বহুমুখী প্রতিভার এক অনবদ্য সৃষ্টি ঘটেছিল বিরুপাক্ষ ওরফে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মধ্যে। বিষ্ণু শর্মা ছদ্মনামে বেতারে মহিলা মজলিসের পরিচালনা। বিরুপাক্ষ ছদ্মনামে ব্যঙ্গ রচনা প্রণয়ন বাংলার ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী প্রদান কিংবা বেতার নাটকের সূচনাকারী পথিকৃৎ। তিনি কি না করেছেন! তবে বাঙালির মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন মহালয়ার ভোরে কাশফুলের দোদুল্যমান শারদীয়ার আগমনের “মহিষাসুরমর্দিনী” বার্তা জানিয়ে সুমধুর চন্ডী পাঠ করে। অথচ মাত্র বাইশ বছর বয়সী এই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ বেতার ষ্টেশনে প্রথম ভয়েস টেষ্টে ফেল করেন। পরে আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর ভাঙা গলায় হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য অনন্য অসাধারণ এক যাদুকন্ঠ। বিশেষ ট্রেন্ড অন্যের গলা নকল করার দক্ষতা ছিল তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘বুশী।’ স্কুলের শিক্ষক রাজেন বাবু বুঝেছিলেন যে ছেলেটির গলায় আছে সুরের মায়াবী জাদু। মাত্র আট বছর বয়স থেকে বেলুড় মঠের স্বামীজীদের সম্মুখে কবিতা আবৃতি ও চন্ডী পাঠ শুরু। আর আজ তিনি কিংবদন্তি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। তাঁর চন্ডী পাঠের সুর না শুনলে বাঙালি ঘুম ভাঙতেই চায় না। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে চন্ডী পাঠ করার ব্যাপারে তাঁর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার পিছনে কাজ করেছে এক অদ্ভুত ভালো লাগার আবেগ।বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন “মহালয়ার দিন ভোরে স্নান সেরে গরদ পরে তিনি বেতার ষ্টেশনে আসতেন। দেখে মনে হতো উনি যেন নিজের মধ্যেই আর নেই। সে যেন এক অন্য জগৎ। ভাব বিহ্বল কন্ঠে তাঁর স্তোত্র পাঠের স্মৃতি আমি জীবনে ভুলতেও পারবো— না। বন্ধু জনের শোক তাপে বিরেন ’দা ছুটে যেতেন সবার আগে। পরিচালক অজয় কর এর মৃত্যুর পর বীরেনদা গীতা পাঠ করেছিলেন তাঁর শ্রাদ্ধ কার্য্যে। ১৯৭৬ সালে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান থেকে আকাশবাণী বীরেন ’দা কে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইচ্ছা না থাকলেও উপর মহলের চাপ থাকায় সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিতেই হয়।অথচ বিরেনদা কিন্তু আমার যন্ত্রণাটা ও বুঝতে পেরেছিলেন তাই একটুও রাগ করেননি। আর ১৯২৮ সালে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ গাঁটছড়া বাঁধলেন রেডিও র সঙ্গে। ১৯২৯ সালে হলেন “অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অফ ইন্ডিয়ান প্রোগ্রামস।” ১৯৪৩ সালে বিশেষ কারণে চাকরি ছাড়লেন তবে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করতেন। কলকাতা রেডিও ষ্টেশনে তখন নক্ষত্রের মেলা। কে এল সায়গল, হাফিজ আলি খান, দিনু ঠাকুর, প্রেমাঙ্কু আতর্থী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বাণী কুমার, কেশব গুপ্ত, কে নেই এই তালিকায়! রোজ বসতো জমজমাটি আড্ডা। আর আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র- কারণ এমন রসিক মানুষ ছাড়া কি আড্ডা জমে?”
