মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়- এ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে অলিম্পিকে সোনার মেডেল জিতে নিয়েছেন দুই পা হারানো জেনিফার ব্রিকার। জেনিফারের শরীরের উপরের অংশ দেখলে অনেকেই ভাববেন হয়তো তিনি বসে আছেন। আসলে তার শরীরের নিচের অংশটুকুই নেই। জিনগত ত্রুটির কারণেই গর্ভকালীন সময় পা তৈরি হয়নি জেনিফারের। তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে রুখতে পারেনি। তিনি জিমন্যাস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আর তার জন্য নিয়মিত সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। আজ তিনি একজন সফল জিমন্যাস্ট। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে পারফর্ম করেন। জিতে নিয়েছেন পুরুস্কার।
বর্তমানে জেনিফার ব্রিকার লস এঞ্জেলেসে থাকেন। তিনি জনপ্রিয় অ্যাক্রোব্যাটিক ও এরিয়াল শো অভিনেতাদের একজন। তিনি নিয়মিত বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তিনি তার প্রতিভা হাজারও মানুষের সামনে আজ প্রদর্শন করেন। তাকে দেখে সবাই অনুপ্রেরণা পায়। পা না থাকা স্বত্বেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন জেন ব্রিকার।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ রুমানিয়া থেকে তাঁর বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ১৯৮৭ সালের ১ অক্টেবর যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালের জেনিফারের জন্ম হয়। বাবা-মায়ের কাছে প্রতিবন্ধী শিশুকে বড় করার জন্য অর্থ ছিল না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন তারা শিশুটিকে নেবেন না এবং শিশু জেনিফারকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যান। পরের দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে একটি পালক বাড়িতে দিয়ে দেয়।
হাসপাতাল থেকে প্রায় ৭৫ মাইল দূরে বাস করেন জেরাল্ড ও শ্যারন ব্রিকার দম্পতি। তাদের ঘরে তিনটি পুত্র সন্তান থাকলে কোন কন্যা সন্তান ছিল না। কিন্তু এই দম্পতির একটি কন্যা সন্তানের মা-বাবা হওয়ার বাসনা ছিল। বহুবার চেষ্টা করেও গর্ভধারণে ব্যর্থ হন শ্যারন। এরপর শ্যারন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুটিকে দত্তক নেন এবং তার নাম রাখেন জেনিফার ব্রিকার।
জেরাল্ড ও শ্যারন দম্পতি দত্তক নিতে গিয়ে দেখলেন মেয়েটির পা নেই, এটা তাদের মাথা কাছে কোন ব্যাপার ছিল না। তারা তিনি নিজের সন্তান ভেবেই জেনিফারকে মানুষ করেন। জেরাল্ড ও শ্যারন দু’জনই কখনও জেনিফারের পা না থাকার বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। তাদের চোখে জেনিফার ছিল দেবশিশুর মতোই নিখুঁত। তারা প্রতিবন্ধী হিসেবে নয় বরং নিজেদের ৩ ছেলের মতো করেই ভালোবেসে বড় করেন জেনিফারকে। তিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়ে উঠেছে সে। জেনিফারের বয়স যখন মাত্র ৭ বছর তখন তিনি সফটবল টিমের ক্যাচার ছিলেন। দুই পায়ে দৌড়ানোর চেয়েও দুই হাত দিয়ে দ্রুত গতিতে চলতে পারতেন। এরপর তিনি বাস্কেটবল ও ভলিবল খেলা রপ্ত করেন এবং ভাল খেলতেন। তবে তার ট্রাম্পোলিন ও টাম্বলিং এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল।
১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন অলিম্পিক জিমন্যাস্টিকস আটলান্টায় স্বর্ণপদক জিতেছেন ১৪ বছর বয়সী জিমন্যাস্ট ডমিনিক মোসেনুর। তিনিই সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ আমেরিকান জিমন্যাস্ট হিসেবে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। এই খবরে উচ্ছসিত হন জেনিফার। ডমিনিকও ছিলেন রোমানিয়ান। ডমিনিকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ৮ বছর বয়সী জেনিফার জিমন্যাস্টিক্সে ঝুঁকে পড়েন। শরীরচর্চায় আগ্রহী দেখে তার মা (শ্যারন) তাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরের একটি জিমে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই সাধারণ মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করেও জেনিফার ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে এএইউ জুনিয়র অলিম্পিকে ৪তম স্থান অর্জন করেন। এর এক বছর পরে, তিনি ইলিনয় পাওয়ার টাম্বলিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন। এরপর ইউএস টাম্বলিং অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক অনুপ্রেরণা পুরস্কার পান।
১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে ডমিনিক মোসেনু যখন পারফর্ম করছিলেন, তাকে দেখে জেনিফারের মা শ্যারন ব্রিকার সন্দেহ করেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো জেনিফারের সঙ্গে ডমিনিকের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। এরপর তিনি হাসপাতালের দত্তক নেওয়া কাগজে দেখতে পান জেনিফারের বাবা-মায়ের নামের শেষে মোসেনু পদবী আছে। তিনি আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন এবং জানতে পারেন, ডমিনিক মোসেনু জেনিফারের আপন বোন। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জেনিফারকে জানাননি তার মা। অলিম্পিকের ৮ বছর পর তখন জেনের বয়স ১৬ বছর। একদিন কৌতূহলবশত জেনিফার তার বাবা-মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই শ্যারন ব্রিকার তাকে বলেন, ‘তোমার পরিবারের শেষ নাম হলো মোসেনু। সেই অর্থে ডমিনিক মোসেনুই হলো তোমার বোন।’
এতদিন যাকে দেখে জেন নিজেকে অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন, তিনি আসলে নিজেরই বোন- এই বিষয়টি ভাবতেই অবাক হচ্ছিলেন জেনিফার! কয়েক মাস পরে জেনিফার তার জন্মদাতা মা’কে ডেকে আনেন। সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি জন্মের পরে একটি মেয়েকে হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিলেন?’
এই প্রশ্নে জেনের গর্ভধারিণী মা ব্যথিত হন এবং মুষড়ে পড়েন। এরপর তার মাধ্যমেই জেনিফার তার আইডল ও বোন ডমিনিককে ডেকে পাঠান। চ্যাম্পিয়ন ডমিনিকও হারানো বোনকে পেয়ে বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কারণ তিনিও জানতেন না এই বোনের কথা। ৪ বছর পর দুই বোন অবশেষে এক হন।
‘Everything Is Possible: Finding the Faith and Courage to Follow Your Dreams’- বইটিতে নিজের জীবনের সব ঘটনা লিখেছেন জেনিফার। ডোমিনিক বাউয়ার নামক এক ব্যাক্তি জেনিফারের বই পড়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তারা ফোন ও ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ২০১৯ সালের মার্চে বাউয়ার প্রেমের প্রস্তাব দেন জেনিফারকে। তারা একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এরপর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ছাব্বিশ বছর বয়সী ডোমিনিক বাউয়ারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তারা সুন্দর দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন।
অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ- তার জ্বলন্ত উদাহরণ জেনিফার ব্রিকার।