সুখ এবং সুখী
অনেকেই বলেন ‘ইস ও কি সুখী!’ আবার অনেকেই বলেন ‘আমার কপালে সুখ নেই।’ আবার অনেককেই বলতে শুনি ‘এই জীবনে আর সুখের মুখ দেখলাম না।’
আচ্ছা এই সুখটা ঠিক কি? প্রচুর টাকা? মানে গাড়ি, বাড়ি, প্রাচুর্য, জাঁকজমক জীবন তাই তো? তাহলে সুখ আর অর্থ একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ ধরেই নিতে হয় পৃথিবীর সব অর্থবান মানুষই সুখী। বাস্তবে কি সত্যিই তাই? আমরা আমাদের আশেপাশের ছোট্ট পরিমন্ডলেও দেখেছি প্রচুর অর্থ, অথচ দিনের শেষে সেই মানুষটি একা। এই একাকীত্বের যন্ত্রণায় তার প্রচুর অর্থ টাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে একদিন সে মৃত্যুকে বেছে নিতেও পিছপা হন না।
অনেক মানুষের আবার প্রাচুর্য নামক সুখ আছে, কিন্তু তার পেছনে আছে বিরাট অসুখ। সেই অসুখটা কি? শারীরিক? মানসিক? না, অন্যকিছু? তাই এমন মনে করার কিন্তু কোনো কারণই নেই যে অর্থবান মানুষ মাত্রেই সুখী। আমরা অনেকেই জানি সুখের পেছনে ছোটে অসুখ। তাই মনে হয় সুখের সাথে কিন্তু অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে পৃথিবীর সব অর্থবান মানুষকেই আমরা সুখী বলতে পারি, তাই না? আসলে সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদাও পালটে যায় বা বাড়তে থাকে।তাই এই বাহ্যিক চাহিদা বা অর্থের সাথে যদি সুখ নামক বিষয়টি যুক্ত হয়, তাহলে কোনোদিনই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। অর্থাৎ সুখ একবার আসবে, আবার একবার চলে যাবে।
সুখী ব্যক্তি কে? একজন সুখী ব্যক্তি হলেন তিনিই, যিনি সমস্ত ধরণের লোভ লালসা থেকে মুক্ত। সুখী হওয়ার জন্য কারও সংস্থান দরকার হয় না। খুশি হওয়ার জন্য পজিটিভ বা ইতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং ভাল চিন্তাভাবনা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং একজন ব্যক্তির এই দুটি দোষ থেকে দূরে থাকা উচিত।
লোভ থেকে দূরে থাকলেই প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়, লোভ একটি রোগের মতো। লোভ সবসময়ই সেই ব্যক্তিকে বিরক্ত করে, শান্তিতে বসতে দেয় না। লোভের কারণে, কোনও ব্যক্তি ভুল পথে চলতে শুরু করে, যা তার জীবনের শান্তি নষ্ট করে। লোভ এমন একটি রোগ যা একবার অনুভূত হয়ে গেলে সহজে যায় না। লোভ মানুষের ধ্বংসের প্রধান কারণ।
আর খারাপ কাজ এড়িয়ে চলা উচিত। দুষ্টতাও এক ধরণের রোগ। এই রোগটি কোনও ব্যক্তির খ্যাতি এবং ক্ষমতা নষ্ট করে। অন্য ব্যক্তির সঙ্গে খারাপ কাজ করা একটি ভুল অভ্যাস। যারা খারাপ কাজ করে তারা সমাজে সম্মান পায় না। অশুভ ব্যক্তির উপর নেগেটিভ বা নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা জাগায় যার কারণে সেই ব্যক্তিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। খারাপ কাজের চেয়ে তার সামনে ভাল জিনিস নিয়ে চিন্তা করা উচিত। খারাপ কিছু দেখলে খারাপ আসে সুতরাং খারাপ থেকে সবসময়ই দূরে থাকা উচিত। সুখী থাকতে হলে আমাদের জীবনটাকে ভেঙেচুরে নতুন করে সুন্দর করে সাজাতে হবে, তার জন্যে চাই সুস্থ সুন্দর অনুশীলন।
তাহলে দীর্ঘ সুখের জন্য আমাদের কি করতে হবে? এর একটা সত্যিই দারুণ ওষুধ আছে। সেই ওষুধটির কথায় তাহলে আসা যাক …
আমাদের সুন্দর জীবন যাপনের ওপর নির্ভর করছে এই সুখ। দীর্ঘ সুখের জন্যে আমাদের জীবন বোধ সুন্দর করে তুলতে হবে। বিজ্ঞানে এটা প্রমাণ হয়েছে যে “সুখী হতে হলে সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান এবং কগনিটিভ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক লরি স্যান্টোস। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “এটা খুব একটা সহজ কাজ নয়, এজন্যে সময় লাগবে।”
আসলে কেউ হঠাৎ করে সুখী হয় না, এজন্যে চেষ্টা করতে হয়। সুখী হওয়া বিষয়টি এমন নয় যে এটি নিজে থেকেই হয়ে যাবে। সুখী হওয়ার জন্যে আমাদের প্রত্যককেই চর্চা করতে হবে। আসলে জীবনের সবকিছুই নির্ভর করে সাধনা, পরিশ্রম আর ইচ্ছের ওপর। ভালো সঙ্গীত শিল্পী বা ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠার মতোই, সাফল্যের জন্যে তাদেরকে যেমন চর্চা করতে হয়, সুখী হওয়ার ব্যাাপরেও আমাদের তাই করতে হবে।
আসলে ভাল কিছু কাজও আমাদের প্রতিদিন নিয়ম করে করা উচিত। স্নান, খাওয়া, ঘুমের মতো এটিও একটি অভ্যেস। যেমন, কৃতজ্ঞতার একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। যারা ভাল কাজ করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। রাতে ঘুমতে যাবার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে সারাদিনে কি কি ভাল কাজ করেছি, কাউকে কষ্ট দিয়েছি কি? কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি কি? তাহলে পরের দিন থেকে নিজেকে শুধরে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বেশি করে ও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে হবে। প্রতি রাতে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এই কাজটি করা সবচেয়ে সহজ বলে মনে হয় কিন্তু এই কাজটি করা খুব কঠিন। আসলে আমরা সবাই জানি যে বেশি ঘুমাতে পারলে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারলে বিষণ্নতায় ভোগার সম্ভাবনা কম থাকে। এর ফলে ইতিবাচক মনোভাবও তৈরি হয়।