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র একধারে নাট্যকার, নাট্যরূপ দাতা, বেতার অভিনেতা, ব্যঙ্গ লেখক, ভাষ্যকার ও আবৃত্তিকার। যখন যে ভূমিকাতে থাকুক না তাঁর স্বাতন্দ্র্য দিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতেন তিনি। কলকাতা রেডিও পত্রিকা “বেতার জগৎ।” সেই প্রতিকা নিয়ে তিনি বাড়ি বাড়ি বিক্রি করেছেন। আবার ফুটবল খেলার ধারা বিবরণী থেকে শুরু করে যাবতীয় বিখ্যাত ব্যাক্তিদের মৃত্যুকালীন ধারাবাহিক বিবরণী দিয়েছেন। এমনকি মহানায়ক উত্তম কুমারের অন্তিমশোক যাত্রার শেষ পর্যায়ে ছিল তাঁর ধারা বিবরণী। ধারাবিবরণী তাঁর লেখা ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘৪৯ নং মেস’ দুটি নাটক মঞ্চ সফলতা লাভ করেছিল। নিউ এ্যাম্পেয়ার হলে এক সময় নিয়মিত ‘দেবতার গ্রাম’ নিজে উপস্থিত হয়ে আবৃত্তিও করেছেন। কারণ তাঁর আবৃত্তি রেকর্ড করা ছিল না। একই সাথে ‘দক্ষযজ্ঞ’, ’তরণী সেন বধ’ এর মত প্রায় ৩০টি পালা রেকর্ড করেছেন। পালার মডিউলেশান করার ক্ষেত্রে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। রুপালি পর্দার দাপুটে অভিনেতা কমল মিত্র যাত্রায় নামার আগে নিয়মিত তালিম নিতে আসতেন। তাঁর বাড়িতে তালিম নিতে যখন তখন ছুটে আসতেন কবি কাজী নজরুল ইসলামও। হারমোনিয়াম বাজিয়ে নজরুল শুরু করতেন উদার্ত্ত কন্ঠের গান। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র খাওয়াতেও খুব ভালোবাসতেন। তাই নিঝুম রাতে চাপিয়ে দেওয়া হতো নজরুলের প্রিয় খাবার ’খিচুড়ি।’ আর এক বন্ধু ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। দুজনেই একসাথে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মৃতিচারণে বলেছেন যে “বীরেন্দ্র কৃষ্ণের যে অসীম সাধ্য ছিল, দিয়েছেও উজার করে। বেশির ভাগটাই রেডিওতে। তবে প্রতিদান হিসাবে তেমন বিশেষ কিছু পায়নি। আসলে জনপ্রিয়তাকে ক্যাশ করে আখের গুছানোর উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর, তাই পাননি। অর্থকড়ির সাথে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের যেন আড়ি ছিল।যতদিন রেডিওতে ছিলেন, তখনও পে-স্কেল চালু হয়নি। ফলে আর্থিক অনিশ্চিয়তা লেগেই ছিল।
সতীর্থদের কথা ভাবতেন কিন্তু তাঁর কথা ভেবে ছিলেন কজন? বেতারে সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে তাঁর যে দক্ষতা ছিল তার যোগ্য সম্মান তিনি পাননি। একবার কেন্দ্রীয় সাহায্যের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব সমন্বিত চিঠির ভাষা পড়ে একজন প্রকৃত শিল্পীর পক্ষে মনে হয়েছিল এটা অসম্মানজনক। তাই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্যে তিনি বলতেন যে ‘টাকা না পাই কাজ করলে তো আনন্দ পেয়েছি।’
তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের স্মৃতিতে আর ভালোবাসায়। দৈনিন্দন জীবনের অসঙ্গতি নিয়ে রচিত ব্যঙ্গ রচনা সাথে সাথে সেই গুলি নিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করার যে মুন্সীয়ানা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মধ্যে ছিল, তাতেই মূল লেখার গ্রহণ যোগ্যতা একবারেই কয়েকগুণ বেড়েই যেত। এই প্রসঙ্গে বিরূপ তনয় প্রদ্যুৎ কুমার ভদ্র লিখেছিলেন যে ‘তাঁর গঠনের নির্জীব রচনা ও সজীব হয়ে উঠতো। পড়তে হতো ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখতেন বলে তাঁর অনেক রচনা ঠান্ডা ছাপার অক্ষরে তাদের সঠিক রূপ ও রসের অাভাস দিতে পারে মনে হয় না।রসিয়ে পড়ে স্রোতার কানে পৌঁছে দিতে পারলেই তাঁদের প্রতি সুবিচার করা হয়।
১৯০৫ এর ৪ঠা আগষ্ট তাঁর জন্ম অর্থাৎ তিনি অনেক আগেই শততম বর্ষে পৌঁছে গিয়েছেন। করোনা আবহে তাঁর ১১৭ তম জন্মবার্ষিকীতে আরও একবার পুজো প্রায় এসেই গিয়েছে। ‘মহালয়া’ আরও একবার মনে করিয়ে দেবে তাঁর সেই জাদু মাখানো তার অননুকরণীয় ভরাট অনন্য কণ্ঠে মহালয়া। ভোর আকাশে কাশফুল মাথা দোলাবে, তিল তিল করে ঝরে পড়বে শরতের শিশির বিন্দু। শিউলি বাতাসে সুগন্ধ ছড়াবে, বকুল শুকিয়ে গেলেও সুবাসিত গন্ধে ভরিয়ে তুলবে, আর টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিওতে শুরু হবে সেই চেনা মায়াবী কণ্ঠস্বর ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরদিনের চেনা মানুষ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জনপ্রিয়তা এই যুগে একটুও কমেনি। এটাই বোধহয় শতবর্ষের পরেও মহান শিল্পীর এক বিশেষ স্বত্বা এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।