পর্ব – বারো: কাদায় ডোবানো পা, অতিবিশ্বাসের ফাঁস
চন্দনাকে দেখে শিল্পপতি হিকমত আবসারি বললেন, ‘বাহ! নতুন সাজে তো তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।’
রোমাঞ্চ সন্ধানী আবসারির মনের মতো সঙ্গিনী হওয়ার লোভে সাজেনি চন্দনা, সেজেছে লোভী আবসারির মোহের জগতে ঘূর্ণি তৈরি করতে- ঘূর্ণি উঠবে তার মস্তিষ্কে, ঘূর্ণির কেন্দ্রে ঘুরপাক খাবেন তিনি আর তার হাতের নাগালের বাইরের পরিধিতে সেঁটে রাখবে চন্দনা নিজেকেÑ এমনি প্রত্যয়ী মনোভাবের কারণে বিগলিত কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘ভালো লাগছে, আপনার?’
ঠোঁট চেপে মাথা দোলালেন হিকমত আবসারি। এই ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্লোভ মানবিক পরোপকারী এক ব্যক্তির প্রতিচিত্র। হ্যাঁ-বোধক মাথা নোয়ানো দেখে বাঁকা হেসে চন্দনা বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
মুখে ধন্যবাদ জানালেও অন্তরের মাঝখানে দেয়াল তুলে রমণীসঙ্গে অভ্যস্ত জ্ঞানপাপী মানুষটি থেকে সুবিধা আদায়ের পাশাপাশি নিজেকে রক্ষার কৌশল বিষয়ে ভেবে রাখা বিষয়গুলোতে কল্পমনে চষে বেড়িয়ে এলো একবার। সব ঠিকঠাক চলছে ভেবে এগিয়ে গেল সামনে অপেক্ষমাণ কালো মাইক্রোর দিকে।
মাইক্রোর দরজা এখনও খোলেনি। পেছন পেছন আসতে থাকা আবসারি বললেন, ‘সারাদিন তো থাকবেই আমার সঙ্গে, প্রয়োজনে রাত্রিযাপনও করতে হতে পারে। মানসিক প্রস্তুতি আছে তো রাত্রিযাপনের?’
চট করে একটা ধাক্কা খেল চন্দনা। ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘সে-রকম প্রস্তুতির কথা কি আগে বলেছিলেন? বলেছিলেন অফিসিয়াল ভ্রমণে যেতে হবে। এখন প্রোগ্রাম চেঞ্জ করছেন কেন?’
‘না। প্রোগ্রাম চেঞ্জ করিনি। তবে জরুরি কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা ভালো না? সন্ধ্যার আগে আগে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও হেমন্তের কুয়াশামুখর সন্ধ্যায় যদি রওনা দিতে অসুবিধে হয়? ড্রাইভার যদি ড্রাইভ করার ব্যাপারে সংশয় ও দুর্বলতা প্রকাশ করে, একবার এমনটি ঘটেছিল, আগের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি ভেবে রাখলাম, নতুন পরিকল্পনার ছক মাথায় রাখা কি ভুল?’
উত্তরের মধ্যে হ্যাঁ-না বোঝা যাচ্ছে না। ব্যাখা-বিশ্লেষণের মধ্যে সহজ অনুভূতি ঢুকিয়ে দেওয়া হলেও, উদ্দেশ্য যে কেবলই প্রয়োজন সাপেক্ষে রাত্রিযাপন তা বোঝা যাচ্ছে না। প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করা লাগতে পারে- কথাটাও মানানসই হচ্ছে না; নিজের নিরাপত্তার জন্য ভেবে রাখা রক্ষাব্যূহের সঙ্গে খাপে খাপে মিলছে না এ প্রস্তাবের ছক। এখনও ‘হ্যাং আউটে’ যাওয়া হয়নি, যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, এরই মধ্যে নিজের ভেবে রাখা কৌশলের শাখা-প্রশাখায় ফাটল তৈরি হচ্ছে?’ মনে জেগে ওঠা প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো চন্দনা।
‘কী? যাবে, না যাবে না? ভেবে দেখো। এখনও সময় আছে। ইচ্ছে করলে ফিরে যেতে পারো। তোমার মনের ওপর জোর খাটাতে চাই না। জোর করে কোথাও বেড়াতে গেলে আনন্দ করা যায় না।’
কৌশলী-তির ছুড়লেন আবসারি। বিঁধে গেল সেই তির ঠিক পয়েন্টে। ফিরে যাওয়া উচিত। মাইক্রোর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলে মেনে নেওয়া হবে ওনার দাবি। না গেলে ব্যর্থ হবে মিশন। দ্বন্দ্বে পড়ে গেল চন্দনা। সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। সময় খুব কম। মাথায় উদয় হচ্ছে না যুক্তিযুক্ত কোনো সমাধান। জট তৈরি হয়ে গেছে চিন্তনে- অশ্লীল বারুদের অগ্রিম ধোঁয়ায় চাপা পড়ে যেতে লাগল মনের জোছনা।
হঠাৎ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন চিন্তনের ফাঁক গলে আচমকা উদিত হলো বাঁকা চাঁদ। বুকের মধ্যে জমতে থাকা ছেঁড়াছেঁড়া কুয়াশার চাদরও সরে গেল। দরজার হাত রাখতে গিয়েও ধরল না হাতল। এক পা পিছিয়ে এসে পাক খেয়ে সরাসরি আবসারির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনার উদ্দেশ্য ভ্রমণ না অন্য কোনো বিলাস?’
