আজ শনিবার প্রত্যন্ত সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়া প্রায় পাঁচশো পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন বাসন্তীর এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সুন্দরবন টাইগার অ্যাফেকটেড ফ্যামিলি'(STAF)। এনিয়ে সাময়িকীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর আজ আজ শনিবার এসব হত দরিদ্র অসহায় পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়ালো এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়া বাঘে খাওয়া অসহায় পরিবারগুলোর জন্য সামান্যতম সাহায্যের হাত বাড়াননি কেউই। এমনকি তাদের খোঁজও রাখেন না কেউই। বৃদ্ধা বিধবা মা কিংবা তাদের সন্তানদের জন্য কোন সরকারী কিংবা বেসরকারী সংস্থা এগিয়ে আসেননি; কোন অনুদান পায়নি তারা। অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন হতভাগ্য মানুষগুলো। সেইসব বিধবা মা ও তাঁদের অসহায় সন্তানদের কথা চিন্তা করে তাদের পরিবারের পাশে ধারাবাহিক ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন সুন্দরবন টাইগার অ্যাফেকটেড ফ্যামিলির কর্ণধার শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রাক্তন শিক্ষক তথা সমাজসেবী অমল নায়েক।
অনেক ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জের অমল নায়েককে এলাকার মানুষ একই বাক্যেই ‘অমল স্যার’ নামেই চেনেন এবং জানেন। সুন্দরবনের বাসন্তী হাইস্কুলের প্রাক্তন ইংরেজী শিক্ষক অমল বাবু তিনি অনুভব করেছেন ‘পেটের ক্ষিদের নিদারুণ জ্বালা মেটাতে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গলে, নদী, খাঁড়ীতে, মধু, মাছ, কাঁকড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে যেভাবে বাঘের আক্রমনের শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন কিংবা বাঘের খাদ্যে রুপান্তরিত হয়েছেন।’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি তরফ থেকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ পাননি এই সব বাঘে আক্রান্ত পরিবারগুলো। পেটের তাগিদে সংসারের হাল ধরতে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের পেটে গিয়েছেন গৌর, মঙ্গলরা। একের পর এক বাঘের পেটে যেতে যেতে এক সময় বিধবা গ্রামে তৈরী হয়ে গিয়েছে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গোসাবায়। স্বামীকে হারিয়ে ছেলে-মেয়েদের কে নিয়ে একাধিক সমস্যায় জর্জরিত বিধবা মায়েরা। সংসারের জোয়ালের চাপে অনেকের শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।
সেই সব অসহায় হতদরিদ্র প্রায় তিনশ পরিবারের হাতে তুলে দিলেন পড়াশোনার যাবতীয় খরচ, বইপত্র, জামাকাপড়, মশারী সহ প্রচুর পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। পশুপালন করে সংসার চালানোর জন্য দিয়েছেন ছাগল, হাঁস,মুরগী।
এতে করে কি ঐ অসহায় পরিবারগুলোর সমস্যা সমাধান হবে? তাই একটু ভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা করে সেই সব বাঘে খাওয়া বিধবা মা এবং পরিবারের ছেলে মেয়েদেরকে হাতের কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি মাসিক রেশন ব্যবস্থা চালু করেন অমল বাবু।
প্রাথমিক ভাবে ঝড়খালিতে শুরু করলে ও বর্তমানে গোসাবা, কুলতলি, বাসন্তী এলাকার প্রায় পাঁচশো পরিবারকে এই রেশন ব্যবস্থার আওতায় এনে চাল, ডাল, তেল সহ অন্যান্য নিত্য সামগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আজ শনিবার দুপুরে বাঙালীর প্রিয় উৎসব আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে এক মিলন মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে অসহায় পরিবারগুলোর মাঝে টাকা, নতুন বস্ত্র সহ খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন অমল নায়েক। এর পাশাপাশি অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে মৎস্যজীবী বিধবা মায়েরা সরকারের কাছে দাবী করেন, ‘বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুর মিছিল যেন আর দীর্ঘ না হয়। সেইসাথে তারা সুন্দরবনকে বাঁচানোর পাশাপাশি সরকারকে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবী জানান। এছাড়াও তারা সুন্দরবনের নদী বাঁধ রক্ষা করার দাবী জানান। স্বাস্থ্যসম্মত ও মানবিক জীবন যাপন সহ বসবাসের উপযোগী ঘরবাড়ি চেয়ে তারা সরকারের কাছে দাবী জানান।
এই মিলন উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. পূর্ণেন্দু রায়, অভিনেতা জ্যাক(দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য), রোটারিয়ান সুদীপ দে, প্রাক্তন শিক্ষক তথা সুন্দরবনের প্রাবন্ধিক প্রভুদান হালদার সহ বিশিষ্টরা।
অমল বাবু সাময়িকীর এই প্রতিবেদককে বলেন, “পরিবারের উপার্জকারী কর্তার অকাল মৃত্যু হলে সেই পরিবারের যে কি হাল হয় তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং তাদের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করেছি। তাই প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, এবং যে সকল পরিবারের সদস্য’রা প্রিয়জন এবং উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনাথ ও অসহায় হয়ে পড়েছে, তাদের পাশে সামান্যতম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। আগামীদিনে যাতে আরো বেশী সংখ্যক অসহায় পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি তার চেষ্টা করবো।”
অসহায় বাঘে খাওয়া বিধবা মা এবং তাঁদের সন্তানরা বলেন, “শিক্ষক অমল বাবু সব সময় যে ভাবে আমাদের পরিবারগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা করেন তা অতুলনীয়, তিনিই আমাদের অন্তরাত্মা কলির দাতা কর্ণ অমল নায়েক। তিনি এবং তাঁর ‘সুন্দরবন টাইগার অ্যাফেকটেড ফ্যামিলি’(STAF) পাশে না দাঁড়ালে আমরা হয়তো প্রাণে বাঁচতাম না। তিনি আমাদের হৃদয় জুড়ে চিরস্মরনীয় থাকবেন।”