পর্ব – এগারো: গ্যালাক্সির শুদ্ধ পরমাণুর শ্বাস নিচ্ছে উভয়ে
রোদও আচমকা মিলিয়ে যেতে পারে, মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতে পারে কালো ছায়া। ছায়ায় জমে যেতে পারে মনের ভেতর থেকে তরঙ্গের মতো ছুটে আসা বর্ণমালা। চারপাশে কিংবা মস্তিষ্কের অরণ্যেও তৈরি হতে পারে ঘন নিম্নচাপ, ধেয়ে আসতে পারে তুফান কিংবা বৃষ্টিপাতের উল্লাসের পর প্রকৃতির মতো শুভ্র হয়ে উঠতে পারে মন-আকাশ। কিন্তু একটা কালো ছায়া দুম করে নেমে এসে গিলে ফেলার মতো ছড়িয়ে দিল ভয়াল আতঙ্ক। উর্বশীর মন পড়তে না পারার চন্দনার ব্যর্থতাই মূলত আলোর প্রকৃতিতে যে নিম্নচাপ তৈরি করেছে তারই পরিণতি হলো অর্ণবের মন আকাশের ঝড়। এই ঝড়ের দাপট তাকে কাবু করতে না পারলেও আবেগের ঝলমলে রোদের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে সমুদ্রে উত্তাল জলে কালো তেল ছড়িয়ে পড়ার মতো বিপণ্ন এক দুর্যোগ। এই দুর্যোগের আগ্রাসন সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকারডুবি ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেলের মতো বিনাশী না হলেও পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝল বড় বিপর্যয়ের ছোবল খেয়েছে পা। লাল কাঁকড়াটি যে-স্পটে কামড়ে ধরেছিল, যেখান থেকে অলৌকিক এক আলোকরেখা বেরিয়ে সংযোগ করে দিতো উর্বশীর সঙ্গে, সেই সংযোগের মাধ্যম কণাতরঙ্গ আর আলোর বিকিরণ ঘটাচ্ছে না। ভয় গাঢ় হচ্ছে। আতঙ্কের দানব স্ফীত হচ্ছে। এ ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে লুকিয়ে আছে উর্বশী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার শঙ্কা। এমন সময়েই দুর্ভাবনার কণাস্রোতে ভেসে আসা ক্ষীণ শব্দরাজি শুনতে পেল অর্ণব- সুন্দরবন এলাকার এক বনজীবী, তাকে কাঁকড়াজীবীও বলা চলে, জাহাজডুবির কারণে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া পশুর নদী দিয়ে মৃগমারি খালে ঢোকা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলছেন, ‘তেল দি বন ভাসায়ে দেছে। অহন কাঁকড়াজাতও মরতে বসিছে। সব কাঁকড়ার গায়ে তেল লেগি আছে। এরাম আর কয় দিন চললি বনের সব কাঁকড়া মইরে যাবেনে। কাঁকড়া মরলি আমরা ধরব কী, বেচপো কী, আর খাব কী?’
কাঁকড়াজীবী চিন্তা করছে তার আয়-রোজগারের কথা, আর অর্ণব চিন্তা করছে উর্বশীর কথা। কাঁকড়ার জন্য আলাদা মায়া বসে আছে মনে। ছোট প্রাণিটির অলৌকিক শক্তির উৎস জানা নেই, তবে চন্দন আলোয় বিচ্ছিন্ন জগতেও সেই শক্তি বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাচ্ছে নিজের মনে। সুন্দরবন উপকূলের কাঁকড়া লাল না হলেও মেটে রঙের বড় আকারের কাঁকড়ার জন্যও অদৃশ্য টান বোধ করছে অর্ণব। এ টানের কারণে টের পাচ্ছে তেলভাসা জলে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। কাঁকড়ার শরীরজুড়ে থাকা অসংখ্য ছিদ্রপথে দেহের ভেতর দ্রুত ঢুকে যাচ্ছে তেল, অক্সিজেন পাচ্ছে না কাঁকড়াকুল। ওর পরানে তাই ফুটে উঠেছে সমবেদনার কণাস্রোত। এ স্রোত কি পৌঁছাবে কাঁকড়াকুলের বোধের জগতে?