প্রশ্নের বারুদতাপে একবার ঝলসে উঠল আবসারির অসন্তুষ্ট শারীরিক চাহিদা। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিভে গেলেও আবার ঝলসানো তেজ বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে। প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হলেন, ‘একজন পুরুষের ভেতরে কী আছে, কী থাকে, জানো না তুমি! তবে উত্তরে তোমাকে নিশ্চয়তা দিতেই হয়, তুমি রাজি না হলে অন্য কোনো বিলাস নয়, আনন্দভ্রমণই সই।’
‘গুডবয়’। বলতে বলতে হাতল টেনে খুলে ফেলল মাইক্রোর দরজা। মাঝের সিট-লাইনে বসতে গিয়ে দেখল পেছনে ইতোমধ্যে বসে আছে আরও দুজন।
ওরা কারা প্রশ্ন করার আগেই ঢুকে গেলেন আবসারি। মাইক্রো স্টার্ট নিচ্ছে। চালক তাকিয়ে আছে সামনে। কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল চন্দনা। আসল কুয়াশাই ঝরছে, এখন সকাল আটটা, তবু কমেনি কুয়াশাপতন। এ মুহূর্তে ভেতরের তেজ অবশিষ্ট থাকলেও বাইরে পাপড়ি ঝরে যাওয়া ফুলের মতোই নিজেকে মনে হতে লাগল চন্দনার।
কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে বসে আবসারি বললেন, ‘পেছনে বসেছেন রিসোর্টের এক্সিকিউটিভ। আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ওদের হাতে।’
প্রশ্ন করেনি চন্দনা। অথচ নিজ থেকেই উত্তর দিচ্ছেন তিনি। উত্তরে আপাতত কোনো শঠতা চোখে না পড়লেও উদ্ধৃত ‘এক্সিকিউটিভ’ শব্দটির মধ্যে ঘাপলা আছে মনে হলো। ‘বডিগার্ড’ বললে হয়তো বেমানান শোনাতো। সে-কারণেই কি ‘এক্সিকিউটিভ’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন?
উদিত নতুন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল চন্দনা। প্রাথমিক ভীতির আলোড়ন স্থিত হতে লাগল। ভাবনায় উড়ে এসে জমা হতে লাগল নতুন প্রশ্নের ঝড়। সব কিছু ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে না, পরিকল্পনা আর ভেবে রাখা ছকের সঙ্গে সব মিলছে না। তবু সময় এগিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট পথে। এ কারণে মনে পড়ে গেল উর্বশীর শেষ নিষেধাজ্ঞা- আলো চায় সে, অন্ধকার নয়।
অন্ধকার বিদীর্ণ না করে কি আলোর স্ফুরণ ঘটানো যায়?
আলোর দিকেই কি যাচ্ছে এখন নিজে? নাকি নিজের তৈরি ফাঁদে আটকে যাবে ও? নাকি কেবল আঁধার থেকে আরও আঁধারের তলদেশে ডুবে যাবে?
