নাটোরে প্রকাশ্যে এসিড দিয়ে জুয়েলারি স্বর্ণ গালানোর কাজ চলছে প্রতিদিন। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ব্যবহারকারী, পথচারীসহ এলাকাবাসী। মানছে না ব্যবহার বিধি, নেই এসিড ব্যবহার বা বহনের লাইসেন্স। এসব কারখানায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্গত হচ্ছে এসিড পোড়ানোর গ্যাস।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অধিকাংশ জুয়েলারী কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এখানকার কারখানার কাজে ব্যবহৃত নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিডের নিঃসৃত ধোঁয়া কারখানার স্বল্প দৈর্ঘ্য পাইপ দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পাশের বাড়িঘরে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে স্মারকলিপি ও জুয়েলারি মালিক সমিতিকে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রক্ষা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে।
বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করায় বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। কাপুড়িয়াপট্টি, পিলখানা ও লালবাজার এলাকায় বসবাসকারী অন্তত দুইশতাধিক পরিবারের লোকজনের জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে।শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, চর্মরোগ, চক্ষুসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এখানকার মানুষ।
নাটোর শহরের প্রাণকেন্দ্র লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টির আংশিক, পিলখানা ও রসুলের মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই এলাকার রাস্তার দুই ধারে গড়ে ওঠা স্বর্ণকার পট্টি নামে সুখ্যাতি রয়েছে। অভিজাত আবাসিক এই এলাকায় সব পেশা ও শ্রেণীর কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করেন।
সম্প্রতি এই এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। এসব ভবনে মানুষের বসবাসের পাশাপাশি সোনার গহনার শো-রুমসহ কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় শতাধিক কারখানায় গহনা তৈরির জন্য গলানো হচ্ছে সোনা-রুপা। এই কাজে ব্যবহার করা হয় এসিড।
১৯৫০ সালের দিকে নাটোর শহরের কাপুড়িয়া পট্টি, পিলখানা, রসুলের মোড়সহ লালবাজার এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি দোকান দিয়ে জুয়েলার্স ব্যবসার সূত্রপাত ঘটে। কালের বিবর্তনে এখন প্রায় তিন শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে।
কালুরমোড়ের পথচারী মো. ইয়াকুব সাময়িকীকে জানান ‘প্রায় প্রতিদিন নিচাবাজরে আসতে হয়। রিক্সা বা ইজিবাইকে চলাচল করতে তেমন অসুবিধা না হলেও পিলখানা দিয়ে হাটতে অসুবিধা হয়। অনেক সময় হাটতে গেলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে চলতে হয়। কারণ এসিডের ধুয়ায় এই পথে আচ্ছন্ন থাকে।’
শহরের পিলখানার স্বর্ন কারিগর অঞ্জন সাহা সাময়িকীকে জানান, ‘কারখানায় কাজ করতে গেলে নাক মুখ জ্বালাপোড়া করে। একাজে কোন জটিল রোগ হতে পারে এমন আশঙ্কা নিয়েই শুধু জীবন কাটানোর জন্য একাজ করতে হয়।’
‘ক’দিন আগেও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে মুক্ত বাতাস নিয়েছেন। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত একমাত্র ফাঁকা জায়গাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাহাদুর শাহ পার্ক নামের ওই ফাঁকা জায়গাটিতে এখন শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবন। সেখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে সোনার দোকান।
এখন বাড়ির ছাদে উঠে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সোনা গলানোর ধোঁয়ায় এলাকার বাতাস এখন দুষিত। নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী ভাস্কর বাগচীর সাথে এলাকার পরিবেশ নিয়ে কথা বলার সময় এসব কথা তিনি বলেন।
এলাকার অপর বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক একই ধরনের অভিযোগ করে সাময়িকীকে জানান, এলাকায় চলাফেরা করতে সোনা গলানো এসিডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
প্রতিদিন আমাকে লালবাজার থেকে নিচাবাজার যাতায়াত করতে হয়। আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা স্বর্ণপট্টির মধ্য দিয়ে চলতে বড় কষ্ট হয়।’
চৌকিরপাড় এলাকার খোকন সাহা সাময়িকীকে জানান, ‘এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে পিলখানা রাস্তায় চলতে সমস্যা হয়। এসিডের ধোঁয়ায় রাস্তায় আচ্ছন্ন থাকে।এব্যাপারে মালিক ও কারিগরদের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি।’ এসিড দিয়ে সোনা-রুপা গলানোর জন্য কারখানা সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার দাবি করেন তিনি।
এলাকার মুক্তার হোসেন সাময়িকীকে জানান, ‘এলাকায় সোনা-রুপা গলানোর কারণে এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এখানকার সিংহভাগ মানুষ শ্বাকষ্টে ভুগছেন। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন করে মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। এছাড়া চর্মরোগ রোগসহ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন উদ্যোগ বা প্রতিকারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।’
লালবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম সাময়িকীকে জানান, ‘এলাকার মানুষদের মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য বাহাদুর শাহ পার্ক নামের একটি খোলা মাঠ ছিল। এখানে অনেকেই শরীর চর্চাসহ মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতেন। ৮০র দশকে তৎকালীন পৌর পরিষদ সেখানে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয়।
এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সে সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ওই মার্কেট নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন পর বর্তমান পরিষদ সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর আদালতে মামলা করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মার্কেট নির্মাণ চলমান রয়েছে।’
নাটোর পৌরসভার দুই নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন সাময়িকীকে জানান, ‘বহুকাল ধরে লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টিসহ আশেপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে সোনার গহনা তৈরিসহ স্বর্নালংকারের দোকান। লালবাজার এলাকার সোনার গহনার সুখ্যাতি রয়েছে ভারতসহ দেশ-বিদেশে।
এক সময় হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এই সোনার গহনা তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন। এখন ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় দোকানের সাথেই রয়েছে গহনা তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় এসিডে সোনা গলানো হয়। কিন্তু এসিড ব্যবহারের বিধিনিষেধ মানছে না কেউ।
জুয়েলরী মালিকরা তাদের প্রয়োজনে তৈরি করছেন অভিজাত অট্টালিকা। ওই সব ভবনে চালু করা হচ্ছে সোনার দোকানসহ কারখানা। এসব ভবনের পিছন দিকে এসিডের ধোঁয়া নির্গমণের পাইপ সংযুক্ত করায়, এসিডের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। এছাড়া বিল্ডিং কোড না মেনে এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
এতে করে আগামীতে পানি নিষ্কাসনসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে।’ কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেনসহ এলাকাবাসীর দাবি, বিষাক্ত ধোঁয়া বের হওয়া কারখানাগুলোকে জনবহুল এলাকা থেকে সরিয়ে লোকবসতি যেখানে কম, এমন স্থানে স্থানান্তর করা হোক। এ বিষয়ে তারা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নাটোর শহরের এসিড ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সাময়িকীকে জানান, ‘প্রতি মাসে অন্তত তিন টন এসিড বিক্রি করে থাকেন। এর মধ্যে জুয়েলার্স কারখানায় মাসে অন্ততঃ পাঁচ থেকে ছয় মন এসিড ব্যবহার করা হয়।’
নাটোর জেলা জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত সাময়িকীকে জানান, এসিড ব্যবহারের কারখানাগুলো স্থানান্তরের কথা ইতিপূর্বে শুনেছিলাম। নিরাপত্তার কারণেই হয়তো স্থানান্তর করা হয়নি।
প্রশাসনিকভাবে যদি কারখানাগুলো স্থানান্তর করেন এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন তাহলে স্থানান্তরে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবেনা। তবে সোনার দোকানের কাছাকাছি কারখানা থাকলে ভাল হয়।’
নাটোর সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মো. রবিউল আওয়াল সাময়িকীকে জানান, ‘এসিডের ধোঁয়া মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি ও চর্মরোগ হতে পারে।
এমনকি হৃদরোগসহ নানা ধরনের শারিরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি হলেও র্দীঘমেয়াদী বিষাক্ত এই ধোঁয়ার প্রভাবে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের মত জটিল রোগও হতে পারে। হাসপাতালে আসা শ্বাসকষ্ট বা চর্মরোগীদের অধিকাংশই এই স্বর্ণপট্টি এলাকার বাসিন্দা বা স্বর্ণ কারিকর।’
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা সরকার শফিকুল ফেরদৌস সাময়িকীকে জানান, ‘এসিডের ধোঁয়া মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাস কষ্ট, চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগ সহ নানা ধরনের শারিরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
এবিষযে বগুড়াস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুফিয়া নাজিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কর্মস্থলে নতুন যোগদান করেছেন বলে জানিয়ে এই সাময়িকীর প্রতিবেদককে রাজশাহীস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
রাজশাহীর সিনিয়র কেমিস্ট মিজানুর রহমান সাময়িকীকে জানান, রাজশাহী অফিসের উপপরিচালক মাহমুদা পারভিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান বলেন, জনগুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
দুই একদিনের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করাসহ জেলা প্রশাসন ও জুয়েলারি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে কারখানা সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হবে। এছাড়া এনিয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে ব্যাপারে স্থানীয় বিশিষ্টজনদেরও পরার্মশ নেওয়া হবে।,
পরিবেশ অধিদপ্তর এর রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান সাময়িকীকে জানান, ‘আবাসিক এলাকায় এসিড পোড়ানো যাবে না। নিয়মানুসারে প্রত্যেক কারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিপত্র নিতে হবে। নাটোরের অনেক কারখানায় অনুমতি নেই। এসব অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন।’
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ সাময়িকীকে জানান, তিনি কিছুদিন হল নাটোর কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। অনেক কিছুই তিনি এখনও অবগত হতে পারেননি। তবে আবাসিক এলাকায় এসিডে সোনা গলানোর বিষয়টি সমর্থণযোগ্য নয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সমস্যার সমাধানে এলকাবাসীসহ বিশিষ্টজনদের সাথে আলাপ করে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ জুয়েলারি মালিক সমিতিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।’