অন্য সময় হলে এমনি উদ্ভট ভাবনার জন্য হাসি পেত। এখন হাসি পেল না। ‘সুন্দরবনের উপকূলের বিরানভূমিতে এখন আর ঘুরে বেড়াচ্ছে না বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমিরের চরেও দেখা নেই রোদ পোহানো কুমিরের ঝাঁক।’ ট্রলার চালকের এমন কথার কম্পমান অণুও কানে এলো।
বন এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে না আত্মঘাতী বিপর্যয় ঘটানো হয়েছে ভেবে পেল না অর্ণব। তবে বুঝল গ্যালাক্সির কণাস্রোতের ওয়েব পোর্টালে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে এই বিপর্যয়ের কথা। স্বয়ং উদ্বিগ্ন হয়েছে জাতিসংঘ আর বিশ্বের সব টেলিভিশনে ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি দূষণের আতঙ্কজনক সংবাদ-তরঙ্গের ঢেউ। প্রকৃতিবিদদের শঙ্কাও বুকে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে, ব্রেনে দুর্ভাবনার ‘কিউ’ ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঁকড়া বিলুপ্তির আশঙ্কা।
আশঙ্কার আড়াল থেকে মনের কণাস্রোত ছুটে গেল উর্বশীর দিকে। আঁধারে ঢেকে আছে উর্বশী। দেখা যাচ্ছে না তাকে। কাঁকড়াবিদ্যার সংযোগে ঘনঘটার কারণেই এমন ঘটছে কণাস্রোতই, বুঝল ও। সংযোগের প্রধান উপকরণ নয়। কাঁকড়ার কামড়ের সঙ্গেও মিশে রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো মহাশক্তির ওয়েব পোর্টালও।
উর্বশীকে নিয়ে আটকে থাকা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেছে। উর্বশীর ভেতর যেটুকু মমতার গোপন অনুকণা রয়েছে, যেটুকু লুকিয়ে আছে নিজের ভেতর, একের মধ্যে উভয়ের মিশ্র বিকিরণসংগীত না জেগে উঠলে এখানে অক্সিজেন পাবে কীভাবে, বাঁচবে কীভাবে নিজে?
অনিশ্চয়তার বিকিরণ ঘটছে; শঙ্কাও ছড়িয়ে যাচ্ছে জলরাজ্যের তলদেশ থেকে উপরের দিকে। অনুভব করা যাচ্ছে না উর্বশীর অস্তিত্ব। তবে কি তেলবাহী জাহাজডুবির মতো উর্বশীর জীবনও ঢেকে যাচ্ছে কোনো বিপর্যয়ের ঘনঘটায়? আঁধারের ভেতর থেকে কি আর বেরিয়ে আসবে না উর্বশীর কণাস্রোত?
শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে আবার পাতালের জলরাশির মধ্য থেকে অর্ণব তাকাল ওপরের দিকে। সুন্দরবনে আসলে কী ঘটছে জানার জন্য মনকণার বিকিরণ ঠেলে পাঠাল সেখানে। বনের খাদ্যচক্রের ক্ষুদ্রপ্রাণী ও উদ্ভিদকণা মারা যাচ্ছে- অস্পষ্টই দেখার সুযোগ পেল সেই দৃশ্যপট। খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণটানা এলাকায় হরিণের দল। ওদের পেট গর্তে ঢুকে গেছে, পিঠের হাড় বেরিয়ে কাঠের মতো দেখাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে উষ্ণ বাতাস বেরুচ্ছে। হরিণদলের এ করুণ অবস্থা আর কাঁকড়াদের মরণদশা দেখে ধোঁয়াশায় ভরে গেল অর্ণবের জলজীবনের আলোস্রোত।
দিশেহারা লাগছে। কাঁকড়ার কামড়-স্পট থেকে আলোর বিকিরণ নেই, বিচ্ছিন্ন উর্বশীর সংকেত নেই!
নেই! নেই! হাহাকার জাগছে মনে।
আকস্মিক আনন্দের বুদবুদ উঠল সাগরতলে। এসব অনুভূতির অর্থ কি?
বেঁচে আছে ও?
কল্পনায় নয়, বাস্তবে?
আবিষ্কার করল উর্বশীকে প্রতিদিন খুঁজতে থাকা কক্ষপথের মূল কেন্দ্রে কি তবে রয়েছে অবস্থান হারিয়ে যায়নি সাগরতলে। গ্যালাক্সির কক্ষপথে আলোকণারূপে কি ঘুরে বেড়াচ্ছি ও। এই আলোর কণাই কি দেহত্যাগী আত্মা? হাশরের ময়দানে কি তবে এই আত্মাই আবার প্রতিস্থাপিত হবে নিজ-দেহে?
নিজেকে নিয়ে প্রশ্নের বুদবুদ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে আধ্যাত্মিক চেতনার উত্তর। সরাসরি উত্তর জানা নেই। উত্তর জানা না থাকলেও অসুবিধা নেই। কেবল আত্মার অনুরণন নয়, দেহের মধ্যেও অর্ণব দেখতে পাচ্ছে নিজের বসবাস। সাগরতলের সীমাহীন জলজীবনে ঢুকে গেলেও অনুভব করছে দেহ-মনের। ক্ষতি কী?