উত্তরে ধোঁয়াশা জড়িয়ে থাকলেও গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে। সূর্য তেজ ছড়াচ্ছে । কুয়াশার চাদর সরে যাচ্ছে। চলমান গাড়ির সামনের সড়ক স্পষ্ট হচ্ছে। সড়কের উভয় পাশে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে এখন কেবল রোদের ঝিলিকই আসছে না, রোদের প্লাবনেই ডুবে যাচ্ছে প্রকৃতি। ধোঁয়াশা ফুঁড়ে ‘হঠাৎ পেয়েছি’র মতো আলোর ঢেউ ছলকে উঠল। পুণ্য আলোয় শুদ্ধ হয়ে উঠল মন।
খেয়াল করে দেখল গাড়ির সিটে হাতের কাছে উল্টে আছে আজকের একটি দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠা। পেরিয়ে আসা মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল গাড়ি। হকার এসে পত্রিকা বাড়িয়ে ধরেছিল কালো উইন্ডশিল্ডের পাশে। হিকমত আবসারি পত্রিকাটি নিয়েছেন। দুয়েকটি হেডলাইন পড়ে রেখে দিয়েছেন পাশে। পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ছাত্রের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা’ শিরোনামে চোখ আটকে গেল চন্দনার। শিরোনামটি আকস্মিক মাথায় ঢুকিয়ে দিল নিজেকে রক্ষা করার কৌশল। চোরাগলিতে ঢুকে নিজেকে রক্ষার কৌশল উদ্ভাবন করার চিন্তা বোকামি জেনেও দোটানা ইচ্ছার দড়িতে টান খেয়ে গিঁট লেগে গেল। এ ইচ্ছার পেছনে রয়েছে সুবিধা আদায় করার গোপন তাগিদ। অথচ গিঁটের টানে ফাঁস না খেয়ে অন্যকে ফাঁস দেওয়ার পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা আসতে লাগল মাথায়…
মূল সড়ক থেকে বাঁয়ে হঠাৎ ঘুরে গেল কালো মাইক্রো। এত গতিতে থাকা অবস্থায় কোনো গাড়ি আকস্মিক ঘুরতে পারে কল্পনায়ও ছিল না। বাঁক নেওয়ার সময় হঠাৎ অনেকটা উড়ে গিয়ে চন্দনা পড়ল হিকমত আবসারির দেহের ওপর।
পঞ্চাশোর্ধ্ব দেহে বাইশ বছরের তরুণীর উড়ালপতনে রোমাঞ্চিত হলেন না হিকমত আবসারি বরং ধমক দিলেন ড্রাইভারকে।
ড্রাইভার বলল, ‘স্যার, বাঁয়ের গলিটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি পেরিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যের গলি-সড়ক। তাই…’
‘থাক। কৈফিয়ত দিতে হবে না। সাবধানে চালাও সামনের পথ।’
একটা ঝলমলে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গাড়ি। চারদিকে গাছ-গাছালি ভরা বাড়িটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার বাগানবাড়ি। মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকি। গোপনীয় কিছু প্রশাসনিক কাজও করি।’
আবসারির কথায় পাল্টা কোনো প্রশ্ন করল না চন্দনা। ইতোমধ্যে বহুবার এই কথা শুনিয়েছেন তিনি।
গাড়ি থেকে নামার সময় পত্রিকাটি ভাঁজ করে নিজের হ্যান্ডব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে চন্দনা বলল, ‘পত্রিকাটিতে একটা মজাদার খবর ছাপা হয়েছে। এজন্য এটা সংগ্রহে রাখলাম।’
হিকমত আবসারি কৌতূহল দেখালেন না। দুই এক্সিকিউটিভ কাম বডিগার্ড আগেই নেমে গেছে। তিনিও এগিয়ে যেতে লাগলেন বাড়িটির দিকে।
বাড়ির গেট পেরুনোর আগে একবার চারপাশে তাকাল চন্দনা। পুরোনো বাড়ি হলেও, নতুন বাড়িই মনে হচ্ছে এটিকে। পাশ থেকে শিশুগাছের ঢাল ঝুলে আছে বাড়ির দিকে। প্রাচীন আমলের বড় বাড়ি কিনে এই প্রকৃতিতে বোধ হয় নতুন বিল্ডিং তুলেছেন হিকমত আবসারি। বুঝতে পেরে তার রুচির প্রশংসা না করে পারল না। গাছের শিশিরস্নাত সবুজ পাতা, প্রশাখার আড়ালে লুকোনো পাখির বাসা, মৃদু বাতাসের দোলে পাতার মর্মরধ্বনি জঙ্গলের অরণ্যস্বাদ ঢেলে দিল মনে। সবুজ প্লাবনে ঝকঝকে রোদের ঢল চন্দনার বুকে ছড়িয়ে দিল চন্দনের সুবাস, চন্দনশিল্পের নান্দনিক স্কেচ বুকে এঁকে ঢুকল সে বাড়ির ভেতর।
অন্ধকার জগতে অন্ধকার নেই, কেবল আলো আর আলো; আলোর গহীনতলেও কি তবে লুকিয়ে থাকে আঁধার? উদিত প্রশ্নটি নিয়ে ভাবার সুযোগ পেল না চন্দনা।
ঘরে ঢুকে হিকমত আবসারি বললেন, ‘ওপাশেরটা তোমার রুম। যাও। রিলাক্স করো। প্রয়োজনে গোসলটাও সেরে নিতে পারো। আমি কয়েকটি প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচ্ছি।’
নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে হিকমত আবসারির ধৈর্যের প্রশংসা করল চন্দনা। ভেবেছিল রুমে ঢুকেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। না, তেমন কোনো তাড়া দেখা গেল না তার কথায় ও আচরণে। স্বস্তি পেলেও শঙ্কা উড়ে গেল না মাথা থেকে।
রিলাক্স করার উপদেশ পেলেও কোনো উদ্যোগ নিল না চন্দনা। হেলানচেয়ারে বসে পত্রিকাটি বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ পর চন্দনার ঘরে এলেন হিকমত আবসারি।
‘গোসল করেছো?’
