দশ হাত নেই, পেটে কালির আঁচড়ও নেই। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে জীবনতরী বেয়ে চলেছে এযুগের দুর্গা। প্রত্যন্ত সুন্দরবনের কুলতলির মৈপিঠ উপকুল থানা এলাকার ভুবনেশ্বরী পঞ্চায়েতের ১লা ঘেরীর বাসিন্দা এযুগের দুর্গা জ্যোস্না শী।
বিগত প্রায় ত্রিশ বছর আগে রায়দিঘীর সূর্য্যপুরের নন্দকুমার পুরের গ্রামের ১লা ঘেরীর শঙ্কর শী এর সঙ্গে জ্যোস্নার বিয়ে হয়। দরিদ্র পরিবারে হাল ধরতে জ্যোস্না নিজের কাঁধে তুলে নেয় সংসারের দায়িত্ব। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার লড়াই। স্বামীকে সাথে করে একটি ডিঙি নৌকা চড়ে প্রতিদিনই বেরিয়ে পড়তেন সুন্দরবন জঙ্গলে- উদ্দেশ্যে মাছ,কাঁকড়া ধরা; কোন রকমে চলতো জীবনজীবিকা। জ্যোস্না শী’র স্বামী শঙ্কর ও দুই দেবর শশাঙ্ক ও কিংকর। আচমকা শী পরিবারের বুকে নেমে আসে বিপর্যয়। নদীতে কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার সময় বজ্রপাতে মৃত্যু হয় দেবর কিংকর’র। শোক কাটিয়ে উঠে কোন রকমে চলছিল শী পরিবার। ধীরে ধীরে শঙ্কর-জ্যোস্না দম্পতির দুই কন্যা সন্তান বড় হতে থাকে। গত ছয় বছর আগে বড় মেয়েকে পার্শ্ববর্তী পাড়ার জয়দেব মন্ডলের সাথে বিয়ে দেয়। জামাই ও মৎস্যজীবী। দুর্ভাগ্য, গত পাঁচ বছর আগে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে পড়ে জয়দেব। সেই সময় বাঘের আক্রমণ থেকে জামাইকে উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে আসেন জ্যোস্না। কিন্তু প্রাণে বাঁচাতে পারেন নি। এরপর দুঃখ, দুর্দশা নিয়ে দিন অতিবাহিত করছিল দরিদ্র শী পরিবার। ছোট মেয়ে রুম্পা স্থানীয় চভুবনেশ্বরী জয়কৃষ্ণ উচ্চমাধ্যমিক হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। খরচও বেড়ে চলেছে শী পরিবারের। একমাত্র আয় বলতে মাছ-কাঁকড়া ধরা।ফলে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে দীর্ঘ ২৬ বছর খেয়াতরী বেয়ে চলেছে এযুগের দুর্গা জ্যোস্না শী।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শী পরিবারে বুকে মহাবিপর্যয় নেমে আসে। গত ৩ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন জ্যোস্না দেবীর স্বামী শঙ্কর। তিনি জঙ্গলে যাবেন না বলে একাধিকবার নিষেধ করেছিলেন স্বামীকে। কিন্তু অভাব অনটনে যদি ১০০ টাকা আয় হয়। ফলে বাধা দিয়েও স্বামীকে সাথে নিয়ে সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে রওনা দিয়েছিলেন সেদিন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাদের নৌকা রেখে কাঁকড়া ধরার সুদ ফেলছিলেন। ঘটনাচক্রে একটু বেশী কাঁকড়া ধরার আশায় দুরে একটি খাড়িতে চলে যায় জ্যোস্না। এরপর ফিরে আসতেই চোখের সামনে দেখতে পায় স্বামীকে বাঘ আক্রমণ করেছে। টানতে টানতে এক লহমায় গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বাঘ। স্বামীর করুণ পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। স্বামী একবারই করুণ স্বরে বলছিলো ‘জ্যোস্না, তুমি আমাকে বাঁচাও।’ তিনি তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেন। আমাকে বেঁচে থাকতে গেলে স্বামীকে যেভাবেই হোক বাঘের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। মুহূর্তেই খালি হাতে এক লাফে বাঘের পিঠে চড়ে বসেন এ যুগের দুর্গা। স্বামীকে উদ্ধার করতে বাঘের মুখ, কান,গোঁফ ধরে পাক দিতে থাকেন। বাঘও তার শিকার ছাড়তে নারাজ। মিনিট কুড়ি লড়াইয়ের পর একসময় বাঘের দুই কানে স্বজোরে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে পাক দিতে থাকে। রণে ভঙ্গ দেয় রুদ্রমূর্তির বাঘ। শিকার ছেড়ে হুঙ্কার করতে থাকে। তবে জীবন্ত রণমূর্তি এযুগের দুর্গার সামনে দ্বিতীয়বার আর আক্রমণ করার সাহস দেখায়নি সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। স্বামীকে উদ্ধার করে নৌকায় তোলার জন্য একাধিক হাঁকডাক করলেও অন্যান্য মৎস্যজীবীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। কোন রকমে স্বামী শঙ্করকে নিয়ে নৌকার কাছে আসে। স্বামীকে নৌকায় তুলতে গিয়ে বেসামাল হয়ে নদীতে পড়ে জলে ডুবে যায় জ্যোস্নার স্বামী। আবারও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কোন রকমে স্বামীকে বাঁচিয়ে নৌকায় তোলেন। এরপর দ্রুত গতিতে নৌকার দাঁড় বেয়ে গ্রামের ঘাটে এসে প্রতিবেশীদের খবর দেয়। তারাই রক্তাক্ত শঙ্করকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আবার কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস পর স্বামীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন জ্যোস্না দেবী। স্বামী সুস্থ হলেও তার বাম হাত একেবারেই অকেজো হয়ে পড়েছে। পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী এমন করুণ পরিস্থিতিতে কিভাবে বাঁচবেন শী পরিবারে অন্যান্য সদস্যরা সেই চিন্তায় ঘুম উবে গিয়েছে এযুগের দুর্গা জ্যোস্না দেবীর। মেধাবী মেয়েরও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আহত শঙ্করের দাবী, “আমার প্রথম জন্মদাতা আমার গর্ভধারিণী মা সরস্বতী দেবী। পুনঃজনম দিয়েছে আমার স্ত্রী জোস্না। চিকিৎসা খরচ যোগাতে কী করবেন! সেই লড়াইয়ে সামিল হয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করজোড়ে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন শঙ্কর। তার আরো দাবী মাতৃরুপের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তার পরিবারের পাশে দাঁড়াবেই।
আহত শঙ্করের স্ত্রী ও কন্যা একই ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে বলেছেন “দিদি আমাদের বাঁচান। না হলে মৃত্যু ছাড়া কোন রাস্তা নেই।”