না ক্ষতি নেই। তবে কষ্ট হচ্ছে উর্বশীর জন্য। ধোঁয়াশায় ঢাকা উর্বশীকে দেখা যাচ্ছে না। এ কষ্ট ছড়িয়ে যাচ্ছে জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে। কাঁকড়া দলের জন্যেও। নিজের ক্ষত, উর্বশীর বিপদ, কাঁকড়া-বিপর্যয়েও ভেঙে যাচ্ছে না নিজে; ভালোবাসার বর্ম ধারণ করেছে দেহে, এ বর্ম হচ্ছে উর্বশীর জন্য ভালোবাসা। দেহ পচে গেলেও এ বর্মে পচন ধরবে না- স্থির বিশ্বাস নিয়ে অর্ণব আবার তাকাল পায়ের দিকে।
হঠাৎ ঝলমল করে উঠল কাঁকড়া-কামড়ের স্থল। আকস্মিক ছুটে বেরুতে লাগল মুক্তোদানার মতো চন্দন রোশনি। পানিতে বুদবুদ তুলে এই কণাস্রোত উড়ে যাচ্ছে পানির স্তর ভেদ করে মহাশূন্যে। ধনুকের মতো বেঁকে রশ্মিবিমটি আবার ছুটে যাচ্ছে ঢাকা শহরের দিকে- ঠিক তখনই অর্ণব দেখল চোরাগলি থেকে মাথা উঁচিয়ে বেরিয়ে আসছে উর্বশী!
উর্বশী! পরান জুড়িয়ে গেল তোমাকে দেখে! মনে মনে মেসেজ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে নীরব আঁধারস্তরে জ্বলে উঠল বাতি, চন্দন আলোয় স্পষ্টই অর্ণব চিনতে পেল উর্বশীকে। মৃত নক্ষত্র জেগে উঠার মতো শবাগারের প্রাণহীন প্রাণ থেকে যেন জেগে উঠল অভিমানী আরেক প্রাণ।
নড়ে উঠে চিৎকার করে উর্বশী বলছে- ‘আঁধার থেকে বেরিয়ে আয় চন্দনা। আলোর দিকে আয়। আঁধারের গলিতে ঢুকলে আমি হারিয়ে ফেলি সে অর্ণবের অস্তিত্ব। আঁধার আমার জন্য নয়; আলো চাই আমি, চাই কেবল আলোর জগৎ।’
চন্দনাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল অর্ণব। উর্বশীর উদ্দেশে চন্দনা বলছে, ‘যা, তুই আপাতত বাড়ি ফিরে যা। অপেক্ষা কর। আমাকে এগোতে দে। ঝুঁকি না নিলে কি উন্নতি করা যাবে জীবনে?’
‘জীবন সচ্ছল করার জন্য আঁধার গলিতে ঢুকতে হবে? ফিরে আয়।’
আবারও অর্ণব শুনল উর্বশীর কণ্ঠস্বর। শূন্য থেকে নেমে এলো পাহাড়সমান পূর্ণতা। পূর্ণিমার দীপ্তি নিয়ে ভেসে উঠল আঁধারে ঢেকে থাকা চাঁদ। সেই আলোকতরঙ্গ বেয়ে ব্ল্যাকহোল বা কালো গর্ত থেকে হকিং রেডিয়েশন কণার মতো ছড়াতে লাগল উর্বশী থেকে নিঃসৃত শব্দকণার বিস্ময়কর উদগীরণ।
উর্বশীর আহ্বানে সাড়া দিল না চন্দনা। তার কণ্ঠ তীব্রতা হারিয়ে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দুর্বল কণ্ঠ ভেসে এলো এবার, ‘তুই যা। তোর মায়ের কাছে গিয়ে উঠ, যতক্ষণ নিজ পায়ে দাঁড়াতে না পারব ততক্ষণ সেখানেই থাক।’
‘না। না। না। মা’র সঙ্গে থাকা যাবে না। তাঁরা আমাকে আবার বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আবার বিয়ে কী? বিয়ে তো করেছিই আমি। অর্ণব তো আছেই আমার সত্তায়। গ্যালাক্সির শুদ্ধ পরমাণুর শ্বাস নিচ্ছি উভয়ে। আবার কি বিয়ে মানায় আমাকে?’
উর্বশীর মনজাগানিয়া কথা শুনেও হাহাকার করে উঠল অর্ণবের মন। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের মতো আচমকা আঁধার আবার চেপে ধরল আত্মার আলো। বিস্বাদ আর বিপদের হিজিবিজি কণাতরঙ্গ ঢেকে দিতে লাগল শুদ্ধ আত্মার স্বর। নিজেকে স্বার্থপর ভাবতে পারছে না অর্ণব। রক্তমাংসের উর্বশী নিজের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের জন্য বিয়েবিহীন থাকবে, মানছে না অর্ণবের অনুভবের ক্ষীণ কণারাও। মগজে ঢল আসছে। জলের চাপে আক্রান্ত হচ্ছে মস্তিষ্ক। উদার হতে গিয়েও বিপদে পড়ল কেন? তবে কি নিজের তল-অন্তরই উর্বশীর আবার বিয়ে করার অনুমতি মানছে না? দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে গেল। কী করবে সে? ঝড়ো বেগে ছুটে এসে মস্তিষ্কে আক্রমণ করা প্রশ্নটি উড়িয়ে দিতে পারল না অর্ণব। উত্তর বের করে মীমাংসা করতে পারল না, বরং আগুন তাতানো শিক কাবাবের মতো কাবাব হতে লাগল শীতল জলস্রোতের তলেও।
চলবে…