‘না। বাসা থেকে গোসল সেরে বেরিয়েছি।’
‘জার্নির পর গোসল করতে হয় আমাকে। সেরে নিয়েছি। তাজা লাগছে নিজেকে। তুমিও…’
‘না। আমার তাজা হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ নিজেকে মলিন ভাবি না। ঝরাপাতার মতো ঝরে গেছি, তাও মনে করি না।’
‘বেশ ভালো।’
আরও কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলেন আবসারি। তার নজর গেল দৈনিকটির ওপর। নিমগ্ন হয়ে নিউজটি পড়ছে চন্দনা- বত্রিশ বছরের শিক্ষিকার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা চলছিল বাইশ বছরের ছাত্রের সঙ্গে। ছাত্রকে বিয়ের জন্য এখন চাপ দিচ্ছেন শিক্ষিকা। ছাত্রটি রাজি না হওয়ায় মামলা করেছেন তিনি। মামলার পর শিক্ষিকাকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’ নিউজটি পড়ে উড়ে এসে হিকমতের মাথায় আঘাত করল তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ। স্বগতোক্তি হিসেবেই বললেন, ‘যা ঘটার দুজনের সম্মতিতে ঘটেছে। মামলার কারণ কী? ধর্ষণ তো ঘটেনি। দুজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে সম্মতিতেই তো ঘটতেই পারে নানা কিছু।’
‘নানা কিছু কী?’
‘অবাধ মেলামেশা। সেটাই ঘটেছে সম্মতিতে।’
‘এখানে প্রলোভনের ব্যাপারও আছে। মেলামেশা করেছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে। রিট করার জন্য মামলা করা হচ্ছে। অসুবিধে কি মামলায়?’
শিক্ষিকার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় চন্দনার উদ্দেশে হিকমত প্রশ্ন করলেন, ‘সম্মতিতে এসব ঘটার ব্যাপারে তোমার আপত্তি নিশ্চয়ই হবে না?’
‘অবশ্যই আপত্তি হবে না। তবে সম্মতি ছাড়া কিছু ঘটানো মানে রেপ করা, জানেন তো সেটা?’
