ হা থেকে আজ রক্ষা নেই ডলফিনের মতো শক্তিশালী মাছপ্রজাতিরও! ওর বোঝার বাকি নেই দূষণের পরিণতিতে সাগরতলে নেমে আসছে ডলফিন, হাঙর আর মৃত তিমিদের বিশাল মৃত দেহসম্ভার।
এত সব বিশৃঙ্খলার মাঝেও অর্ণব আবার শুনল উর্বশীর ডাক- সাড়া দিচ্ছিস না কেন? কথা বলছিস না কেন, চন্দনা?’
উর্বশীর কণ্ঠে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শোনার পর অর্ণবের মাথায় বাজ পড়ল। তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল উর্বশীও। তবে কি ডলফিনের দিকে কুঁজো আর গাল তোবড়ানো মাছের আক্রমণের মতো অসংখ্য দাঁতাল মানব হা-এর শিকারে পরিণত হয়েছে চন্দনা? চোরাগলির চোরাস্রোতে কি ভেসে গেছে সে? কালো অধ্যায়ের সঙ্গে উর্বশীর যোগাযোগও কি বিচ্ছিন্ন করে দিল উর্বশীকে নিজের আলোর জগৎ থেকে? সহস্র প্রশ্নের মিলিত ওজন সাগরে লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল ছড়ানোর মতো দূষণ ছড়িয়ে দিতে লাগল অর্ণবের মস্তিষ্কের সার্কিটে। ডুবে যেতে লাগল সে আঁধারে, নিষ্প্র্রদীপ ব্ল্যাকআউট ছড়িয়ে গেল সাগরতল আর মর্ত্যলোকে।
চলবে…