কোনো কষ্ট ছাড়াই ঘরে বসে সপ্তাহে সাত থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়! শুনতে অবাক লাগলেও এমন অফারেই ভার্চুয়াল জগতে মানুষকে ফাঁদে ফেলে আলোচিত রিং আইডি। কষ্ট ছাড়া এমন আয়ের জন্য শর্ত ছিল শুরুতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে খুলতে হবে একটি আইডি। পরে বেঁধে দেওয়া সময় পর্যন্ত অনলাইনে দেখতে হবে বিজ্ঞাপন।
তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এমন অভাবনীয় সুযোগ হেলায় হারাতে চায়নি দেশের লাখ লাখ মানুষ। রিং আইডির ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই হারিয়েছেন বিপুল টাকা। শুরুতে কেউ কেউ কিছু টাকা পেলেও পরে নানা জটিলতায় পড়েছেন গ্রাহকরা।
যাত্রা শুরুর ছয় বছরে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিষ্ঠানটি গত তিন মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকার ওপর টাকা তুলেছে বলে দাবি করেছে সিআইডি।
২০১৫ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শরিফুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সাইফুল ইসলাম এই দুই ভাই মিলে রিং আইডির পরিকল্পনা করেন। রিং আইডির অ্যাপটির যাত্রা শুরুর পর শরিফুলের স্ত্রী আইরিন ইসলামকে চেয়ারম্যান, শরিফুল নিজে এমডি এবং সাইফুল পরিচালক হিসেবে এটি পরিচালনা করে আসছিলেন।
কিন্তু এতদিন ধরে নির্বিঘ্নে কার্যক্রম চালালেও সম্প্রতি ই-কমার্সের প্রতারণা নিয়ে আলোচনার মধ্যে ধরা পড়ে রিং আইডির প্রতারণা। শুক্রবার (১ অক্টোবর) রাতে গুলশান এলাকা থেকে রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার।
তার নামে ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা রয়েছে বলে সিআইডি জানিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, শুধু তিন মাসে রিং আইডি ২১৩ কোটিরও বেশি টাকা আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে।
সাইফুল ছাড়াও রিং আইডির অন্য মালিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
একজন গ্রাহক আইডি চালু করার পর বিশেষ করে দুটি অফারের আওতায় বিনিয়োগের কথা বলে রিং আইডি। একটি ১২ হাজার টাকার অপরটি ২২ হাজার টাকার প্যাকেজ। দুই প্যাকেজের আওতায় বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন ৫০টি ও ১০০টি করে বিজ্ঞাপন দেখলেই প্রতিদিন ৭৫০ টাকা হিসেবে সপ্তাহে সাত হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন।
শুধু তাই নয়, অন্যকে আকৃষ্ট করতে দেওয়া হতো আরও লোভনীয় অফার। দেশে নিষিদ্ধ ব্যবসা এমএলএমের মতো কাউকে আইডি খুলতে রেফার করলেও চেইন অনুযায়ী নিয়মিত টাকা জমতে থাকবে ওই বিনিয়োগকারীর আইডিতে। আর এভাবেই একজনকে হাতিয়ার করে অন্যকে আইডি খোলায় উদ্বুদ্ধ করা হতো। হাতিয়ে নেওয়া হতো মোটা অংকের টাকা।
জানা যায়, শুরুতে আইডি পরিচালনাকারীদের টাকা দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করত রিং আইডি পরিচালনাকারীরা। তাদের মাধ্যমেই অন্যদের আইডি খুলতে উদ্বুদ্ধ করা হতো।
সম্প্রতি ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রতারণা ও গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যতিক্রমী কায়দায় প্রতারণার ফাঁদ পাতে রিং আইডি।
ই-কমার্স সাইটগুলোর মতো গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের জন্যই রিং আইডি পরিকল্পনা সাজিয়েছিল বলে দাবি করেছে সিআইডি। রিং আইডির প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাইফুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে তারা। আরও তথ্য জানতে শনিবার তাকে আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘রিং আইডি একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অ্যাপ লঞ্চ করলেও পরে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহ করেছে। তারা গত তিন মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকার ওপর টাকা তুলেছেন। এসএসএল নামের পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ১২ হাজার ও ১৫ হাজার টাকার প্যাকেজের আওতায় গ্রাহকদের কাছ এসব অর্থ আদায় করেছে।’
রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘আমরা তাদের তিনটি ব্যাংকে হিসাব যাচাই করে শুধু গত তিন মাসের চিত্র পেয়েছি। তারা আরও আগে থেকেই গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা তুলছে, যা একেবারেই বেআইনি। গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা পাচার করা হয়েছে কি না, সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি।’
সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘রিং আইডি এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা তুলেছে। আর এই বিপুল টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে কি না, তা নিয়ে মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় অনুসন্ধান চালাচ্ছে সিআইডি। প্রমাণ পাওয়া গেলে রিং আইডির মালিকদের মানিলন্ডারিং মামলার আওতায় আনা হবে।’