আবসারি চুপ হয়ে গেলেন চন্দনার ঘোরানো তেজোদীপ্ত প্রশ্নবাণ খেয়ে।
‘বুঝলেন না। রেপ! মানে ধর্ষণ করা। সম্মতি ছাড়া ঘটলে সেটাকে ধর্ষণ বলে। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ কখনও ধর্ষক হতে পারেন না, তাই না?’ প্রশ্ন করল চন্দনা।
‘ধর্ষণ’ কিংবা ‘ধর্ষক’ শব্দ দুটি উঁচু দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেল দুজনার মাঝে। মানবিক গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটল আবসারির কণ্ঠে, ‘ঠিকই বলেছো তুমি। জবরদস্তি করে কিছু পাওয়া হয় না, জয় করে পেলে তাকে পাওয়া বলে। তোমাকে পাওয়ার গোপন তাড়না কাজ করেছে, তোমাকে এখানে আনার পেছনেও আছে গোপন লালসা। সত্য লুকিয়ে লাভ নেই। তবে নিশ্চিত থাকো, তোমার অসম্মতিতে কিছুই ঘটবে না। সম্মতি দিলে চাকরি কনফার্ম হওয়াসহ তোমার শতভাগ আর্থিক চাহিদাও পূরণ হবে।’
‘সম্মতি না পেলে কি চাকরি কনফার্ম হবে না? বাড়াবেন না আর্থিক সহযোগিতার হাত।’
‘হবে। পূরণ হবে। তবে ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ হলে আমারও আনন্দ হতো। চাপমুক্ত থেকে তোমার সঙ্গে… আমার চাহিদা পূরণ না হলেও তোমার কোনো ক্ষুদ্র চাহিদা অপূরণ থাকবে না। এ চাহিদার সঙ্গে সেই চাহিদার তুলনা চলে না। তুলনা করা ঠিক হবে না।’
কাদায় ডোবানো পায়ে কাদা লাগেনি এখনও- এমন ভুল ভাবনায় তৃপ্তি পেল চন্দনা। মনে পড়ল উর্বশীর কথা। গলিতে ঢুকলে ফেরার পথ না-পাওয়ার ব্যাপারে তার সতর্ক সংকেতের শেকল জড়িয়ে ধরল পা। শেকল জড়ানো পায়ে হুঁশিয়ারবাণী ধ্বনিত হচ্ছে। একবার ও তাকাল পায়ের দিকে। একবার তাকাল আবসারির দিকে। তারপর দম নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘বলেছি অফিসিয়াল ভ্রমণে সঙ্গ দেব। সব দেব সে-কথা বলিনি। সে-বিষয়ে সম্মতি দিইনি। মনে রাখলে খুশি হব।’
শিরায় ছুটে বেড়ানো তৃষ্ণার্ত প্রবৃত্তির বিষবাঁশির বিষসুরে মোচড় খেল দেহ; গোপন অভিসারের সবুজ-প্রকৃতিতে বসিয়ে দিল মরণচুম্বন। শীতে জল শুকিয়ে যাওয়ার মতো দেহখালের চোরাস্রোতও মিলিয়ে যেতে লাগল। মুখ ও মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো শুকনো খটখটে ডাঙা। এ ডাঙায় নৌকো চলবে না ভেবে চুপ হয়ে গেলেন হিকমত আবসারি। তার ইতোপূর্বের অভিজ্ঞতা পুড়ে ছাই হয়ে না গেলেও ছাইভস্মের অগ্রিম আলামত টের পেয়ে কৌশলী পথে পা বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক। সম্মতি দিলেই নান্দনিক বাথটাবে জল আসবে, তা না হলে শুকনোই থাকবে বাথটাব কিংবা সুইমিংপুল।’
এ কথার জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না চন্দনা। হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে রাখা স্মার্টফোনের ভাইব্রেশনের সংকেত পেয়ে দ্রুত ফোনটা বের করে বুঝল উর্বশী কল করেছে। জ্যোৎস্না-ঝিলিক বেরুল ওর মুখের কোমল ত্বক থেকে। সেট অন করে আবসারির সামনেই বলল, ‘চোরাগলি নয় এখন, হেমন্তের রৌদ্রস্নাত নরম প্রকৃতিতে ডুবে আছি। ভয় পাস না। এখনও আঁধার আসেনি। আলোই দেখছি চারপাশে।’
‘না। মানছি না। আলোতে কালো মিশে আছে নিশ্চয়ই। তোর সঙ্গে, কালোতে ডুবে আছিস বিধায়, যোগাযোগ করলে অর্ণবের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি আমি। এটা নিশ্চয়ই ভয়াবহ পরিণতির সংকেত। প্লিজ! চলে আয়। কালোর আসল রঙটা ধর। উঠে আয়। রাতে কোনোমতেই থাকিস না সেখানে।’
‘না। থাকব না। তোর কথাই সই। তাছাড়া সেই চুক্তি করেই এসেছি আমি।’
‘তোর চুক্তিতে নিশ্চয়ই গলদ আছে। ফাঁক আছে। সেই ফাঁক দিয়ে তেল নির্গমনে নদী দূষণের মতো নিশ্চয়ই দূষণ ঘটবে জীবনের। সতর্ক হ। অতিবিশ্বাসী হোস না। অতি বিশ্বাসও অনেক সময় ডোবায় মানুষকে।’
হিকমত আবসারি উঠে গেলেন চন্দনার সামনে থেকে। তাকে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দাঁড়িয়ে রইলেন পাশের রুমে নিরাপদ দূরত্বে, কথা শোনা যায় এমন স্থানে। চন্দনার উচ্ছ্বসিত কথার ঢেউ থামছে না। নিজেকে একশ ভাগই নিরাপদ ভাবছে ও। এ বোধও কাঁপিয়ে দিল হিকমত আবসারিকে।
চলবে…