তৃতীয়ত, ধ্যান করতে হবে প্রতিদিন নিয়ম করে। আমাদের প্রত্যেকদিন ১০ মিনিট করে ধ্যান করতেই হবে। এতে মন ভালো থাকবে। এ ধরনের কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয় যা মানুষকে সুখী হতে সাহায্য করতে পারে।
চতুর্থত, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আরো সময় কাটাতে হবে। গবেষণায় পরিষ্কার একটি বিষয় দেখা গেছে, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ভালো সময় কাটালে আমরা যে কেউ অনেক বেশি সুখী হতে পারি। আমাদের যদি ভালো বন্ধু থাকে এবং সামাজিক যোগাযোগ থাকে এবং তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হয় তখন আমরা উল্লেখযোগ্য রকমের ভালো বোধ করব।
একটা কথা ভীষণ রকম সত্যি, বর্তমান নিয়ে ভাবতে হবে, আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে আছি এটি হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে। সবার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাচ্ছি এটা হৃদয় দিয়ে চিন্তা করতে হবে। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা কিভাবে আমাদের সময় কাটাচ্ছি, এই বিষয়ে একটু সচেতন থাকতে হবে।
বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে মন ভাল থাকে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে “আপনার সুখী হওয়ার জন্যে সময় সম্পর্কে আপনার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কতো অর্থ আছে সেটা দিয়ে আমরা প্রায়শই আমাদের সম্পদের হিসাব করি। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পদ হচ্ছে আসলে আমাদের হাতে কতো সময় আছে সেটার সাথে সম্পর্কিত।”
পঞ্চমত, সোশাল মিডিয়ায় যোগাযোগের পরিবর্তে বাস্তবে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সোশাল মিডিয়া থেকে সুখের বিষয়ে মিথ্যা যেসব ধারণা পাওয়া যায় সেসবে ভেসে যাওয়া উচিত নয়। সুখী হতে সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ইন্সটাগ্রামের মতো সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যম ব্যবহার করেন তারা, যারা এটা খুব বেশি ব্যবহার করেন না তাদের চাইতে কম সুখী। তাহলে ছোট করে বলতে হয়, আপনি যদি সত্যিই জীবনে সুখী হতে চান, তাহলে কৃতজ্ঞ হতে শুরু করুন, পরিবারের সাথে আরো বেশি সময় কাটান, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করুন, দিনের একটা সময়ে কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে ধ্যানে মগ্ন হউন, সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে সরে এসে আরো একটু বেশি ঘুমাতে চেষ্টা করুন।
তাহলে সুখী ব্যক্তি কে? একজন সুখী ব্যক্তি হলেন তিনিই, যিনি সমস্ত ধরণের লোভ লালসা, আসক্ত থেকে মুক্ত। কোনও বিষয়ে লোভ বা আসক্ত থাকলে সেই ব্যক্তির সুখ হয় না। এই সমস্যাগুলি যখন ব্যক্তিকে ঘিরে থাকে, তখন সেই ব্যক্তিটি সুখী থাকতে পারে না। সুখী হওয়ার জন্য কারও সংস্থার দরকার হয় না। খুশি হওয়ার জন্য পজিটিভ বা ইতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং ভাল চিন্তাভাবনা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ কারো মধ্যে লোভ থাকবে, ঈর্ষা থাকবে, ততক্ষণ তার ভাল ঘুম হবে না, ততক্ষণ সে সুখ পেতে পারে না। সুতরাং একজন ব্যক্তির এই দুটি গুণ থেকে দূরে থাকা উচিত।
লোভ থেকে দূরে থাকলেই প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়, লোভ একটি রোগের মতো। লোভ সবসময় একজন ব্যক্তিকে বিরক্ত করে, শান্তিতে বসতে দেয় না। লোভের কারণে, কোনও ব্যক্তি ভুল পথে চলতে শুরু করে, যা তার জীবনের শান্তি নষ্ট করে। লোভ এমন একটি রোগ যা একবার অনুভূত হয়ে গেলে সহজে যায় না। লোভ মানুষের ধ্বংসের প্রধান কারণ।
আর খারাপ কাজ এড়িয়ে চলা উচিত। এটিও এক ধরণের রোগ। এই রোগটি কোনও ব্যক্তির খ্যাতি এবং ক্ষমতা নষ্ট করে। অশুভ ব্যক্তির উপর নেগেটিভ বা নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা জাগায় যার কারণে সেই ব্যক্তিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। খারাপ কাজের চেয়ে তার সামনে ভাল জিনিস নিয়ে চিন্তা করা উচিত। খারাপ কিছু দেখলে খারাপ আসে সুতরাং খারাপ থেকে সবসময়ই দূরে থাকা উচিত।
(চলবে)